Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ১

maro news
গল্পেসল্পে সুবল দত্ত - ১

ক্রমহনন

Can’t calm the storm
ফল কবে পার হয়ে গেছে। উইণ্টারের মাইনাস কুড়ির ভারি বরফ মাস দুই তিন সহ্য করেও দু চারটে কমলা হলুদ রাণী রঙের ম্যাপল পাতা এখনো বিষন্ন গাছে টিকে রয়েছে। ওরা সাঁ সাঁ পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাদুরার ভীষণ অস্বস্তি। মাত্র ছয় মাস আগে দু পাশাড়ি বাহারি ম্যাপেলের ঝাঁক যখন পার হচ্ছিল তখন উইন্ড স্ক্রীনে বাতাস বসন্ত বাহার গাইছিল। এখন যেন শত শত শুওরের মরণ কাঁদন। মাদুরা উইন্ডো গ্লাস তুলে দিয়ে এসি অন করল। প্রায় মাস পাঁচেক পর তাপমান কমিয়ে পনেরোতে সেট করছে। আহ কি ভালো লাগছে। বহুদিন পর ঠোঁটে দুকলি টিম ম্যাকগ্রো আসতে চাইলো। মাদুরা বাধা দিলো না। গলা ছাড়ল। বিশাল চৌড়া রোড একেবারে স্তব্ধ। এঞ্জিনেরও শব্দ নেই,কেবল টায়ারের আর্তনাদ। একেবারে সোজা রাস্তা। কোনো বাঁক নেই। ডানদিকের একটা লেন ধরে স্টিয়ারিং সোজা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেই হল। কথাটা মনে আসতেই মাদুরা একটু হেসে ফেলে নিজেরি মাথায় এক চাঁটি কষিয়ে দিল। নির্দিষ্ট কয়েক মাইল পর পর নির্দেশ মত স্পীড বাড়ানো কমানো চাই। এখানে গাড়ি চালানোর এই এক হ্যাপা। না হলে ডিফল্টার হও। গাইতে গাইতে রেয়ার মিররে চোখ পড়তেই দেখলো পিছনের সিটে রায়া। ঘুমিয়ে কাদা। মুখের এন ৯৫ মাস্ক সরে গেছে। মাদুরার হঠাত্‍ শীত করতে লাগলো। কেঁপে উঠলো সারা দেহ। নিজের মুখে হাত বুলিয়ে টের পেল নির্জীব খড়খড়ে মাস্ক। এই গোয়ার্তুমির কোনো মানে হয় না। সঙ্গে সঙ্গে তাপমান তুলে দিল আঠাশ ডিগ্রিতে। মাস্ক ঢাকা রায়াকে ভারী সুন্দর দেখায়। এতো শান্ত গভীর কালো চোখ মাদুরা কখনো দেখেনি। যেন মনে হয় দেখতেই থাকি দেখতেই থাকি। ওকে সামনাসামনি মুখ খুলে হাসতে দেখেনি একবারও। এমনকি বছরদেড়েক আগে নিউইয়র্কে মন্দিরে না,পরের দিনে ম্যারেজ রেজিস্ট্রির সময়েও না। ওরসাথে কথাবার্তা প্রেম হাসি রাগ মস্করা সবই বড় ভার্চুয়াল। ওর সাথে দু দন্ড বসে নিভৃতে কথা বলতে পারেনি তো শরীরের প্রাইভেট সম্পর্ক দূরের কথা। ওই বিয়ের পর এক দু মিনিট চোখে চোখ মেলানো,ঠোঁটে ঠোঁট মেলানো,একটু জড়িয়ে ধরা। এই অব্দি। তারপর দুর্ভাগ্যক্রম। ছাড়াছাড়ি। বন্ধুরা বলে,এমন আয়রনি যেন কারোর না হয়। বিয়ের আগে কেউ কাউকে জানল না শুনল না। এরেঞ্জড ম্যারেজ ওয়াজ নট আ ফেয়ার ডিসিসন। অবশ্যি ওর সাথে কিছু যে হয়নি তা নয়,তবে সব মোবাইল ভিডিওতে। রায়া ম্যানহাটানের ছোটো বাথরুমের কমোটে বসে আর মাদুরা ওয়াশিংটন স্টেটের একটা বড় লিভিং রুমে। রায়ার সব ভালো। একেবারে এঞ্জেলের মত মাখন ফিজিক,কিন্তু স্ক্রীনে ও মুখ খুলে হাসলেই মাদুরার গা শিরশির করতো। অবশ্য ওটা রিয়াল ছিল না। নাঃ এখন এই কথা মনে আনতে নেই। কিন্তু আবার চোখ পড়ল সামনের রেয়ার মিররে। রায়ার নাকের পাটা ফুলে উঠছে নিঃশ্বাসে? একটা উত্কট দুর্গন্ধ নাকে এলো যেন? মাদুরা নাক ঘুরিয়ে শুঁকতে লাগলো। পচা মাংসের গন্ধ? দাঁতের ফাঁক থেকে? না নিঃশ্বাসে বিষ ভুরভুর করে বেরচ্ছে? মাদুরা ভীষণ অস্বস্তিকে প্রাণপনে চাপা দিতে চেষ্টা করল। দাঁত চিপে নিজেকেই রাসকেল বলে গাল দিতে দিতে দেখল,রায়া ঘুমঘোরে ফর্সা বাঁ বাহু মাথার উপর তুলেছে। বগলে সোনালী রেশম লোম। একটা মিষ্টি মাদক গন্ধ ভেসে এলো নাকে। রায়ার জন্যে শরীর ছটফট করছে। বাট হোয়ার ইস দ্যাট ফিলদি স্মেল? কোথায় সেই খারাপ গন্ধ? শি ই ই ট। মাদুরা ড্রাইভিং এ মন ফেরালো। এক্সিলেটরে অবাধ্য চাপ হচ্ছিল। চোখের সামনে উইন্ড শীল্ডে ঘষা কাঁচের মত একঘেয়ে ছিল ধুসর স্কাইস্ক্র্যাপার বিল্ডিংগুলো, হঠাত্‍ দৃশ্য বদলে সবুজ। দুপাশে ঘন চিরহরিত্‍ জঙ্গল। বড় বড় ওক বিচ রেডউড পাইন। একটু পরই একটা পেট্রোল পাম্প স্টেশনে গাড়ি থামাল সে।
যতদূর চোখ যায় হা হা করছে নির্জনতা। এখানেও কেউ থাকেনা। কার্ড দেখাও সেন্সরকে আর নিজে পেট্রোল ভরো। পেট্রোল ভরে দূরে তাকিয়ে দেখল,কানাডা ছুঁয়ে দিগন্ত বিস্তৃত গম্ভীর মাউন্ট বেকারের সোনা রঙের চূড়ো। প্রতিবার এদিক দিয়ে যাবার সময় মাদুরা একবার অবশ্যই মনে মনে সংকল্প করে,পরের বারে অবশ্যই ওখানে ট্র্যাকিং এ যাবে। এবারে সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি জানি কেন প্রকৃতির উপর একটা বিজাতীয় বিদ্বেষ সারা শরীরকে গরম করে দিল। খুব জোরে ‘বুলশিট!’ বলে চিত্কার করে মুখ ঘুরে তাকাতেই দেখে রায়া খুব কাছে। খোল ছাড়ানো শ্রিম্পের মতো সাদা হাত মুখ। ড্রাগন ফ্লাইয়ের ডানার মতো আধা স্বচ্ছ একটা টপ। চোখে বিষন্ন কৌতুক। হাতে গ্লাভস মুখে মাস্ক।
-‘হি হি তোমাকে ফারাওয়ের মমির মত দেখাচ্ছে বেবি। লুকিং স্ট্রেঞ্জ ইন পি পি ই’।
বলেই হাত বাড়িয়ে পাম্পের সামনে স্টিলের ব্যারিকেড ধরতেই যাবে,মাদুরা খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠল,-‘ডোন্ট, প্লিজ ডোন্ট টাচ এনিথিং হিয়ার’। রায়া থতমত খেয়ে গুটিয়ে গেল। অস্ফুট গলায় বলল,
-সরি কিন্তু আমি হ্যাণ্ড গ্লাভস পরেছি। হোয়াটেভার। ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি সব ভুলে গেছিলাম। সেই লং কোয়ারেণ্টাইনে থাকার টেনশন লাইফ। আমি যেন ওয়ার্ল্ড ওয়ার টুর সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলাম। ওরা রোজ দুটো তিনটে করে তুলে নিয়ে যেত আই সি ইউ তে। রোজ উঠে মনে হতো এবার আমার পালা। ওখান থেকে পালাতে পেরে সব ভুলে গেছি ডিয়ার। সব আমার মাথা থেকে মুছে গেছিল। সত্যি বলছি, আমি হানিমুনের মুডে ছিলাম বেবি। প্লিজ ফরগিভ মি।
রায়া কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে কারের দরজা খুলে ঢুকে গেল। মাদুরা বেশ কিছুক্ষন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register