Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৯)

বিন্দু ডট কম 

একটা রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভব্রত।তার ঝকঝকে মার্বেল সিঁড়ি উঠে গেছে সদর দরজার দিকে।তার দুই পাশে সবুজ উর্দি পরা দুই দ্বাররক্ষী।তারা হাত পেতে তার কাছে আইডি দেখতে চাইলো।শুভব্রতর পকেটে আইডি নেই।তার পত্রিকার কোনও ভিজিটিং কার্ড সে এতোদিনেও বানাতে পারেনি।তাহলে সে কীকরে ঢুকবে ভিতরে?তার যে এই প্রবেশ করাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়।তার পত্রিকার জন্য। তার প্রকাশপথ মসৃণ করে দেবে এই রাজবাড়ির রাজানুগ্রহ।দ্বাররক্ষীরা অনড়।শুভব্রত হঠাৎ দেখল তার দুহাতের নখ ধারালো হয়ে উঠছে।পেশিবহুল হয়ে উঠছে দুই হাত।তার পিঠের ওপর গজিয়ে উঠছে ঈগলপাখির ডানা।দাঁতগুলো হয়ে উঠছে শ্বাপদের মতো।তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বজ্রনির্ঘোষ।দুটি প্রহরী শুভব্রতর এই পরিবর্তন দেখে ভয়ে সরে গেল।শুভব্রত তাদের ধাক্কা মেরে আরো সরিয়ে দরজা খুলে দিল এক ঝটকায়।তারপর লাল আগুনমাখা চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,এটাই আমার আইডি।....
হো হো করে হাসছে মৈনাক।হাসতে হাসতে ফোনের ওপারে শুভব্রত স্পষ্ট শুনতে পারছে মৈনাক মন্ডল দম টেনে নিচ্ছে। সামান্য খুকখুকে কাশি।তারপর আবার অট্টহাসি।হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে যেন সে। -শুভ।তুই সিরিয়াসলি দেখলি এইসব? -হ্যাঁ। এতে এতো মজা পাবার কী আছে?জানি আমরা ওদের কাছে একটা প্রজাপতির মতো।ঝাপটে দিলেই মরে যাবো।কিন্তু আমাদের ইচ্ছাশক্তিটা... -ইচ্ছাশক্তি??আবার হাসতে থাকে মৈনাক।হাসতে হাসতে এবার ভয়ানক কাশি তাকে জাপটে ধরে।শ্বাস রোধ হয়ে আসে।ফোনের এপারে শুভব্রত এবার ভয় পেয়ে যায়। মৈনাক ভালো নেই।ও ওষুধ খাচ্ছে না।সে নিশ্চিত।যে খবর ভেসেভেসে পেয়েছিল সে,সেই খবরটা ভুল নয়।মৈনাকের টিবি হয়েছে।রোজ দলাদলা রক্ত পড়ে কাশির সঙ্গে।তার সঙ্গে অনিয়মিত ওষুধ খাওয়া। মৈনাকের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে।শুভব্রত বেশ বুঝতে পারে।কিন্তু সেই শ্বাসরোধ সামলে নিয়ে আবার মৈনাক বলে ওঠে। -তোর সত্যিই মনে হয় এখনও আমাদের সেই বাঘনখের জোর আছে? -আছেই তো।তোর 'কর্ণ' বের করবি না আর?কতো বছর হয়ে গেল শেষ সংখ্যা বের করলি।তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে গেলি।আর বের করছিস না কেন? -কী বের করবো?ম্যাটার কৈ? -কেন?সাক্ষাৎকার নিবি। -কার নেব সাক্ষাৎকার?তুই বলে দে। -কেন?এতোদিন তো আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করিসনি কখনো!আজ হঠাৎ। -করছি কারণ কারোকে পাচ্ছি না।একটা মেরুদণ্ড খুঁজছি জানিস।নেই।সব বিক্রি হয়ে গেছে।সবাই বাঘনখ ট্রিম করে নিচ্ছে জানিস।তার নেলপলিশ পরে নিচ্ছে।এর নাম কি দিয়েছে জানিস।নেইল আর্ট... আবার কাশির শব্দ ভেসে আসে ফোনের ওপার থেকে।শ্বাসটান শোনা যায়। শুভব্রত ভাবতে থাকে।তার কি একবার যাওয়া উচিত?মৈনাকের তো কেউ নেই।এক লতায়পাতায় ভাই ছিল।সেও বোধহয় পালিয়েছে।মৈনাক আবার সামলে ওঠে। -ওষুধ খাচ্ছিস না কেন তুই? -ওষুধ নেই রে।এই অসুখের ওষুধ নেই। -বাজে ফিলোজফি কপচানো ছাড় মৈনাক।দর্শন দিয়ে মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবাকিউলোসিস তাড়ানো যায় না।তোর নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা আমাকে বল তো।আমি যাবো... -না রে ।তুই আসিস না।আমি ঠিক হয়ে যাবো।চাপ নেই। -তুই এভাবে মরে যাবি।আমাদির বাঁচতে হবে মৈনাক। -কেন? -কেন মানে? আবার ছোট্ট শিশুর মতো হেসে ওঠে মৈনাক। -তোর মনে হয় আমরা কেউ বেঁচে আছি?আমরা তো সেই কবেই মরে ভূত হয়ে গেছি।তোর দোয়াব,আমার কর্ণ।ওদের কারো রক্ত মাংস নেই।সব অশরীরী রে।হাওয়া।
ফোন কেটে দিল মৈনাক।শুভব্রতর সামনে বড় বড় থামওয়ালা এক রাজবাড়ি।শুভব্রত দেখলো তার দোতলার বারান্দা থেকে লম্বা পোস্টার নেমে এসেছে নিচে।রাজবাড়ির পত্রিকা বের হবে আজ।ঝকঝকে প্রচ্ছদ। বাঙালির বটতলা।সেই বটতলার প্রচ্ছদে বাঙালিবাবু হাঁসুই দিয়ে কেটে ফেলছেন তার ঘরনীর গলা।চারপাশে সৌখিন লিনো করে ফ্রেমিং করা।শুভব্রত দেখলো তার দুই হাতের নখগুলোতে কে যেন গোলাপি বেগুনি রঙ লাগিয়ে দিয়েছে।শুভব্রত সেটা তোলবার চেষ্টা করলো অনেক।পারলো না।পাশে ছোট ট্যাপ কলে গঙ্গার জল বয়ে চলেছে অবলীলায়। শুভব্রত সেখানে তার দুই হাত পেতে দিল।নাহ।উঠছে না কিছুতেই। কী করবে সে এখন?তার বাঘনখ ছাড়া, ঈগলের ডানা ছাড়া তাকে কে ঢুকতে দেবে অন্দরমহলে?প্রচ্ছদে গলা কাটা সৌখিন বৌটির মুখ অবিকল তরুলতার মতো।যেন ঠিক আগের মুহূর্তেই ফোনে তাকে ভর্ৎসনা করেছে।"খবর রাখো আমার?টু হেল উইথ ইয়োর পত্রিকা। "অসহায়ের মতো শুভব্রত তার নেলপালিশ লাগানো হাতগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল সিঁড়ি গুলোর দিকে।প্রচ্ছদটা নড়ছে হাওয়ায়। সে কী বলতে চাইছে তাকে?মৈনাক অনেক বছর আগে কফিহাউজে একটা চটি বই এনেছিল জোগাড় করে।তারপর তার আর বিমলেন্দুবাবুর সামনে দুলে দুলে সবাইকে শুনিয়ে পড়েছিল। "বিদ্রোহ করবার সময় এসে গেছে ছোট পত্রিকাদের।কাগজের দাম দিনদিন আকাশচুম্বি ,ছাপার খরচও ক্রমবর্ধমান। অথচ ভালো কাগজ,ঝকঝকে ছাপা না হলে পাঠক বিমুখ হন।তিন রঙে,দামী কাগজে মলাটকে সজ্জিত না করলে,ক্রেতা হাতে তুলে পত্রিকাটি দেখেন না।...এই কি আধুনিক কবিতাপত্রিকার বিধিলিপি?" এরপরের অক্ষরগুলো শুভব্রত জানে।তার গরীবের দিশ।ততোধিক গরীব তার কবিতাপাঠক।এই সৌখিন রমনীয়তার প্রতি তাদের এই দুর্বলতা কেন?তারা আজ থেকে সৌখিন মলাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।সম্পাদকীয়বিহীন একটি পাতলা পত্রিকা। হেমন্ত ১৩৭৮।পরমাসুন্দর সে পত্রিকার নামও যে পরমা!আগুন ঝড়ছে তার প্রতিটি পাতা থেকে। শুভব্রত দেখলো তার নখের রঙ পালটে ফ্লুরেসেন্ট হলুদ হয়ে যাচ্ছে। সেই রঙ দেখা মাত্র রক্ষীরা তাকে ভিতরে যেতে দিল।পরিচয়পত্র লাগলো না।বাঘনখ লাগলো না।মৈনাকের কাশির আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।ভিতরের মহলে অনেক আলো।সুসজ্জিত সোফায় বসে আছেন ঝলমল পোষাকপরিহিত মানুষজন।সামনে মঞ্চ। সেখানে গান হচ্ছে। নাচ হচ্ছে। এক স্বল্পবসনার কাঁধ থেকে হুট করে স্লিপ খেয়ে পড়ে গেল তার ব্লাউজের স্ট্যাপ।স্পটলাইটে তার হঠাৎ উন্মোচিত বামদিকের স্তন দেখা যাচ্ছে।সেই শুভ্র পদ্মের মতো স্তনের গোলাপি বাদামি বৃন্তকে কভার করতে ছুটে গেল একদল ফোটোগ্রাফার। ওয়ারড্রোব ম্যালফাংশান।স্বল্পবসনা মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজের আঁচল।কিন্তু ততক্ষণে সেই ছবি বিখ্যাত হয়ে বিলি হয়ে গেছে পৃথিবীর দরবারে দরবারে।শুভব্রত দেখলো সে ততক্ষণে সরীসৃপ হয়ে গেছে।সেও হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই দিকে।তার দুইচোখে সম্মোহন।তার লম্বা জিহ্বা।এক বিদ্রোহী মাঝবয়সিনী মঞ্চে উঠে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানালেন।সবাই হাততালি দিচ্ছে।স্বল্পবসনাও।মঞ্চের দিকে যেতে যেতে শুভব্রত শুনতে পেল সোফায় বসা দুই বিশিষ্ট মানুষ ফিসফিস করে বলছে,"সব জানা আছে শালা।ফাঙশান হিট করবার কৌশল।পুরো স্ক্রিপ্টেট।"
মঞ্চের সিঁড়ি সামনে।শুভব্রত কী উঠবে সেখানে?ভাবতে ভাবতেই সে হঠাৎ দেখলো তার হাত ধরে পিছনে টানছে কেউ।কিছুতেই সেই হাত সে ছাড়াতে পারছে না।মুখ ফিরিয়ে শুভব্রত দেখল তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন পশুপতিনাথ প্রেসের কর্ণধার অচিন্ত্যবাবু।ধমকের সুরে তিনি বলে উঠলেন। -কোথায় যাচ্ছো শুভব্রত?নেমে এসো... শুভব্রত কথা বলতে পারে না।হিসহিস করে আঙুল দিয়ে মঞ্চের দিকে নির্দেশ করে।তাকে যে যেতে হবে। -না।তুমি যাবে না।আমি যেতে দেব না। কিন্তু কেন?সবাই তো যাচ্ছে! -সবাই গেলেও তুমি যাবে না।তুমি প্রজাপতি হতে পারো।কিন্তু তোমার নাম 'মোনার্ক'।তোমার হুলে বিষ আছে।তুমি ওদের মতো নও।নেবে এসো শুভব্রত। নেবে এসো।
শুভব্রত দেখলো সে আবার আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে রমানাথ মুখার্জি স্ট্রিটের মোড়ে।তার সামনে কাঁকড়ার তট।সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে সেখানে।চাঁদিপুরের তট।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register