- 116
- 0
অন্ধকারের উৎস হতে - বারো
অনন্যা এরমধ্যে প্রায় চারবার জয়িতাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় ঘুরে গিয়েছে। একবার ছাড়া সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে দ্যাখা হয়নি। কথা হওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। যে বার কথা বলার একটু সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, সেইবার সেই তদন্তকারী অফিসার বারেবারেই তাদের কেসটা তুলে নিতেই বেশি উৎসাহ দেখিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। অনন্যা বাড়ি ফিরে আসার পরেরদিন অত্যন্ত অসুস্থ ছিল, সারাটা দিন আবল্যের মধ্যেই তার কেটে যায়। রাতের বেলা একবার অনিমিখ বলেছিল, 'সৌমাল্যকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে, ওর বাপই ছাড়িয়ে এনেছে শুনলাম। টাকা আর প্রভাব থাকলে এদেশে আইন হাতের মুঠোই থাকে।'
অনন্যা কথাটা শুনেছিল, কিন্তু হ্যাঁ, না, রাম, গঙ্গা কোনও কিছু জবাব দেয়নি। কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। অনিমিখের সঙ্গে তো নয়ই। কিন্তু তার দু'দিন বাদে সে জয়িতা সেনের সঙ্গে থানায় গিয়েছিল, তারপর আরও দু' তিনবার গিয়েছে। কিন্তু একেবারে শেষবার ছাড়া অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়নি। থানার অফিসার ইন চার্জকে ঘটনাটা জানিয়েছিল। ভদ্রলোক ব্যাপারটা জানেন, অনিমিখকেও চেনেন বলেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে কথা বলে রাখবেন বলে অনন্যাদের প্রতিবারেই কথা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু কখনও কিছু বলতেন বলে মনে হত না। অথচ প্রতিবার খবরটা অনিমিখ ঠিক পেয়ে যেত। আর বাড়ি ফেরার পর অনন্যার পরবর্তী দিনগুলো হয়ে উঠত দুর্বিষহ। অনিমিখের অশ্রাব্য গালাগাল আর বিকৃত যৌনাচারে অনন্যা কখনও কখনও গুমরে কেঁদে উঠত।
অনন্যা যেদিন প্রথম থানায় এসেছিল সেইদিন অনিমিখ গলা অবধি মদ খেয়ে তাকে যখন খাটে পেড়ে ফেলল, তখন তার মুখের ভাষা ছিল অবিশ্বাস্য! পরবর্তীতে সেই অশ্রাব্য ভাষা আর আচরণ দিনদিন আরও বেড়ে গেল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অনন্যা যতবার বলেছিল, 'আর পারছি না, এবার ছেড়ে দাও। আমার খুব লাগছে।'
অনিমিখ তাকে না ছেড়ে ততবারই উল্টে চোখ পাকিয়ে বলত, 'কেন রে! এখন আর আমাকে ভালো লাগছে না? এতদিন তো ভালো লাগত। তোর প্রেমিক, ওই সৌমাল্য ছোকড়াটা তোকে খুব আদর করত, না? এখন তাই আমাকে আর ভালো লাগছে না? '
অনন্যা সেই যন্ত্রণার মধ্যেও মুখ বিকৃত করে বলে ফেলত, 'ছিঃ! তুমি ইতর একটা।'
অনিমিখ তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়ে বলত, 'প্রেমিকের কাছে তো এতোদিন খুব আদর খেয়ে এলি, অনেক ফষ্টিনষ্টি হ'ল; এবার আমার আদর খা। বারেবারে থানায় যেতে মানা করেছি, তাও যাবি! আর কখনো যাবি? বল?'
অনিমিখের অত্যাচারে অনন্যা ককিয়ে উঠত।
অনিমিখ নির্বিকার। তারপর হাত দিয়ে অনন্যার গাল দুটো খামচে ধরে বলত, 'কেন! তোর প্রেমিকের সঙ্গে এতদিন যে ঘুরে এলি, ফষ্টিনষ্টি করে এলি আমি কিছু বলেছি? তা এখন কোন্ অভিমানে ওকে হাজতের ঘানি ঘোরানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিস? এরমধ্যেই সে পুরনো হয়ে গেল ?
অনন্যা আর কোনও জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করত না। নিরুপায় হয়ে তীব্র যন্ত্রণাতে অতিষ্ঠ হতে হতে অনিমিখের দেওয়া মানসিক ও শারীরিক এইসব অত্যাচার সহ্য করত। কিংবা বলা ভালো সহ্য করতে বাধ্য হত।
আজকাল অনিমিখ-অনন্যার দাম্পত্য জীবনে এই ঘটনারই প্রতিনিয়ত পুনরাবৃত্তি হওয়া শুরু হয়েছে। জয়িতা সেন অনন্যাকে বলেছে, 'জানোযারটাকে একদম কাছে আসতে দিবি না অনু। এতো রীতিমতো রেপ করা! আর ওগুলো একটা শিক্ষিত লোকের মুখের ভাষা! ছিঃ! এমন মানুষের সঙ্গে তুই ঘর করবি কেমন করে অনু?'
-'জানি না। তবে দিনকে দিন অনি আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। অসুরের মতো গায়ের জোর! আমি পেরে উঠি না গো দিদি। যৌনবিকার ওর চিরদিনের। তবে এতটা অমানসিক যন্ত্রণার ব্যাপারটা কখনই ছিল না। আজকাল আবার বলতে শুরু করেছে সৌমাল্যর সঙ্গে আমার এক্সট্রা ম্যারিয়াল অ্যাফেয়ার্স আছে। ও এখন নাকি সেটাই বিশ্বাস করে।'
-'যদি বুঝিস, কিছুদিন আমার এখানে থেকে যা।'
-'দেখি। সেটা তো কোনও পারমানেন্ট সলিউশন নয়।' অনন্যা বলল।
এই রকম কোনও দিন কোনও এক সময়ে অনিমিখের মুখেই অনন্যা শুনে ফেলে, 'তুই যদি থানায় যাওয়া বন্ধ না করিস, তাহলে আমি তোকে খুন করে ফেলব কিন্তু। কোনও কেসকামারি যেন না হয়। পুলিশ জি.ডি-টা লোপাট করে দিয়েছে। তুই যদি এখনো খোঁচানোর চেষ্টা করিস তো, তোর অবস্থা খুব খারাপ করে দেব। সৌমাল্যর বাবা আমাদের অফিসের বড় অঙ্কের শেয়ার হোল্ডার। আমার ওপর চাপ আছে। এতদিন ধরে তক্কেতক্কে থেকে প্রমোশনটা প্রায় বাগিয়ে এনেছিলাম, কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের পোস্টটা আমার জন্য একেবারে পাক্কা, আমার এতদিনের স্বপ্ন এবং চেষ্টার ফসল তোর একটা ভুলের জন্য বাঞ্চাল হয়ে যাবে, সেটা আমি কিছুতেই মেনে নেব না, মনে থাকে যেন। জি.এমের পোস্টটা তোর জন্য যদি আমার হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে তোর একদিন কী আমার একদিন। একেবারে খুন করে দেব। স্পষ্ট বলে রাখলাম।'
অনিমিখের মুখে কথাটা শুনে অনন্যা চমকে উঠল। একই সঙ্গে অনিমিখের এই জানোয়ারের মতো আচরণের কারণটা হঠাৎ করে অনন্যার সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
কথাটা শুনে জয়িদি তাকে বলেছিল, 'এই সময় যে মানুষটার তোর সব থেকে কাছে দাঁড়ানোর দরকার ছিল, সেই অনিমিখ আজ নিজের ব্যক্তিগত কারণে নিজেরই বউয়ের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করতেও পিছুপা হচ্ছে না। এরা মানুষ! না অন্য কিছু? কে জানে!'
দিনকতক পরে ড্রাইনিং রুমের টেবিলে অনিমিখের মোবাইলটা বেশ কয়েকবার বেজে উঠল। অনিমিখ তখন বাথরুমে। অনন্যা কখনই অনিমিখের ফোন দেখে না। আজ কী মনে হতে হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে হোয়াটস অ্যাপে ঢুকল। মেসেজগুলো দেখতে থাকল। এক জায়গায় এসে চোখ আটকিয়ে গেল; সমাপ্তি নামে অনিমিখের এক অফিস কলিগ নিজের বেশ কিছু খোলামেলা ছবি পাঠিয়েছে। অনন্যা একটু আশ্চর্য হয়ে আগের মেসেজগুলো দেখতে লাগল। অনিমিখ আর সমাপ্তির মধ্যে অসংখ্য সেক্সচ্যাটে ভরা মেসেজ পড়তে পড়তে গা গুলিয়ে উঠল অনন্যার। মোবাইলটা যথাস্থানে রেখে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল বের করে বেসিনে এসে চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে থাকল। ধাতস্থ হতে তার বেশ কিছুটা সময় লাগল। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারল না অনন্যা। মনের মধ্যে একটা খচখচ করে বিঁধে যাওয়া কাটা যেন চিরস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দিল বলে মনে হতে লাগল। মেয়েটিকে সে আগেও দু'চারবার দেখেছে। কিন্তু অনিমিখের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক, অনন্যা এর আগে কখনও বিন্দুবিসর্গও টের পায়নি। অনন্যা নিজের মনেই বলে উঠল, 'কতদিন ধরে চলছে কে জানে!' হঠাৎ করে মন তোলপাড় হওয়া এই ঝড়কে গোপনে রেখে অনন্যা বাইরে থেকে নিজেকে যতটা স্বাভাবিক রাখা যায়, সেই চেষ্টাতেই রান্নাঘরে ঢুকে, নিজের কাজে মন দিল। এখনই কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া চলবে না।
0 Comments.