Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ১০)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ১০)

বিন্দু ডট কম 

অপরাধবোধ কাকে বলে?কোনটা অপরাধ?কোনটা নয়?ভাবতে ভাবতেই ব্যাঙ্কে ঢুকছিল তরুলতা।আজ কেন তার মনে হচ্ছে আশপাশের সবাই শুধু তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে!তারা কি সব জেনে গেছে?বাড়ি থেকে বের হবার সময় তার বাড়িওয়ালা স্কুলমাস্টার বিক্রমজিত মাহাতোর বৌ ফুলগাছে জল দিতে দিতে তার দিকে চেয়ে ছিল।চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল।বিক্রমজিত মাহাত অখিলেশের বন্ধু। তাহলে কি ওরা সব জেনে গেছে?ট্রেকারে চড়ে ব্যাঙ্কে আসতে আসতে তরুলতা ভাবছিল।ঝাড়গ্রামে কী হঠকারিতা করে ফেলল সে?দূর থেকে যাকে বন্দরের আলো মনে হয়,কাছে গেলে বোঝা যায় সেটা নেহাতই এক দোহারা হ্যালোজেন স্ট্যান্ড।অখিলেশও কি তাই?প্রথমে সে তো জানতোই না অখিলেশ বিবাহিত।জানতোই না তার আটবছরের সেপারেশন!জানত না তীর্থর কথা!আর কী কী জানে না সে কে জানে?শুভব্রতকে সে জানে কি এতোদিনেও?কী করছে সে এখন?কে জানে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের কোন গলিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।আজকাল তাকে ফোন করলেও পাওয়া যায় না।উপভোক্তা জানায় মোবাইলে টাকা ভরেনি শুভব্রত। পুরোটা না জানলেও অনেকটাই জানে সে।শুভব্রত জাহাজ নয়,বন্দর নয়।সে একটা দ্বীপ।অনুন্নত আদিবাসীদের একটি দ্বীপ।সেখানে এখনও বিদ্যুত পৌছোতে এক যুগ।সেখানে এখনও মানুষ চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালায়। অফিসে ঢুকতে গিয়ে তরুলতা খেয়াল করল তার ব্রাঞ্চের দারোয়ানটিও আজ কেমন দায়সারাভাবে তাকে "গুডমর্নিং" সারলো।কিউবিকলে বসতে বসতে আর চোখে সে দেখল ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অখিলেশ চৌধুরীর ঘর বন্ধ।দেরি করে আসবার লোক সে নয়।গতকাল বেলপাহাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। তরুলতাকে ড্রপ করে তো সে তার বাড়িতেই চলে গিয়েছিল।শরীর খারাপ হল?ফোনে চেষ্টা করে লাভ নেই।আজ সকালেও করেছে সে।ফোন তার কাল রাত থেকেই সুইচ অফ।ঝাড়গ্রামের দামাল যাপনের মধ্যে অখিলেশ চৌধুরী হয়তো প্রয়োজনীয় ফোনচার্জিং ভুলে গেছেন। সামান্য গুছিয়ে নিয়ে ফাইলে হাত দিতেই তার কিউবিকলের সামনে কাস্টোমারদের লম্বা লাইন পড়ে গেল।এমনিতেই সোমবার কাজের চাপ থাকেই।তার ওপর শনিবার সেন্ট্রাল অডিট গেছে।সমরজিত দলুইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকার না মিলতে থাকা লিঙ্কটা তাকে ভাবায় মাঝেমাঝে। অখিলেশ কী কিছু গোপন করছে তার কাছে?সমরজিতের জন্য ওটিপি তো সেইই জেনারেট করেছিল।ওই একমুহূর্ত তাকে প্রথম অচেনা লেগেছিল তার।তাহলে কি অখিলেশ তার বিচ্ছিন্ন দাম্পত্যর মতোই লুকিয়ে গেছে সমরজিতের রহস্য। ভাবতে ভাবতেই আরও একগাদা ফাইল দিয়ে গেল ঋতবান।ঋতবান তরুলতার পাশের কিউবিকলেই বসে।কখনো তরুলতা টেলার হয়।কখনো ঋতবান।তার থেকে বয়সে ছোটই হবে কয়েকবছর।তবে এই ব্যাঙ্কে সে তার থেকে আট মাসের বড়।খুব অল্প কথা বলে।অবশ্য তরুলতাও কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না।ছেলেটি অখিলেশের কাছে বকুনি খায় মাঝেমাঝেই।দারোয়ান বলেছে ওর বাড়ি মেদিনীপুর।ওর একটা নার্ভের রোগ আছে বলে ওকে ওপর থেকে মানসিক চাপ না দিতে বলা হয়েছে।হয়তো সে কারণেই চুপচাপ।ফাইল নামিয়ে ঋতবান বলে গেল,"স্যার ফোন করেছিলেন।বলেছেন এই ফাইলগুলো দেখে রাখতে।স্যার আসছেন।" অখিলেশ আসছে!অথচ সে কথা তাকে জানাচ্ছে ঋতবান।অথচ ছত্রিশ ঘন্টা আগে চিলকিগড়ে খোলা আকাশের নিচে তারা সঙ্গম করেছে!তাহলে কী অখিলেশের আরেকটি না দেখা দিক আবিষ্কার করে ফেলল তরুলতা?কাস্টোমার সামলাতে সামলাতেই ফোনটা একবার দেখে নিল সে।না।অখিলেশের কোনও মেসেজ নেই।একটাই মেসেজ।শুভব্রতর। "কেমন আছো?"চমকিয়ে সামনে আবার তাকাতেই সে দেখল সকাল থেকে তার মধ্যে দানা বেঁধে থাকা অপরাধবোধের হদিশ যেন পেয়ে গেছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি ক্লায়েন্ট!ওরাও কী সব জেনে গেল? ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কাস্টোমার সামলাতে সামলাতে বেলা গড়িয়ে গেল।অখিলেশ এলোই না সারাদিন।সিরিয়াস কিছু হলো?ঋতবানের ফাইলগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মন হাঁকপাঁক করতে শুরু করল তার এবার।ফাইলগুলোর অনেকটা জুড়ে শুধুই সমরজিত দলুই। শুধু একমাসের পঞ্চাশ হাজার টাকা নয়।প্রতি দুতিনমাস অন্তরই তার ব্যাঙ্ক কোনও নথি বা ক্রেডেনশিয়াল ছাড়াই এই লোকটাকে লোন দিয়ে গেছে।লোন স্যাংশান করেছে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অখিলেশ।কিন্তু কেন? বিকেল হতেই ফাইল গুছিয়ে তরুলতা তার গায়ে লেপ্টে থাকা সকালের অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলল।বাইবেলের ওল্ভ টেস্টামেন্টের ব্যাবেল টাওয়ারের কথা মনে পড়ে গেল তার।সেখানে একত্রিত হতে থাকা মানুষের একাত্ম স্বয়ং ঈশ্বরকেও সন্দিহান করে তুলেছিল।তুলেছিল বলেই তিনি ভীত হলেন।মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে তার মধ্যে বপন করলেন কৃষ্টির ভেদ,ভাষার ভেদ।আর ভিতরে গেঁথে দিলেন অপরাধবোধ!এই অপরাধবোধ তো আসলে সিস্টেমের চাপিয়ে দেওয়া একটা কৌশল।তরুলতা এই সিস্টেম মানে না।তার কাছে চিরকাল ভালবাসাই সবচেয়ে বড় ব্যাবেল টাওয়ার।ব্যাঙ্কের দারোয়ানটি একপাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল।তরুলতার একটু ইতস্তত লাগছিল।এমন ইতস্তত তার লাগেনি বহুদিন।তবু সে সেটুকু ঝেড়ে ফেলে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল অখিলেশের কথা।দারোয়ানটি কিছু জানে না তেমন।এবার কী করবে সে?একবার কী তার যাওয়া উচিত?বেলদার ব্যাঙ্কের থেকে অখিলেশের বাড়ি পায়ে হেঁটে পনেরো মিনিট।বাড়ির নির্দেশিকা সে নিয়ে নিল দারোয়ানটির কাছ থেকে।সন্ধ্যা হতে এখনও ঘন্টাখানেক।নির্দেশমতো সে অখিলেশের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। লালমাটির দেশে সবকিছুতেই কেমন লালিমা মাখানো।মেইন রাস্তার থেকে বাঁদিকে নেমে যেতে গিয়ে একঝলক তরুলতা দেখতে পেল এক বাগদি বৌকে।কয়েকদিন আগেই বৌটি তার ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট খুলেছে।সেই তো ফর্ম ভর্তি করে দিয়েছিল।তরুলতাকে দেখে সে মৃদু হাসলো।তরুও তার প্রত্যুত্তরে হেসে এগিয়ে গেল।মনে মনে ভাবলো,লালমাটির দেশে বাগদি বৌয়ের শাড়ির রঙ লালডুড়ে পাড়।ঠিক যেন নীলপর্বতের কামাক্ষামা।বাঁদিকের রাস্তা বেশ খানিকটা গেলে একটা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র।তারপর কৃষিহাটের অফিস।তার পাশেই অখিলেশের ঘর!বুকের ভিতর একটা চিনচিন উত্তেজনা হচ্ছে তার!কী বলবে সে?কেন এসেছে আজ?ভালোবাসা?এই ভাবে এতো ঝটপটি ভালোবাসা হয় নাকি!এমন চিনচিন করেছিল সেদিনও যে বছর সে আর শুভব্রত আসাম বেড়াতে গিয়েছিল।শুভব্রত সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল।কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।জ্বর নামতেই চায় না।শেষমেশ লোকাল ডাক্তার দেখে বলল হাসপাতালে ভর্তি করতে।সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। আসামের অচেনা পরিবেশে শুভব্রতকে হাসপাতালে রেখে একা একা হোটেলে ফেরবার সময় তার বুকের ভিতর প্রথম এইরকম চিনচিন করে উঠেছিল। কিন্তু অখিলেশের বাড়ির সামনে গিয়ে হতাশ হল তরুলতা।তার সাদা ডিজায়ার গাড়ি সেখানে নেই।দরজায় তালা দেওয়া।ফোন সুইচ অফ।অখিলেশ বাড়ি নেই!কোথায় গেল?তার কি এটুকু জানবার অধিকারও ছিল না।সে কী শুধুই প্রজাপতিশরীরের দশটি গ্রন্থির শেষ তিনটির সমাবেশ!ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির দিকে ফিরে চলল তরুলতা।অপরাধবোধটা পেরিয়ে গেলেই মানুষ অনেক অসাধ্যসাধন করতে পারে।আসলে অপরাধবোধ একটা মেন্টাল কনস্ট্রাক্ট।সেটা ভেঙে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তরুলতা দেখল কিছুতেই সে সেই কনস্ট্রাক্টটাকে ভাঙতে পারছে না।ট্রেকার চড়ে নিজের বাড়ি ফিরবার পথে আরেকবার শুভব্রতর পাঠানো মেসেজটা দেখলো সে।'কেমন আছো?'কেমন আছে সে?কী লেখা উচিত এর উত্তরে এই মুহূর্তে সে তা জানে না।মেইন গেটে ট্রেকার থেকে নেমে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তরুলতা।তার দরজার পাশে অখিলেশের সাদা গাড়িটা দাঁড়িয়ে। আর সিঁড়িতো দুই হাত চেপে মুখ গুঁজে বসে আছে অখিলেশ।তরুলতার শব্দে সে সচেতনভাবে উঠে দাঁড়াল।সে দেখল অখিলেশের চোখদুটো অশ্রুসজল লাল।লালমাটির দেশের মতোই। -কী ব্যাপার?সারাদিন জানালে না।আমি তোমার বাড়ি গিয়েছিলাম। কোথায় গিয়েছিলে... অখিলেশ কিছু বলে না।শুধু অস্ফূট কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আসে যেন। -ভেতরে চলো। সব বলছি।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register