Sun 16 November 2025
Cluster Coding Blog

অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার - ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে) - ১৩

maro news
অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার - ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে) - ১৩

অন্ধকারের উৎস হতে - তেরো

অনিমিখদের অফিস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন সাড়ে আটটার মধ্যে সে বাড়ি থেকে রওনা দ্যায়। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। অধিকাংশ দিনই প্রচণ্ড ড্রাঙ্ক অবস্থায় বাড়ি ফেরে। এটাই চিরকালের রেওয়াজ। এখনও তাই হচ্ছে, কোনও ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু ঘন্টা দুই-তিনেকের মধ্যেই চাঙ্গা হয়ে যায়। 

অন্যদিকে, অনন্যার স্কুল এখনও খোলেনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস ওয়াইজ হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ তৈরী করা হয়েছে। হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমেই এখন পাঠদান চলছে। প্রত্যেকদিন প্রায় একটা কিংবা দুটো করে ক্লাস থাকে অনন্যার। কখনও নোটসের ছবি তুলে কখনও বা প্রশ্নোত্তর আবার কখনও ইউটিউব থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর আলোচনার লিঙ্ক তাদের হোয়াটস অ্যাপে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাঠাতে হচ্ছে। তার ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও করে দিতে হচ্ছে। তাদের বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আবার নিজেদের ভার্চ্যুয়াল ক্লাস নেওয়ার ভিডিও আপলোড করছেন। অনন্যা অনলাইন ক্লাসের ওইসব ভিডিও টিডিও তুলে পাঠায়নি। কিন্তু প্রতিরাতে পরেরদিনের জন্য পাঠ রেডি করে তবেই তাকে শুতে যেতে হচ্ছে। সেইজন্য আজকাল রাতে শুতে যেতে তার বেশ কিছুটা দেরি হচ্ছে।

আজ সকালে অনিমিখের মোবাইলে ওই মেসেজগুলো দ্যাখার পর মনটা সারাদিন কেমন একটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। কোনও কিছুতে মন বসছিল না। আগামীদিনের ক্লাসের জন্য মেটিরিয়াল রেডি করে ও যখন শুতে এলো, তখন প্রায় রাত সাড়ে বারোটা। আজ কিছুতেই অনিমিখের সঙ্গে একই বিছানায় শুতে ইচ্ছা করল না অনন্যার। সে পাশের ঘরের খাটটিতে শুয়ে পড়ল। এমন আগেও করেছে। অনিমিখ রাতের বেলায় অসভ্যের মতো চিৎকার করে দরজা ধাক্কিয়েছে। অত রাতবিরেতে চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে আশেপাশের লোকজনের হাসাহাসির কারণ হতে চায়নি বলে, একান্ত লোকলজ্জার ভয়ে সে দরজা খুলে দিত অনিমিখকে। আর সেই সুযোগে অনিমিখ তার ওপর যথেচ্ছভাবে নির্যাতন চালাত। কিন্তু আজ অনিমিখের শত চ্যাঁচামেচিতেও অনন্যা ঘরের দরজা খুলল না। অনন্যার সাড়াশব্দ না পেয়ে অনিমিখ অনেকক্ষণ ধরে চ্যাঁচামেচি, খিস্তিখেউড় করেও যখন দরজা খোলা পেল না, তখন সে আস্তে আস্তে চুপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে অনন্যা ঘর থেকে বেরল। 

তাদের শোবার ঘরটাতে অনিমিখ নেই। ফাঁকা ঘর। লাইট নেভানো। অনন্যা ঘরের লাইট জ্বেলে একবার দেখল। অনিমিখের কোনও চিহ্ন সে এই ঘরে দেখতে পেল না। পাশের ঘরও ফাঁকা। অনন্যা তিনতলায় গিয়ে দেখল, অনিমিখের স্টাডিরুমের দরজা দিয়ে হালকা আলো বাইরে আসছে। অনন্যা মনে মনে বলল, 'অনি কি তাহলে এখানে!' সহসা তার মনে প্রশ্ন জাগল, 'এখন এখানে কী করছে?'

ভেজানো দরজাটা সামান্য ঠেলে ফাঁক করে অনন্যার চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। কানে হেডফোন লাগিয়ে অনিমিখ সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তার ল্যাপটপের সামনে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে যৌনরসাত্মক বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনটাতে ভেসে উঠেছে বিবস্ত্রা সমাপ্তির ছবি এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন আদবকায়দা। তার মুখ নিঃসৃত কোনও শব্দ অনন্যা পর্যন্ত পৌঁছল না। ওগুলো সবই অনিমিখের হেডফোন দিয়ে তার কান শোষণ করে নিচ্ছিল। ভিডিও সেক্সচ্যাট শব্দটা অনন্যা ইতিপূর্বে বহুবার শুনেছিল, কিন্তু এই বিষয়ে তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা কিছু ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। তাই হঠাৎ করে প্রথম দেখে ব্যাপারটা তার বুঝতে হয়ত একটু বেশি সময় লেগেছিল। অনষ্কা স্থানুবৎ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর একপ্রকার টলতে টলতে নীচে নেমে এলো।

পরেরদিন সকালে অনিমিখ বেরিয়ে যাবার পর নিজের হাতে সাজানো সংসারটাকে বড় মায়াবি দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে প্রায় নটা নাগাদ পাকাপাকিভাবে এই ঘর সংসার পরিত্যাগ করে বেড়িয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল অনন্যা। আপাতত অন্য কোনও থাকার ব্যবস্থা হবার আগে পর্যন্ত অনন্যা তার জয়িদিদির বাড়ি গিয়ে থাকার সংকল্প নিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ বাড়ি ছাড়ল। অনিমিখ বাড়ি ফেরার আগে অবধি কিছুই জানতে পারল না।

মাতাল হলেও অনিমিখ কখনো পুরোপুরি আউট হয় না। তাই বাড়ি ঢুকে অনন্যাকে না দেখেই তার মন কিছু একটা আঁচ করতে পারছিল। রাত যখন গভীর হ'ল তখন সে ফোনে খোঁজখবর শুরু করল। খোঁজ বলতে সে খুব ভালো করেই জানে মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি। তাও অনন্যার ফোনেই বেশ কয়েকবার রিং করল। কেউ রিসিভ করল না। তখন জয়িতা সেনের ফোনে রিং করার চেষ্টা করল। বহুবার রিং হ'লেও রেজাল্ট এলো পূর্ববৎ। অনিমিখ নিশ্চিন্ত হ'ল অনন্যা এবং জয়িতা সেন দু'জনেই যখন ফোন ধরল না, তখন অনন্যা সেখানেই আছে। অন্য সময় হলে বিষয়টা হয়ত এখানেই থেমে যেত। কিন্তু অনিমিখের পেটে তখনও গজগজ করছে কয়েক পেগ হুইস্কির তাজা আমেজ। এই অবস্থায় সে থেমে থাকে কী করে? সুতরাং অনিনিখও থামতে পারল না। গ্যারেজ থেকে তার নতুন কেনা বোলেরোটা বের করে ওই মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভ করতে করতে জয়িতা সেনের বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়ির সামনে গাড়িটা পার্ক করে আংশিক টলতে টলতে ভেতরে এসে, কলিং বেল টিপল। আজ তার ধৈর্য বড় কম। কলিং বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার জুড়ল, 'অনন্যা, কোথায় তুমি? বেরিয়ে এসো। আরে! ও তুষারবাবু! কী ব্যাপার এত ডাকছি, দরজা খুলুন! আমার বউকে আটকে রেখেছেন কেন? আপনি ভদ্দরলোক! ছ্যাঃ!...'

অনিমিখের কথা শেষ হবার আগেই বাড়ির দরজা খুলে গেল, আর তারপরেই অনিমিখ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গালে একটা সজোরে চপেটাঘাত করে অনন্যা বেরিয়ে এলো, পেছনে পেছনে তুষার সেন আর জয়িতা সেন। ওদের একমাত্র কন্যা সৃজা কিছুটা সন্ত্রস্ত চোখে ভেতর ঘর থেকে তাকিয়ে দেখছে।

অনন্যাকে দেখেই অনিমিখ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল, 'এই যে সতী লক্ষ্মী! তা এলে এলে, এত লুকোছাপার কী দরকার ছিল? বলে কয়েই আসতে তো পারতে।'

-'ছোটোলোকমিরও একটা সীমা থাকে অনি, তুমি সেটাও ছাড়িয়ে যাচ্ছ! তোমার নিজের মানসম্মান নেই বলে তুমি কী ভাবো, কারোরই মান সম্মান নেই? জয়িদি আর তুষারদাকে সবাই সম্মান করে। আর ওই যে বাচ্চা মেয়েটা ঘর থেকে তোমাকে দেখছে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, সেখানে তোমার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না।'

অনন্যাকে ঘরে যেতে বলে তুষার সেন অনিমিখের উদ্দেশ্যে বললেন, 'আপনি এখন অসুস্থ অনিমিখবাবু, এখন বাড়ি যান। সুস্থ হলে কথা হবে।'

অনিমিখ তুষার সেনকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, 'কথা আবার কী হবে? ওই রেণ্ডিটাকে আমি আবার ঘরে তুলব ভেবেছেন?'

ঘরের ভেতর থেকে অনন্যা চেঁচিয়ে উঠল, 'তুমি আর তোমার সমাপ্তি কী? বলব সব? কাল রাতে ল্যাপটপে ওর সঙ্গে কী করছিলে? তোমার মোবাইলে ওর সঙ্গে ওগুলো কীসের মেসেজ! জানোয়ার একটা।' 

-'অনন্যার সঙ্গে আপনি আর থাকবেন কিনা, কিংবা ও আপনার সঙ্গে আর ঘর করবে কিনা, সেটা আপনাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে গালাগালি করবেন না। আপনি এখন আসুন।' তুষার সেন বললেন। 

অনন্যার কথাগুলো কানে যেতেই অনিমিখের মুখটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে অনন্যার কথাগুলো যেন শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে তুষারবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, 'ঠিক আছে। আমি তো যাবই। তবে আমার উকিল এর পর যা ব্যবস্থা নেবার নেবে। ছেনাল নিয়ে আর অনিমিখ চৌধুরী ঘর করবে না। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।' কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পেছন ঘুরল অনিমিখ। ঠিক যেমন এসেছিল তেমনভাবেই গাড়িটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

অনন্যা আবার ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, 'যাও যাও। ওই মেয়েটাকে নিয়েই থাকো গে যাও। তুমি আমাকে ডিভোর্স কী দেবে? আমিই অ্যাপিল করব ডিভোর্সের। দিনের পর দিন আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগে তোমাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব। ডিভোর্স দ্যখাচ্ছে!'

কথাগুলো অনিমিখের কান পর্যন্ত পৌঁছল কী, পৌঁছল না বলা যায় না। কিছুটা হয়ত পৌঁছল, কিছুটা পৌঁছল না। জয়িতা সেন কান্না ভেজা অনন্যাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, 'চুপ কর অনু, অনি চলে গেছে।' ছোট্ট সৃজা পুরো ঘটনাটা দেখে কিংকতর্ব্যবিমূখ হয়ে একই জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁডিয়ে থাকল। তুষার সেন, সৃজাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে, অনন্যার ঘরে এলেন। জয়ি তখনও অনন্যাকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।    

দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনন্যার মনের মধ্যে একটা সাংঘাতিক সাইক্লোন যেন উথালপাতাল করে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তার চোখমুখ জুড়ে শুধু শূন্যতা আর অসম্মানের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সারা রাত ধরে তুষার সেন আর জয়িতা সেন তাকে বুঝিয়ে গেলেন, 'যার নিজেরই কোনও আত্মসম্মানবোধ নেই তার দ্বারা অন্য কেউ অসম্মানিত হতে পারে না।'

অনন্যাকে তুষার সেন কথা দিলেন তাঁর ল ইয়ারকে দিয়ে সৌমাল্যর বিরুদ্ধে কেসটা রি-ওপেন করাতে চেষ্টা করবেন।

ক্রুদ্ধ অনন্যা বলল, 'সেই সঙ্গে আমার ডিভোর্সের জন্যও বলবেন। এটাও সমান জরুরি। ওর অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি জীবনে, আর নয়।'

-'ঠিক আছে, কয়েকদিন আগে যাক। মাথাটা ঠাণ্ডা হোক। এই ব্যাপারে তারপর সিদ্ধান্ত নিও। এখন রেস্ট নাও।' তুষার সেন অনন্যাকে বললেন।

-'মাথা ঠাণ্ডা করেই বলছি। আমার সিদ্ধান্ত পাকা।'

 -'আচ্ছা দেখছি। তোমার পাশে সব সময় আমরা আছি।'

পূবাকাশ তখন কমলাবর্ণের আভায় সুসজ্জিত। সূর্যের আলো বুকে আলিঙ্গন করে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভোর। এক নতুন দিন। নতুন করে বাঁচার স্বপ্নগুলো অনন্যাও বুকের মধ্যে সাজাতে শুরু করল এই ভোরকে সাক্ষী রেখে।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register