- 36
- 0
অন্ধকারের উৎস হতে - পনেরো
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের বদলে স্কুল খুলতে খুলতে পরের শিক্ষাবর্ষ হয়ে গেল। শিক্ষাবর্ষের একেবারে শেষদিকে রাজ্যের বিদ্যালয়গুলো খোলার একটা প্রচেষ্টা শুরু হলেও কার্যক্ষেত্র সেটা সম্ভব হ'ল না। যদিও বিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন সময়ে অনন্যাদের প্রতিমাসেই কমপক্ষে পাঁচ ছ'বার করে স্কুলে যেতে হত। কখনো মিড-ডে-মিল, কখনো অ্যাক্টিভিটি টাস্কের খাতা দেখা, কিংবা স্কুলের অন্য যে কোনো দরকারেই তাদের ছুটে যেতে হয়েছে প্রিয় বিদ্যালয়ে। সেইসঙ্গে অনলাইনে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া তো আছেই। উচ্চমাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষাও এই বছর আর হয়নি, শিক্ষাদপ্তর সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কটি পরীক্ষা ইতিপূর্বে হয়েছে সেগুলির মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ নম্বরটিকেই ছাত্রছাত্রীদের বাকি তিনটি পরীক্ষার নম্বর হিসাবে গ্রহণ করা হবে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টও যথারীতি ঠিকঠাক সময়েই প্রকাশিত হ'ল। একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণীর ভর্তি থেকে সরকারী বই তাদের হাতে তুলে দেওয়াসহ সরকারী সিদ্ধান্ত অনুসারে স্কুলের বাকি সমস্ত কাজকর্ম ঠিকঠাক চললেও সমাজে একশ্রেণীর মানুষদের মনে হতে লাগল, শিক্ষক শিক্ষাকর্মী সহ বিদ্যালয়ের সকল কর্মীরা বসে বসে বেতন পাচ্ছেন। এই নিয়ে রাস্তাঘাটে কম টিটকিরি খেতে হ'ল না অনন্যাদের। কিন্তু অনন্যা তার ব্যক্তিগত সমস্যায় এতটাই জর্জরিত যে সেই টিপ্পনীগুলো সেইসময় তার মাথার ওপর দিয়ে প্রায় উড়ে গেল বলা যেতে পারে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুল খুলল বটে, কিন্তু অবস্থার অস্বাভাবিকত্ব তখনও থেকেই গেল। করোনাকেও নির্মূল করা গেল না, যেহেতু তাকে সঙ্গে নিয়েই রাজ্যের স্কুলগুলো খুলল তাই সঙ্গে এলো গাদা গুচ্ছির নির্দেশিকা। সোশ্যাল ডিসটেন্সসিং মেনে কীভাবে পঠন-পাঠন শুরু করা যায় তার তাত্ত্বিক নির্দেশাবলীতেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর মাথায় হাত, আর সেই নির্দেশাবলীকে বাস্তবে রূপদান করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেতে হ'ল না এমন বিদ্যালয় রাজ্যে বিরল। কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা। যদিও এই অবস্থায় বহু ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়মুখী হ'ল না। কিন্তু যারা এলো, তাদের ঠিকঠাক দূরত্ব বজায় রেখে স্কুল পরিচালনা করতে নাজেহাল হয়ে গেলেন প্রতিটা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাশয় থেকে সহশিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীবৃন্দ প্রত্যেককেই। সেলিমপুর এম এস হাই সেকেন্ডারি স্কুলেও এর ব্যতিক্রম হ'ল না। শুধু হ'ল পঠন-পাঠন।
ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য না হয় কোনও রকমে কিছু একটা বন্দোবস্ত করা হ'ল, কিন্তু স্টাফরুমে কী করে সোশ্যাল ডিসটেন্সসিং বজায় রাখা সম্ভব হবে? সকলে তো আর এক জায়গা থেকে আসেন না। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই বেশ দূরে থাকেন। তাঁরা ট্রেনে বাসে কেউ বা নদী পেরিয়েও যাতাযাত করেন। ফলত তাঁরা বিদ্যালয়ে আসতে যেতে বহু মানুষের সংস্পর্শে আসছেন। এমতাবস্থায় একটা স্কুলের পক্ষে তো আর দশটা স্টাফরুম বানানো সম্ভব নয়। অথচ একই স্টাফরুমে এতদিনের মতো পাশাপাশি কিংবা প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে আর বসা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে সেটা একদম উচিতও নয়। প্রধান শিক্ষকের তৎপরতায় আপদকালীন দুটো স্টাফরুম তৈরী করে আপাতত একটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হ'ল।
অনন্যা আর জয়ি একসঙ্গেই স্কুলে আসা যাওয়া করতে লাগল। অনন্যা যে এখন জয়ির বাড়িতে আছে সেটা স্কুলের কেউ জানত না। জানার প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু অনন্যার কিডন্যাপিংয়ের ব্যাপারটা স্কুলের সবারই জানা। এতদিন পরে তাকে সামনে পেয়ে অনেকেই সেই কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। শিক্ষিকাদের মধ্যেই এই ব্যাপারে জানার কৌতুহল বেশি দেখা গেল। অবশ্য কয়েকজন নবীন প্রবীন মাস্টার মশাইও সেই আলোচনায় আগ্রহ সহকারে যোগ দিলেন। অনন্যা যতটা সম্ভব কম কথায় তাদের কৌতুহল দমনের চেষ্টা চালাতে লাগল। এতে ফল হ'ল বিপরীত। অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা ঠিকমতো পরিতৃপ্ত হ'ল না। উপরন্তু আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। অনন্যা সব বুঝেও না বোঝার ভান করে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল। এই ব্যাপারে জয়িতা সেন তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করল। কিন্তু মানুষের মন চিরকালই জ্ঞানপিপাসার জন্য অধীর কৌতুহলী , আর সেই কৌতুহলে যদি টক, ঝাল, মিষ্টির মশলা থাকে তাহলে আগ্রহ অনেকটাই বেড়ে যায়। অনন্যা একজন সুন্দরী, পূর্ণ যুবতী। এতদিন তাকে অন্যত্র অপহরণ করে রাখা হ'ল, সেই সময়কালে তাকে কেউ কিছু করল কি না, এটা জানাটা আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটা জনগণ নিজের পৈতৃক সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকার সূত্রেই অর্জন করে ফেলে। যদি সেই পথে তারা বিন্দুমাত্র বাঁধা পায়, তাহলে তারা তাদের উর্বর মস্তিষ্ক খাটাতে কিছুমাত্র পিছপা হয় না। সুতরাং সেলিমপুর এম এস হাই সেকেন্ডারীর স্টাফরুম যে অন্তত একটুখানি উত্তাল হবে সেটা আর আলাদা কী! এই স্টাফরুমের মানুষজন পেশাগত সূত্রে যাই হোন না কেন, এঁরা তো আর অন্য গ্রহের জীব নন। তারাও বাঙালি। আর বেশিরভাগ বাঙালি মাত্রেই যে পরচর্চা পরনিন্দাতে একটু বেশ উৎসুক সেটাও কারোর অজানা নয়। বরং স্বাভাবিক। অনন্যার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটতে বেশি সময় নিল না। সামনে তার পরম হিতাকাঙ্ক্ষী কয়েকজন সহকর্মী তার অপহরণের ব্যাপারে নতুন নতুন থিয়োরি আড়ালে আবডালে রটাতে লাগলেন। অথচ অনন্যার সামনে তাদের আচরণ দেখে এইসব কাণ্ড তাদের মস্তিষ্ক প্রসূত এটা বিশ্বাস করা তো দূরের থাক, ভাবাও অবিশ্বাস্য।
বেশ কিছুদিন স্কুল খুলে গিয়েছে। জয়িতা সেন আজ অফ পিরিয়ডে স্টাফরুমে বসে একমনে নিজের কাজ করছিলেন, পাশের টেবিল থেকে সীমাদি উঠে এসে জয়িতার সামনের চেয়ারটিতে বসলেন। তারপর একথা সেকথা বলতে বলতে সটান জিজ্ঞাসা করলেন, 'হ্যাঁ রে জয়ি, তা, তোর সঙ্গে তো অনুর খুব ভালো সম্পর্ক, যে ছেলেটার সঙ্গে অনু পালিয়েছিল, তার সঙ্গে ওর কতদিনের রিলেশন? কিছু জানিস? তোকে কিছু বলেনি?'
জয়িতা সেন আকাশ থেকে পড়ে বলল, 'রিলেশন মানে?'
-'মানে! ওই সেই রকমই তো শুনলাম!'
-'কী শুনেছ তুমি? কোথা থেকে শুনেছ?'
-'নাঃ! বাবা, আমি কিছু শুনিনি, আমি কিছু জানি না। বয়স হয়েছে, কী বলতে কী যে কখন বলি! ধ্যূর ছাই! নাঃ! রে, উঠি এখন। তুই কাজ কর। আমার আবার পরের পিরিয়ডে নাইন বি-তে ক্লাস আছে। যা সব নচ্ছার ছেলেপিলে! লেখাপড়ার নাম নেই! প্রতিদিন স্কুলে আসা চাই।' বলতে বলতে ইতিহাসের শিক্ষিকা সীমা দাস উঠে গেলেন।
জয়িতা সেন তার জলের বোতলটা থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে আবার নিজের কাজে মন বসাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুডটা অফ হয়ে গেল। ঠিক হতে এখন বেশ কিছুটা সময় লাগবে।
দিন কয়েক পর, অন্য আর এক শিক্ষিকা নিজের কৌতুহলকে দমন করতে না পেরে সরাসরি অনন্যাকেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন। তখন টিফিন পিরিয়ড। অনন্যা সবে টিফিন করে উঠেছে। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নিজের জায়গায় বসে মোবাইলটা হাতে নিয়েছে। এমন সময় ওই শিক্ষিকা অনন্যার কাছে এসে বলল, 'অ্যাই অনুদি, কিছুই তো বললে না!'
অনন্যা অবাক হয়ে বলল, 'কি বলব?'
-'আরে! ওই যে, তোমাকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে গেল, তারপর তুমি কি করে আবার বেরিয়ে আসতে পারলে?'
-'বলেছি তো। পুলিশ গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে এনেছিল।'
-'আর ছেলেটার কি হ'ল?'
-'পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল।'
-'করেছিল! মানে? এখন ছেড়ে দিয়েছে নাকি?'
-'হ্যাঁ। সেই রকমই শুনেছিলাম।'
-'তুমি কোনও স্টেপস নেবে না?'
-'নেবো। তবে ওদের বিশাল পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স আছে। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে।'
-' ওহ! আচ্ছা। বলছিলাম কী অনুদি... আচ্ছা না থাক।'
-'থাকবে কেন? কি জানতে চাস বল? আর কি জানার আছে বল?'
-'মানে কী...অন্যভাবে নিও না। আচ্ছা, ছেলেটা তোমাকে কিছু করেছিল?'
অনন্যার থেকে মেয়েটি বছরখানিকের ছোটো। বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক থাকলেও অনন্যা জানত মেয়েটা বেশ মুখ আলগা টাইপের। কিন্তু এতোটা বাচাল টাইপের সেই পরিচয় আগে পায়নি। একটু গম্ভীর হয়েই সে জবাব দিল, 'না। আর কিছু জানতে চাস?'
-'এমা! তুমি রাগ করলে! আমি কিন্তু ক্যাজুয়ালি কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম।'
-' না রে, মৌ! রাগ কেন করব? রাগটাগ কিছু করিনি।'
-'যাক বাবা! বাঁচালে।'
মৌকে একটু এড়ানোর জন্য অনন্যা মোবাইলটা রেখে তার লকার থেকে একটা বই বের করে পড়া শুরু করে দিল। কিন্তু মৌও নাছোড়বান্দা। আবার বলল, 'ও অনুদি, ছেলেটাকে তুমি আগে থেকেই চিনতে বলো?'
-'সেই অর্থে পরিচিত নয়।'
-'শুনলাম সৌমাল্য নামের ওই ছেলেটা নাকি খুব হ্যান্ডসাম। দেখতে শুনতেও নাকি ঝাক্কাস।'
-'কে জানে! হবে হয়ত।'
-'আচ্ছা। বলছি কী যে, একদিনও কিছু হয়নি গো? মানে ওই ছেলেটা জোরজবরদস্তি তোমাকে কিছু করেনি? হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও...'
এবার অনন্যার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল। কিছুটা চিৎকার করেই বলল, 'না, না। বারবার বলছি তো তোকে। একই কথা একশোবার বলে বিরক্ত করছিস কেন?' বলার পরেই অনন্যার খেয়াল হ'ল স্টাফরুমে অনেকগুলো চোখ তার ওপর অপার কৌতুহলে নিবদ্ধ।
মাথাটা গরম হয়ে গেল অনন্যার। কাজটাতে আর মন বসাতে পারল না। পরের পিরিয়ডও তার অফ। তারপর টানা দুটো পিরিয়ড রয়েছে। অথচ ঘরটাতে বসে থাকতে এখন তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।অনন্যা বইপত্র তুলে লাইব্ররির দিকে হাঁটা দিল।
0 Comments.