Tue 25 November 2025
Cluster Coding Blog

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || চতুর্থ আড্ডা - কবি কবি অরূপ দত্ত ||

maro news
❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || চতুর্থ আড্ডা - কবি কবি অরূপ দত্ত ||

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডায়❞- চতুর্থ আড্ডা

কবি অরূপ দত্ত

জন্ম তারিখ ও সাল: 

৩১ আগষ্ট, ১৯৬৯

বাবা ও মায়ের নাম:

জগবন্ধু দত্ত (প্রয়াত) এবং ঊষা দত্ত 

পড়াশোনা: সরিষা হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, তারপর পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। কলকাতায় প্রাইভেট কোম্পানীর চাকরি ও সংসারের হাল ধরার গল্প।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: টুয়েলভে পড়াকালীন প্রথম কবিতার বই, "মৃত্যুর নিজস্ব বিছানা"; তারপর একে একে "জোনাকি প্রলাপ", "ক্ষত পরিক্রমা" ও "বিষণ্ণরেখা"।

★ রাজদীপ : শৈশবের কথা কিছু বলুন অরূপদা। কীভাবে বেড়ে উঠলেন। আজ ফিরে তাকালে কী মনে পড়ে? 

# অরূপ দত্ত : কষ্ট হয় খুব, অনেক অভাব ছিলো, একপেট খিদে ছিলো, পোষাকের টানাটানি ছিলো, ঘরের সঙ্কুলান ছিলো, তবু একান্নবর্তী পরিবারের যে আনন্দ তা কখনও ভুলতে পারবো না। ডায়মন্ডহারবারের একটি প্রান্তিক গ্ৰাম, কামারপোল। ওখানেই জন্ম, খুব অনাদরে ওখানেই বেড়ে ওঠা, আঠেরো উনিশ বছর। তারপর তো শহরের কর্ম জীবন। শৈশবে ডানপিটে ছিলাম খুব, খেলাধুলা, মারপিট, সাঁতার কাটা, বাঁটুল হাতে পাখি শিকার, প্রেম, সবকিছু ছিলো। আর সবুজ-মেরুন একটা স্বপ্ন, লালন করতাম সেই শৈশবেও। মা ঘুমিয়ে পড়লে দুপুরে মা’র আলমারি থেকে কাপড় বের করে, তাকে কয়েকটি টুকরো করে, শুকনো পাতার উনুন জ্বালিয়ে রঞ্জক সাবানে ফুটিয়ে পতাকা বানাতাম আর খেজুর পাতা বা কঞ্চির মাথায় বেঁধে উড়িয়ে দিতাম বাড়ির ছাদে, সে এক অপার আনন্দ! আর ছিলো মাছধরার নেশা, ছিপ ফেলে, জাল ফেলে, খালবিল পুকুর থেকে মাছ ধরতাম। আমার শৈশবের গল্প সে বোধহয় শেষ হবার নয়। শুনশান দুপুরে গাছে উঠে খেজুর, আম, পিয়ারা, আমড়া, কুল, কাঁচা কতবেল পেড়ে খেতাম। রঙ্গন ফুলের মধু, পাকা নিমফলও ভালোবাসতাম খুব।

★ রাজদীপ : কবিতার দিকে প্রাথমিক ভালোলাগা গড়ে উঠল কীভাবে? 

# অ.দ. : আমার বড় দাদা লিখতেন, দিদা তখনকার সময় বিয়ে বাড়ির ছড়া লিখতেন, আমার দুই কাকা ও জ্যাঠতুতো দাদা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন, সেই আবহের মধ্যেই বোধহয় কবিতার প্রতি একটা চোরা টান জন্মে গিয়েছিল সে সময়। আর আমার ছোট কাকু, কেন জানি না, ভীষণ ভাবে কবিতা লেখার জন্য উৎসাহিত করতেন, বলতেন, ‘তুই পারবি’। তখন আমার ক্লাস ফাইভ সিক্স হবে সম্ভবত।

প্রসঙ্গত জানাই, আমি তখন সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনের ক্লাস সেভেনের ছাত্র, ১৯৮০-৮১ সাল। আমাদের বাড়ির কাছের একটি দোকানে দৈনিক বসুমতী আসতো, আর সময় করে একবার যেতাম পড়ার জন্য। সেখান থেকেই হাওড়ার ‘অভিনব অগ্ৰনী’ বলে একটি পত্রিকার ঠিকানা সংগ্রহ করে, পোস্টকার্ডে একটা কবিতা পাঠিয়ে ছিলাম। সেটিই আমার প্রথম ছাপা অক্ষরের কবিতা। সম্পাদক মহাশয় খুব যত্ন করে পত্রিকাটি ডাকে পাঠিয়েছিলেন, কবিতাটির নাম ছিল, ‘ঝড়ের সাথে পাঞ্জা লড়বো’। পত্রিকাটি এখনও প্রকাশিত হয়। সে সময় আমার আঁকা'ও প্রায়শই প্রকাশিত হোতো বসুমতীর কিশোর বিভাগে। আমাদের স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যেই ছিল পোস্ট অফিস, তাই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে এই সব করতাম। একবার রেডিওয় ‘গজকুমার রঙ্গসভা’তেও আমার একটি রঙ্গ নাটিকা প্রচারিত হয়েছিল। আশির দশকে খুব জনপ্রিয় ছিল এই অনুষ্ঠানটি। সম্ভবত দেবরাজ রায় এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। সেই লেখাটিও ছিল এভাবেই একটি পোস্টকার্ডে পাঠানো।

★ রাজদীপ : কাদের কবিতা পছন্দ হয় আপনার? অর্থাৎ আপনার ভালোলাগার কবি কারা? কেন?

# অ.দ. : এক এক সময় এক এক জন কবির কবিতা ভালো লাগে। আর সর্বক্ষণের জন্য অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ। তবে সমর সেন'ও আমার খুব প্রিয় কবি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেন আচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত, কেদার ভাদুড়ী, আলোক সরকার, সুব্রত রুদ্র, শামসের আনোয়ার, সুমিতেশ সরকার এঁরা আমার খুব প্রিয় কবি, খুব টানে। এঁদের কবিতা কেন ভালো লাগে বলতে পারবো না, খুব কঠিন প্রশ্ন।

★ রাজদীপ : নিজে সিরিয়াসলি কবিতা চর্চা শুরু করলেন কোন সময় থেকে? 

# অ.দ. : সিরিয়াসলি? কবিতা আবার সিরিয়াসলি হয় নাকি!!! যখন মনে হয় লিখি, যখন মনে হয় না, লিখি না। সেই নাইন-টেন থেকে লিখছি, নব্বই দশকের শেষ দিকে কবিতা লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম বছর আট নয়, তারপর আবার লিখছি। সিরিয়াস বলে কিছু নেই আমার জীবনে, সবই খুব সহজ করে নিই। মৃত্যু নিজেই তো সিরিয়াস নয়, যখন খুশি যাকে তাকে ডেকে নেয়, তাহলে আমি কেন সিরিয়াস হতে যাবো?

★ রাজদীপ : লেখালেখির জগতে বন্ধুবান্ধব, সংঘ, যাপন ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করে বা করেছিল?

# অ.দ. : আমার বন্ধু-বান্ধব বরাবরই খুব কম, তবে যাদের সাথে মিশি, প্রাণ ঢেলে মিশি। সংঘ কোনোদিনই ছিল না, আজও নেই। সংঘ'তে এলার্জি আছে আমার। সংঘের মতামত বেশিরভাগ সময়ই আমার সাথে মেলে না, আর যেখানে মতের মিল নেই, সেখানে আমি নেই। আর যাপন তো এক একজনের এক এক রকম। যাপন তো নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের উপর, তবে আমার বিশ্বাস যাপনের সাথে কবিতার মিল থাকা উচিত, নইলে কবিতার শরীরে রক্তাল্পতা থেকে যায়। খুব নিবিড় পাঠ করলে, আমার কবিতায় আমার যাপনের ছবি পাঠক ঠিক খুঁজে পাবেন।

তবু এই দীর্ঘ কবিতাযাপনে যাঁদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি তাঁদের মধ্যে কবি রফিক উল ইসলাম, সুমিতেশ সরকার, দেবদুলাল পাঁজা, মিহির বন্দোপাধ্যায়, সুবীর মন্ডল, প্রসূন ভৌমিক, অগ্নিবর্ণ বন্দোপাধ্যায় এঁদের নাম মনে পড়ে।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতায় কী বলতে চান? 

# অ.দ. : নিজের কবিতায় আমি দুনিয়ার সবকথা বলতে চাই। যা দেখি, যা শুনি, যা অনুভব করি তার সবটুকু।

★ রাজদীপ : আপনার কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থগুলির কোনো প্রেক্ষিত আছে? কোনো পশ্চাদপট? প্রেরণা? 

# অ.দ. : আমার কবিতার প্রেক্ষিত আছে, পশ্চাদপট আছে, প্রেরণা আছে, যদিও এগুলোর কোনটাই আমার কাব্যগ্রন্থের জন্য নেই।

আমার কবিতার বইগুলোকে পুস্তিকা বলাই ভালো, গ্ৰন্থ বলা যাবে না। কবিতা লেখার এই দীর্ঘ জীবনে কখনও কাউকে কবিতা বা বই ছাপার কথা বলিনি, আর আমাকেও কেউ বই ছেপে দেবে বলে জানায়নি। তাই নিজের সামান্য রোজগার জমিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট বই করেছি মাত্র।

★ রাজদীপ : মূলত কোন পত্রিকাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখেছেন এতকাল? 

# অ.দ. : সারাটা জীবন ধরে মূলত লিটিল ম্যাগাজিনেই লিখেছি, প্রতিষ্ঠানে কদাচিৎ। এই মুহূর্তে যে নামগুলো মনে পড়ছে সেগুলো হল বিজল্প, শূন্য দশক, কবিতা সীমান্ত, সপ্তাহ, সানন্দা, উজানস্রোত, কবিতা পাক্ষিক, কবি সম্মেলন আর তোমার বারাকপুর স্টেশন তো আছেই।

★ রাজদীপ : কবিতা কীভাবে লেখেন? স্বতোৎসারিত হয় শব্দ? পঙ্‌ক্তি? তারপর কাটাকুটি করেন যথেষ্ট? 

# অ.দ. : আমার কবিতা লেখা অনেকটা মাকড়সার জাল বোনার মতো। শব্দ, অনুভব, আঙ্গিক, ছন্দ, দৃশ্য - এই সব নিয়ে মগজে একটা মণ্ড তৈরি করি। তারপর বাংলা কবিতার পাঠক ধরবো বলে, নির্জনে শব্দের জাল বুনতে থাকি… বাংলা কবিতার জাল।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কিছু আছে? 

# অ.দ. : নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবি না, আর কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাববো? থাকলে বড়জোর এক আধটা কবিতা থেকে যেতে পারে, এই পর্যন্ত। আর এসব নিয়ে বেশি না ভাবাই ভালো।

★ রাজদীপ : কবিতা লেখার সঙ্গে জনপ্রিয়তা, বই বিক্রি, পুরস্কার - এই সব শব্দের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই। 

# অ.দ. : তোমার মনে আছে হয়তো রাজদীপ, ছোটোবেলায় আমরা ‘বুড়ির চুল’ বলতাম; শিমুল তুলো হাওয়ায় ভাসতো আর আমরা তালুর ওপর রেখে জোরে একটা ফুঁ দিয়ে আকাশের দিকে উড়িয়ে দিতাম। এগুলো আমার কাছে তেমনই মনে হয়। মনে হয় তালুর ওপর রেখে সব উড়িয়ে দিই।

★ রাজদীপ : এই পৃথিবী এবং সেখানে নিজের বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, অস্তিত্বহীনতা, সময়প্রবাহ - এইসব বিষয় আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

# অ.দ. : সামান্য মানুষ, পৃথিবী-টিথিবি নিয়ে কিছু ভাবি না। শুধু মানুষের ভালো চাই। সংসারে একথালা ভাতের যোগান দিতেই তো একটা জীবন কেটে গেলো, অত ভাবার সময় কোথায়!

★ রাজদীপ : পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ও জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে ইচ্ছে করে।

# অ.দ. : ও সব বিজ্ঞানীদের বিষয়, আমি ভেবে কী করবো? ওঁরা ভাবুক।

★ রাজদীপ : বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই তাঁদের মতো করে ভাববেন, কিন্তু কবির তো একটা নিজস্ব অন্তর্জগৎ থাকে। যেখানে সে কিছু বেশি দেখে, আঁচ পায়। সেই চোখে এই পৃথিবী, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবনা আপনার মনে ধরা পড়ে?

# অ.দ. : এই পৃথিবী, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী নই। আমার ধারণা মতো তা হবে খুব যন্ত্র নির্ভর ও মেকী। তার ফলস্বরূপ মানুষের স্মৃতি বা অনুভূতির প্রবণতা কমে আসবে। এ.আই. এর মতো হয়তো যন্ত্র চালিত কবিতা লেখা হবে একদিন, মানুষের মেধা হয়তো সেদিন আর মননে থাকবে না।

★ রাজদীপ : শেষ প্রশ্ন অরূপদা, আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন বা কবিতাকে নতুন কোনো রূপে দেখতে চাইতেন? 

# অ.দ. : না না ঠিক আছে, এই অন্ন বস্ত্রের লড়াই, এই কবিতা লেখার জন্য সামান্য জীবন, এইই আমার পরম প্রাপ্তি। আর সুযোগের দরকার নেই।

তবে একটা কথা বলি রাজদীপ, এখন তোমরা যারা লিখতে আসছ, তোমার মতো আরও অনেককেই দেখি, তারা খুব সমৃদ্ধ, লেখার প্রতি একাগ্র ও মনোযোগী। তুমি কবিতার সাথে সাথে কত সুন্দর গল্প লেখো, তোমাদের জন্য আমার অপার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা এখানে জানিয়ে রাখলাম। 

★ কবি অরূপ দত্তের দুটি কবিতা —

অভিমান 

একদিন তোমরা সবাই এসো দেখা হবে,

যদিও সেদিন আমি স্পর্শহীন

আজ যেমন তোমরা ব্যস্ততার ওপারে থাকো,

সেদিন আমিও একটি কাচের আড়াল তুলে নেবো। 

শিল্পীর তুলি আর 

তারা খসার দূরত্বে, 

একটি মরা সাঁকো দুলে উঠলে 

দেখা হবে আমাদের।


ভয় 

টাকা উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে উঠছে জয়ধ্বনি, 

সবাই বলছে সত্যের জয়।

আমি মিথ্যে করুণা দেখছি, 

আর সন্তান সন্ততির কথা ভেবে 

ভয় পাচ্ছি খুব, ভয়!


[এই সাক্ষাৎকার বা তার অংশবিশেষ কোনোপ্রকারে পুনর্ব্যবহারের জন্য রাজদীপ ভট্টাচার্যের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক]

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register