- 10
- 0
অন্ধকারের উৎস হতে - চোদ্দ
আজকাল সৌমাল্য বাড়িতেও কারোর সঙ্গে বিশেষ কোনও কথাবার্তা বলে না। এমন কী রহমত চাচার সঙ্গেও না। সারাদিন একমনে ঘরের মধ্যে বসে থাকে, কিংবা কিছুক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়ায়। পুলিশ যেদিন ওকে আর অনন্যাকে থানায় নিয়ে গেল, সেদিন বিকেলের মধ্যেই তার বাবা তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে, তাঁর যাদবপুরের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। সৌমাল্য ওখানে একদিনের বেশি টিকতে পারেনি। পরের দিনই তার পুরনো আস্তানায় ফিরে আসে। বাবা-মার কাছে সে কখনই স্বাভাবিক হতে পারেনি, আজও পারল না। শুধু থানা থেকে বাড়ি ফিরে বাবাকে বলেছিল, 'আমাকে ছাড়িয়ে আনার কী দরকার ছিল? আমি তো মুক্তি চাইনি। শাস্তি চেয়েছিলাম। আমার কৃতকর্মের শাস্তি আমার পাওয়া উচিত।'
-'আমার একমাত্র সন্তান হয়ে তুমি হাজতবাস করবে, এটা আমার সামাজিক সম্মানকে বাড়িয়ে তুলত বলে তোমার মনে হচ্ছে?'
সৌমাল্য কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর বলল, 'বাপ-ছেলের এই অভিনয় তো বহু বছর ধরেই চলছে বাবা। এবার এগুলোও বন্ধ হওয়া দরকার।'
-'হোয়াট রাবিশ! কী বলতে চাও তুমি? অভিনয় মানে? ননসেন্সের মতো কথা বলো না। আমার সময়ের দাম আছে।'
-'সেই দাম চুকাতে তো আমার সারা শৈশব-কৈশোর জলাঞ্জলি দিয়েছি।'
-'জলাঞ্জলি! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জলাঞ্জলি? আমি তোমার দায়ভার নিই নি? তোমাকে পালন করিনি? অভাব কী জিনিস, আমি কখনও তোমায় বুঝতে দিয়েছি? আজও তুমি একপয়সা রোজগার না করলেও তোমার কোনও কিছুতেই কোনও অভাব হবে না। ইন ফ্যাক্ট, আমার যা কিছু আমি রেখে যাব, সবই তো তোমার; সেগুলো ঠিক মতো ইউজ করলে, সারা জীবন তোমার এক কানা কড়ি ইনকাম করারও দরকার হবে না। সারাজীবন তুমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে খেতে পারবে। এর পরেও জলাঞ্জলির কথা আসে কী করে? তোমার বাবার মতো তোমার কটা বন্ধুর বাবা নিজের সন্তানের জন্য এমন সুন্দর বন্দোবস্ত করে রেখেছেন? খোঁজ নিও। তবুও তারা তাদের বাবাকে এসব বলবে না। বাপ-ছেলের রিলেশন তাদের কাছে কখনই অভিনয় বলে মনে হবে না। আসলে প্রাচুর্যই তোমার কাল হয়েছে!'
-'কে চেয়েছে প্রাচুর্য?'
-'ফোকোটে পেলে ওই রকমই মনে হয়। তোমার কোনও বন্ধুবান্ধব এসব পেলে তোমার মতো ভাবত না। জীবন কোনও ফ্যান্টাসি নয়, এটা কঠোরভাবে রিয়ালিটি। সেটা ফিল করতে শেখো।'
-'তুমি তোমার প্রাচুর্য নিয়ে থাকো বাবা। আমার কিছু লাগবে না। আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি রহমত চাচার কাছে চলে যাচ্ছি।'
-'বেশ। তুমি যদি সেখানে ভালো থাকো, তাহলে সেখানেই যাও। কিন্তু মনে রেখো, এমন কিছু করো না যাতে আবার এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটতে পারে। পরিবারের মানসম্মান নিয়ে খেলার অধিকার তোমার নেই। এই পরিবারকে অস্বীকার করে বেঁচে থাকাও তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের শেকড়কে অস্বীকার করে বাঁচা যায় না, এটা মনে রেখো।'
-'আমি এই পরিবারের সদস্য বলে নিজেকে মনে করি না।'
-'তোমার মনে করা, না করাতে কিছু যাই আসে না। সমাজ তোমাকে আমার ছেলে হিসেবেই চেনে। আগে নিজের একটা পরিচিতি গড়ে তোলো, তারপর তোমার এইসব বড় বড় কথা তখন শুনব। এখন যাও।'
সৌমাল্য চলে এসেছিল, শুধু বাবার ঘর থেকেই নয়, ওই বাড়ি থেকেও চলে এসেছিল। আসার সময় তার মা তাকে দু একবার আটকানোর চেষ্টা করলেও দিনের পর দিন অযত্নে লালিত মরচে ধরা ভঙ্গুরপ্রায় লোহার শিকলের জোরই বা কী থাকে! সামান্য চাপাচাপিতেই সেই শিকল গুড়িয়ে যায়; আর মনের বন্ধন যখন আলগা হয়ে যায়, তখন সেখানেও জোরাজোরি চলে না। এক্ষেত্রেও চলল না। সৌমাল্য ফিরে এলো তার পুরনো আস্তানায়। তাদের বাগান বাড়িটিতে। ঠিক তার দিন দু'য়েক পরেই রাজ্যজুড়ে আম্ফানের বিধ্বংসী ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিল পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল।
এখন রহমত চাচা প্রায় প্রায় দোতলায় ওঠে। শুধু ওঠেই না, ইদানিং সৌমাল্যর ঘরে ঢোকার প্রবণতাও তার অনেকটাই বেড়েছে। সৌমাল্য একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। এই মানুষটিকে ঘিরে তার জীবনের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তার জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী এই রহমত চাচা।। যে সান্নিধ্য সে জীবনে বাবা-মার কাছে কখনই পায়নি, সেটা রহমত চাচার কাছে পেয়েছে। বাল্যের সমস্ত আবদারের একমাত্র সঙ্গীকে তাই অসুবিধা হলেও মুখে কিছু বলতে পারে না সৌমাল্য।
অনেকদিন পর, সৌমাল্য আজ কিছুক্ষণের জন্য অনন্যা যে ঘরে থাকত সেই ঘরে ঢুকেছিল। অনন্যাকে এখানে আনার পর তার জন্য অনেক পোশাক, কসমেটিক, মেয়েদের নিত্য ব্যবহার্য বহু জিনিসপত্র সৌমাল্য এনে দিয়েছিল। প্রথম কয়েকদিন অনন্যা সেইসব ছুঁয়েও দেখেনি। পরে কিছুটা বাধ্য হয়েই সেগুলোর মধ্যে থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি পোশাক-পরিচ্ছদ সে আস্তে আস্তে ব্যবহার করা শুরু করে। অনন্যা চলে যাবার সময় এগুলো একটা ব্যাগে গুছিয়ে রেখে দিয়ে, শুধু নিজের নিয়ে আসা সাইড ব্যাগটা সঙ্গে করে বেরিয়ে এসেছিল। পুলিশের গাড়ি যখন তাদের নিয়ে রওনা দিল, তখন গাড়িতে ওঠার আগে অনন্যাকে তার মোবাইলটা ফেরত দিয়ে দিয়েছিল সৌমাল্য। এই বাড়িতে অনন্যার সঙ্গে কাটানো সময়গুলোকে আঁকড়ে ধরে সেই স্মৃতিরোমন্থন করেই সম্পূর্ণ গৃহবন্দী হয়ে ইদানিং সৌমাল্যর দিন কাটে।
-'চুপচাপ ঘরে না বসে থেকে একটু তো ছাদেও ঘুরে আসতে পারো বাবুসোনা। আমি চা করে এনে দিচ্ছি। তুমি ছাদে যাও।' রহমত চাচা বললেন।
সৌমাল্য কোনও জবাব দিল না। ছাদেও গেল না। রহমত চাচা একটু পরে ঘরেই চা এনে দিল। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাল সৌমাল্য। সিগারেটের নেশা তার আগে ছিল না। মাত্র সপ্তাহ খানিক হ'ল ধরেছে। দিনে অন্তত দু'প্যাকেট তো মিনিমাম লাগছেই। নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া করতে গিয়ে এইটুকু নেশাচ্ছন্নতাকে বড় উপভোগ করে সে।
অনন্যা তার শাস্তি চেয়েছে। আগের দিন রাতে যে মেয়ে তাকে নিয়ে বিছানায় প্রায় ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, পরের দিন সকালে পুলিশের সামনে সেই মেয়ের চোখ মুখের ঔজ্জ্বল্য আর ঘৃণাভরা তাচ্ছিল্যের হাসিটা সৌমাল্য এখনও ভুলতে পারিনি। এতটা ঘৃণা নিয়ে কারোর সঙ্গে ওইভাবে শারীরিক সম্পর্ক করা যায়- এটা নিজের ক্ষেত্রে না ঘটলে, সৌমাল্য হয়ত জীবনে কখনও বিশ্বাসই করতে পারত না। নিজেকে আজকাল খুব বোকা লাগে তার। অনন্যা ঠিকই বলত, সত্যিই ওইভাবে কারোর ভালোবাসা পাওয়া যায় না। কিন্তু অনন্যাকে সে ভুলতে পারে না। অনন্যা ছাড়া তার জীবনটাই যেন পুরো ফাঁকা।
-'চলো বাবুসোনা। ছাদে একটু ঘুরে আসি। আমারও তো হাঁটাচলা হয় না। একটু হবে। পথে বেরলেই তো সেই লকডাউনের কথা শুনিয়ে, পুলিশ খেদিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, লাঠি নিয়ে তাড়া করছে। তাই ছাদেই একটু ঘুরে আসি চলো।' রহমত চাচা ডাক দিল।
-'না। আমি যাব না। ভালো লাগছে না। তুমি যাও।'
-'এইভাবে থাকলে তো তুমি পাগল হয়ে যাবে!'
-'কেন? কিস্যু হবে না। তুমি ছাদ থেকে ঘুরে এসো। যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।'
-'তুমি ওই দিদিমুণিকে ভোলার চেষ্টা করো এবার।'
-'আঃ! বলছি না, তুমি এখন এসো। আমি একটু একা থাকতে চাই।'
রাতের বেলা অনন্যার জামা কাপড়ের ব্যাগটা নিজের ঘরে নিয়ে এসে রাখল সৌমাল্য। তারপর ব্যাগটা খুলে একটা একটা করে অনন্যার ব্যবহার করা পোশাকগুলো খাটের ওপর নামিয়ে রাখল। প্রতিটিতে অনন্যার স্পর্শ রয়েছে। নিপাট, ভাঁজে ভাঁজে রাখা পরিস্কার ওই পোশাকগুলোতে যেন অনন্যার গায়ের একটা মিষ্টি গন্ধ অনুভব করল সৌমাল্য। রাতের গভীরতা সেগুলোকে যেন আরও মায়াবী করে তুলছে। সৌমাল্য পোশাকগুলো ব্যাগে ভরে বাইরের বাগানে বেরিয়ে এলো। তারপর পকেট থেকে লাইটারটা বের করে, ওগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের লেলিহান শিখা অনন্যার শরীরের গন্ধ-স্পর্শ মাখা পোশাকগুলোকে গোগ্রাসে গিলে ছাই করে ফেলল। সৌমাল্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, রাতের অন্ধকারে কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়াতে সেগুলো পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল। থেকে গেল সৌমাল্যের হৃদপ্রকোষ্ঠে অনন্যার যাবতীয় স্পর্শগুলো। এগুলোকে পঞ্চভূতে বিলীন করার ক্ষমতা সৌমাল্যর হয়ে উঠল না।
এইভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে! বাকি রাতটুকুও হয়ত বাড়ির পেছনের বাগানটাতে এইভাবেই কেটে যেতে পারত, কিন্তু রহমত চাচা সৌমাল্যর ঝুঁকে পড়া মাথায় হাত দিয়ে বলল, 'ঘরে চলো বাবুসোনা।'
এতক্ষণ পরে কোনও মানুষের দেখা পেয়ে সৌমাল্য হুশ ফিরে পেয়ে বলল, 'আমাকে কেউ বোঝে না কেন বলত চাচা? কী দোষ আমার? অনন্যাও বুঝল না! চলে গেল।'
-'তুমি ঘরে চলো। তোমার সব কথা আমি কাল সকালে শুনব। চলো।'
সৌমাল্যকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে রহমতউদ্দিন যখন ঘরে এনে তুলল, ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।
রাতের আকাশের সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে কোকিলেরা ডাক দিয়ে নতুন দিনের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে। অনন্তকাল ধরে প্রকৃতিতে এই দিন আর রাতের প্রভেদ মাত্র বারোঘন্টার অথচ মানুষের জীবনে এই দিন আর রাতের প্রভেদের কোনও সীমারেখা থাকে না।
ক্লান্ত সৌমাল্য আজ কাকভোরে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটা স্বপ্ন দেখল। পাহাড়ের অনেক উঁচুতে সে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে অনন্যা, কিন্তু সে কিছুতেই অনন্যাকে ছুঁতে পারছে না...অনন্যা খুব হাসছে, সৌমাল্যকে ডেকে বলছে, 'এসো সৌমাল্য, কাছে এসো। ধরো আমাকে।' আবার হেসে ওঠে অনন্যা। সৌমাল্য ধরতে যায়...পারে না। অনন্যা আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সৌমাল্য আবার তাকে ধরার চেষ্টা করে...'এসো সৌমাল্য! কী হ'ল, এসো। ধরো আমাকে...' আবার হাসি... সৌমাল্য পড়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে...অনন্যা তখনও হাসছে। খুব হাসছে। সৌমাল্য চেঁচিয়ে বলছে, 'আমি তলিয়ে যাচ্ছি অনন্যা! আমাকে বাঁচাও।' অনন্যা হেসেই যাচ্ছে। সৌমাল্য আরো তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনন্যাকে আর ডাকছে না! যতটা পারছে, তার হাসিটা প্রাণভরে দেখে যাচ্ছে। বড্ড সুন্দর লাগছে তার হাসিটা দেখতে। খুব ইনোসেন্ট লাগছে অনন্যার মুখটা। সৌমাল্যর খুব বলতে ইচ্ছা করছে, 'আমাকে একবার ভালোবাসো বলো, অনন্যা'...কিন্তু আর বলতে পারছে না। তলিয়ে যাচ্ছে। অনন্যা কাছে আসছে না। দূর থেকে ডাকছে তাকে। বরফের চাদর সৌমাল্যের শরীর নিজের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। মুহূর্তের জন্য সৌমাল্যর ওই বরফের চাদরটাকেই অনন্যার উষ্ণ বুক বলে মনে হ'ল। সে নিবিড আলিঙ্গনে ধরা দিল। ঘুমটা ভেঙে গেল সৌমাল্যর। কয়েক ঢোক জল খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে, সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল। একটু আবল্যের মধ্যে আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সৌমাল্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে, হঠাৎ তার খেয়াল হ'ল! সে নিজেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখল। আশ্চর্য হয়ে তার মনে প্রশ্ন জাগল-- কিন্তু তার পোশাক তো গায়েই ছিল! কোথায় গেল! সামনের লোকজন তাকে দেখে হাসাহাসি করছে...সৌমাল্য পাগলের মতো ছুটছে, ছুটছে; কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই স্বপ্নটার মধ্যেই আবার নিজেকে দেখল, হঠাৎ করে সে উপর থেকে নীচে পড়ে যাচ্ছে। কখনো দেখল, সে নদীতে ডুবে যাচ্ছে। অনন্যা তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে আসছে, সে মানা করছে, 'এসো না অনন্যা, এখানে ঘূর্ণি আছে। তুমি ডুবে যাবে।' অনন্যা শুনছে না... এগিয়ে আসছে। কাছে, খুব কাছে এগিয়ে এসে তাকে ধরার চেষ্টা করছে...সৌমাল্য হাত বাড়াচ্ছে, অনন্যাও হাত বাড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ কারোর নাগাল পাচ্ছে না...
ঘুমটা এবার পুরোপুরি ভেঙে গেল সৌমাল্যর। তখন ঠিক সকাল সাড়ে আটটা।
0 Comments.