Thu 18 December 2025
Cluster Coding Blog

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || পঞ্চম আড্ডা - কবি গদ্যকার অনুবাদক স্বপন নাগ ||

maro news
❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || পঞ্চম আড্ডা - কবি গদ্যকার অনুবাদক স্বপন নাগ ||

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ - পঞ্চম আড্ডা 


কবি গদ্যকার অনুবাদক স্বপন নাগ

জন্ম তারিখ ও সাল : ১০ জুলাই ১৯৫৭

বাবা ও মায়ের নাম:
স্বদেশ নাগ / প্রভা নাগ

পড়াশোনা: বিজ্ঞানে স্নাতক 

০ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : চারটি - 'ইচ্ছে আমার বনকাপাসী মাঠ', 'স্থির স্বপ্নে জেগে আছি', 'প্রিয় ২৫' এবং 'বিষাদ এসে ঘর বেঁধেছে'। প্রকাশিতব্য পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ -'নির্বাচিত ১০০'

০ রম্যগদ্যের বই : দুটি - 'ONLY FOR তোমার জন্য', 'ঢপের গল্প'। প্রকাশিতব্য তৃতীয় বই - 'চিটিংবাজ'।

০ অনুবাদগ্রন্থ : তিনটি - প্রিয় ২৫ (কেদারনাথ সিং-এর হিন্দি কবিতার অনুবাদ), প্রিয় ২৫ (হূবনাথ পাণ্ডের হিন্দি কবিতার অনুবাদ) এবং 'নির্বাচিত পনেরো' (পনেরো জন হিন্দি গল্পকারের পনেরোটি হিন্দি গল্পের অনুবাদ)

০ এছাড়াও আমার এক ডজন কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে 'IDIOT'. অনুবাদ করেছেন প্রত্যূষা সরকার।

★ রাজদীপ : শৈশবের কথা কিছু বলুন। কীভাবে বেড়ে উঠলেন। আজ ফিরে তাকালে কী মনে পড়ে? 

# স্বপন নাগ : হাওড়া জেলার এক অজ গ্রামে আমার জন্ম। গরিবি আর অকৃপণ প্রকৃতিকে সঙ্গী করে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন রাজ্য সরকারের সামান্য একজন কর্মচারী। থাকতাম ভাড়া বাড়িতে। পায়ে হেঁটে পাঁচ মাইল দূরের দামোদরের ওপারের এক স্কুলে পড়াশোনা। স্কুল থেকে পাওয়া তিনটি করে নতুন বই ছাড়া পুরো স্কুলজীবনে নতুন বই কিনে দেবার মত ক্ষমতা ছিল না বাবার। সেকেন্ড হ্যান্ড কখনো থার্ড হ্যান্ড বই-ই জুটত আমাদের। শৈশবে গরিবি বুঝতে পারতাম কোনো পুজোপার্বন এলে। তা নিয়ে যে খুব একটা বিমর্ষ থাকতাম তাও নয়। দারিদ্র্য ছিল আমাদের অভ্যাসের মত। গাছে উঠে পুকুরে ঝাঁপিয়ে রবারের বল পিটিয়ে শৈশব কেটে গেছে হেলায়-আনন্দে। আজ ফিরে তাকালে আনন্দময় মুহূর্তগুলোই দেখি। নিজেকে বেশ ধনী মনে হয়।

★ রাজদীপ : তারপর চাকরি জীবন শুরু হলো কীভাবে? 

# স্বপন নাগ : ১৯৭৫ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে চলে আসি দমদমে। দিদির বাড়ি। দিনে ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিশিপ, সন্ধেয় মতিঝিল কলেজে বিএসসির ক্লাস। ট্রেনিং আর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর খিদিরপুরের একটি কারখানায় দু'বছর চাকরি। এর মধ্যেই মাত্র চার মাসের ব্যবধানে হারাই বাবা ও মাকে। মাত্র দুবছর চাকরির পর আর একটি ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যাই উত্তর প্রদেশের কানপুর। ১৯৮৩ সাল সেটা। ট্রেনিং শেষে কানপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি। সেখানে দীর্ঘ কুড়ি বছর। ২০০২ সালে ট্রান্সফার হয়ে ইছাপুরে।

★ রাজদীপ : কবিতার দিকে প্রাথমিক ভালোলাগা গড়ে উঠল কীভাবে? 

# স্বপন নাগ : আমার স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই আমার কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। তিনি একজন কবি।পাঠ্যবইয়ের অন্ত্যমিল দেওয়া কবিতার বাইরে নিজের ভাবনাকে অন্যভাবে পরিবেশন করে কবিতা লেখা যে যায়, সেই আলো দেখিয়েছিলেন তিনিই।

★ রাজদীপ : কাদের কবিতা পছন্দ হয় আপনার? অর্থাৎ আপনার ভালোলাগার কবি কারা? কেন?

# স্বপন নাগ : শঙ্খ ঘোষ আমার প্রিয় কবি। শুরুর দিকে কী ভালো যে লাগত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! এছাড়া কত কবিতাই তো ভালো লাগে। আজ কবি নয়, কবিতাই আমার পছন্দের মাপকাঠি। খ্যাতনামাদের সাধারণ মানের কবিতার চেয়ে তত-নামী-নন এমন বহু কবির কবিতায় আমি প্রতিদিন আনন্দ পাই। কেন? এ প্রশ্নের কোনো সংক্ষিপ্ত উত্তর হয় না। কবিতা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে যে পংক্তি উচ্চারিত হওয়া সম্ভব নয় এমন কোনো পংক্তিসর্বস্ব লেখাই বোধকরি ভালোলাগার অন্যতম কারণ।

★ রাজদীপ : আর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কাদের কবিতা ভালো লাগে?

# স্বপন নাগ : সমসাময়িক ভালোলাগা কবির তালিকা দীর্ঘ। লিটল ম্যাগাজিনে লেখেন কত চমৎকার সব কবিতা কত বিভিন্ন কবি ভাবলে আশ্চর্য লাগে। আশ্চর্য এ কারণেই যে সেই সব কবিতা বহুপঠিত হবার সুযোগ পায় না। আবার সমসাময়িক লেখা যা নাগালের মধ্যে পাই, তাতে কবিতা নিয়ে একটা ধন্ধও তৈরি হয়। তখন মনে হয় আমি বুঝি এতদিনেও বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক কোনটি কবিতা আর কোনটি নয়। যে লেখা বুঝতে মনন নয়, শুধু মেধার প্রয়োজন, সে লেখা আর যা-ই হোক, কবিতা হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া কবিতা নিয়ে ইদানিং আনুষ্ঠানিকতার রমরমা এত বেশি যে তা থেকে দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অনেক জায়গায় যেতে হয় তবু, যাই। কবিতার মত দেখতে অনেক লেখা নজরে পড়ে, তাকে কবিতা তকমা দিতে একদলের এই নাছোড় উল্লাসের সামনে আমি চুপ করে থাকি। এ সবের বাইরে অনেকেই আছেন তাদের লেখা ভালো লাগে, উল্লেখ করলে অনেকের নাম বাদ পড়ে যেতে পারে। শুধু বলি, নামী কবির কত কবিতা পড়ে যে হতাশ হয়েছি, আবার অখ্যাত কত কবির কবিতা পড়ে তৃপ্ত হয়েছি। তখন আমি আমার মত করে বুঝতে চাই সত্যি কবিতার জয়কে।

★ রাজদীপ : নিজে সিরিয়াসলি কবিতা চর্চা শুরু করলেন কোন সময় থেকে? 

# স্বপন নাগ : কবিতা লিখতে গেলে যে সিরিয়াসনেসের দরকার হয়, তা আমার কোনদিনই ছিল না। লিখি ভিতরঘরের ডাকে। লিখে আনন্দ পাই। কয়েকটা দিন কেটে গেলে আগের লেখাটি যে কিস্যু হয়নি বুঝে আর একটা লেখা তৈরি হয়। এভাবেই চলছে এতদিন। সেই কলেজজীবন থেকে।

★ রাজদীপ : লেখালেখির জগতে বন্ধুবান্ধব, সংঘ, যাপন ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করে বা করেছিল?

# স্বপন নাগ : বন্ধুবান্ধব সংঘ যাপন ছাড়া আমার লেখালেখি কখনই বুঝি হত না। প্রাথমিক ফুয়েলটা পাই বন্ধুদের কাছ থেকে। দমদমে থাকাকালীন ১৯৭৬-৭৭ সালে 'পল্লব' পত্রিকা শুরু করি একদল বন্ধু মিলে। ১৯৮৩ সালে কানপুরে গিয়ে জুটে যায় আর একদল বন্ধু। দীর্ঘদিন বন্ধুবান্ধব মিলে বের করে গেছি 'খেয়া' পত্রিকা। কোলকাতায় ফিরেও যুক্ত হয়েছি 'শব্দহরিণ' কবিতা পত্রিকার সঙ্গে। সেখানেও বন্ধু সংঘ।

★ রাজদীপ : আমরা জানি আপনি দীর্ঘকাল প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। সেখানে বাংলা সাহিত্যের চর্চা কীভাবে সম্ভব হতো? 

# স্বপন নাগ : বহির্বঙ্গ থেকে বাংলা সাহিত্যচর্চা বিষয়টি বেশ কঠিন। তখন সেখানে বাংলা ছাপাখানা ছিল না।বাংলা অনুষ্ঠান তার আয়োজনও করতে হত নিজেদেরই। কিন্তু সুবিধে যেটি, তা হল বহির্বঙ্গের বাঙালির বাংলা ভাষাটির প্রতি টান। পত্রিকা ছাপাতে প্রতি তিন মাস অন্তর কোলকাতায় আসতাম আমরা। এই পরিশ্রমের নেপথ্যে অসামান্য সমর্থন পেতাম বঙ্গীয় সমাজ থেকে। কোনদিন 'বহির্বঙ্গে বাংলা চর্চা' নিয়ে গবেষণা হলে কানপুরের 'খেয়া' পত্রিকাকে আলোচনাতে আনতেই হবে। নিয়মিত এই পত্রিকার প্রকাশন এখন থমকে আছে বটে, তবে এটাও ঘোষণা করতে গর্ববোধ হয় যে এখনও অবধি 'খেয়া'র মুদ্রিত সংখ্যা একশোর কাছাকাছি। ভুললে চলবে না, ১৯৮৭-৯০ তিন বছর ধরে 'খেয়া'-য় প্রকাশিত লেখার জন্য সামান্য হলেও লেখকদের সম্মান দক্ষিণা দিয়েছে।

★ রাজদীপ : আপনার কথা শুনে বহির্বঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন ও যাপনের বিষয়ে আরও বিশদ জানতে ইচ্ছে করছে। 

# স্বপন নাগ : আমি যে কুড়ি বছর কানপুরে কাটিয়েছি তখন কানপুরে বাস করত লক্ষাধিক বাঙালি। কানপুরের সঙ্গে এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে আমার। বাঙালির সংখ্যা এখন অনেক কম। আমাদের 'খেয়া' পত্রিকা যখন নিয়মিত বের হত বাপী চক্রবর্তী তখন বের করত 'দূরের খেয়া' নামের আর একটা পত্রিকা। কিন্তু তার প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। এমনকি মাঝে আট বছর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল সেই কাগজ। আমি ২০০২ সালে যখন বদলি হয়ে চলে আসি তখন 'খেয়া'-র বয়স আঠাশ। প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ৭৯। কানপুরে গিয়ে বাঙালির কাছে খেয়া’র কথা বললে যে কেউ স্মরণ করতে পারবেন, কী কী সব বিশেষ সংখ্যা বের করেছি! কানপুর সংখ্যা, অনুবাদ সংখ্যা, কবিতা সংখ্যা, গল্প সংখ্যা, ছড়া সংখ্যা, পাণ্ডুলিপি সংখ্যা, আলোচনা সংখ্যা... কানপুরে আমাদের আয়োজনেই হয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তার মধ্যে সুমিত্রা সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্না ঘোষালের রবীন্দ্রসঙ্গীত; পূরবী দত্তের নজরুল গীতি; দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ ও অরুনাভ গাঙ্গুলির আবৃত্তি; চেতনার মারীচ সংবাদ, জগন্নাথ, নান্দীকারের শেষ সাক্ষাৎকার, সমীর বিশ্বাসের মানুষ ভূত নাটক কিংবা ক্যালকাটা কয়্যার ও ক্যালকাটা পিপলস্ কয়্যারের অনুষ্ঠান – সব আয়োজিত হয়েছে 'খেয়া'-র তদারকিতে। তাছাড়া নিয়মিত ঘরোয়া গান কবিতা গল্পের আসর তো ছিলই। মনে পড়ছে 'কবিতার ঘরবাড়ি' শিরোনামে আধুনিক কবিতার কোলাজ নিয়ে চমৎকার একটি অনুষ্ঠানের কথা। একবার তো বিভিন্ন হ্যান্ড ক্রাফটের সঙ্গে কবিতা গল্প লিখে স্থানীয় স্কুল এবং শহরের এক আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন প্রভূত সাড়া জুগিয়েছিল।

বাঙালির সংখ্যা এখন এত কমে গেছে যে অনুষ্ঠানের কথা ভাবাও দুষ্কর। সে সময় নাগপুর থেকে বের হত 'খনন' পত্রিকা। সম্পাদক সুকুমার চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন। খনন আর বের হয় কিনা জানি না। মধ্যপ্রদেশ থেকে 'মধ্যবলয়', এলাহাবাদ থেকে 'ঝিলিমিলি', মুম্বাই থেকে 'প্রবাসে নিজভাষে' ও 'মেঘ', বেনারস থেকে 'সবার সাথী', রাঁচি থেকে 'পদক্ষেপ' নিয়মিত বের হত একসময়। জানি না, সেই সব পত্রিকা আজও বের হয় কিনা। এখন গুটিকয় যে বাঙালি আছেন ঐতিহ্যের নামে দুর্গাপুজো করেন তারা। অন্তত সাহিত্যচর্চার নামে কানপুরে এখন কিছুই হয় না। আমি গত বছরের দুর্গাপুজোতেও কানপুরে গিয়ে দেখেছি সেখানকার হাহুতাশ। আমার ফেলে আসা সেই সব দিনগুলো এখন স্বপ্নের মত মনে হয়।

★ রাজদীপ : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশের কথা আমাদের বলুন।

# স্বপন নাগ : ১৯৮৩ সালে 'পল্লব' পত্রিকার বন্ধুরা আমাকে না জানিয়েই প্রকাশ করেছিল আমার একক একটি কবিতার বই। মাত্র এক ফর্মার ক্ষীণতনু সেই কবিতার বই 'ঘর' ছেপেছিল বন্ধু স্বপন মুখোপাধ্যায়। বন্ধু অবন বসু সে বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিল। কবিতা নির্বাচনও করেছিল ওরাই। 'পল্লব' বন্ধ হয়ে গেছে। অকালে চলে গেছে স্বপনও। সে বইয়ের একটি কপিও আমার কাছে নেই। তবু 'ঘর'কেই আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ধরা উচিত। সেটা কোথাও উল্লেখ করি না, বলি 'ইচ্ছে আমার বনকাপাসী মাঠ' আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। 'খেয়া প্রকাশনী' থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ ১৩৯৫। দু'বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে তার দ্বিতীয় সংস্করণ।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতায় কী বলতে চান?

# স্বপন নাগ : বলতে তো চাই কতকিছু, বলতে পারি কই! যা বলতে চাই, কবিতার ভাষায় সে ঠিক যথাযথ উচ্চারণ অর্জন করতে পারে না। এখন, চারপাশের এই অস্থির সময়ে কবিতা যেন আরও কর্কশ স্বরে উঠে আসতে চায়। 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়'-এর মত গদ্যকন্ঠ প্রকট হতে চায়। পারি না। সংবেদনশীল প্রতিটি মানুষের মধ্যে আজ অসহ্য এক অসহায়তা চেপে বসেছে।

★ রাজদীপ : আপনার গদ্যের বইগুলির বিষয়ে আমাদের জানান।

# স্বপন নাগ : আমার গদ্যলেখা খুব বেশি দিনের নয়। এর আগে পত্রিকার প্রয়োজনে গদ্য লিখতে হয়েছে। কখনো প্রবন্ধ বা আলোচনা। একবার 'নবাবী' পত্রিকায় একটি রম্যরচনা বের হয়। তার পর থেকে সম্পাদকের নির্দেশে পর পর কয়েকটি সংখ্যায় লিখতে হয়। লিখতে গিয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়ায় উৎসাহিত হয়ে গদ্য লেখায় মন দিই। পর পর লিখেও ফেলি। প্রায় সব লেখাই বিভিন্ন পত্রিকার আবদারে। লিখতে লিখতে যখন দেখলাম অনেকগুলি হয়ে গেছে, বন্ধুদের প্ররোচনায় সেগুলি গ্রন্থিত হয়ে বইও হয়ে গেল। এখন যখন পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে রম্যরচনার আবদার আসে, বেশ আনন্দ হয়।

★ রাজদীপ : গদ্যে এই মানব জীবন নিয়ে নানান মজার কাহিনি থাকে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

# স্বপন নাগ : গদ্যই হোক কিংবা পদ্য মানব জীবন বাদ দিয়ে তো কিছু নয়। আর মজার কাহিনি সেগুলোকেই আমার রম্যরচনায় তুলে আনার চেষ্টা করি। নিটোল গল্প আমি লিখতে পারি না। এই টুকরো টুকরো ঘটনাকে রম্যগদ্যে সংকলিত করে পাঠকের সঙ্গে সহজে কমিউনিকেট করা যায়। এই যান্ত্রিক যাপনে কখনো সেই সব হাস্যরস বেঁচে থাকার মধ্যে একটু স্বস্তির হাওয়া এনে দেয় যেন। সাময়িক এই রিলিফ দমবন্ধ জীবনে খানিক অক্সিজেনের মত।

★ রাজদীপ : আপনার কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থগুলির কোনো প্রেক্ষিত আছে? কোনো পশ্চাদপট? প্রেরণা? 

# স্বপন নাগ : সেভাবে নির্দিষ্ট কিছু নয়। তবে আমি জানি, আমার কবিতায় অতীত ফিরে ফিরে আসে। আর পশ্চাদপট কিংবা প্রেরণার কথা বললে বলতে হয় চারপাশের আবহই কখনও মুগ্ধ, কখনও ক্রুদ্ধ, কখনও আন্দোলিত করে আমাকে আর পাঁচজনকে করে যেভাবে। আমি মুগ্ধ হই, ক্রুদ্ধ হই, আপ্লুত হই - সেই বোধ অক্ষরের হাত ধরে কবিতা হয়ে উঠতে চায়। যা চাই, যেমন করে চাই - কিছুতেই তার নাগাল পাই না। হয়তো একদিন ঠিক পারব, এই বিশ্বাসটাকে বুকে আগলে রাখি। তাই সেই শুরু থেকে আজ অবধি থামতে পারিনি। ছুটে চলেছি।

★ রাজদীপ : মূলত কোন পত্রিকাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখেছেন এতকাল? 

# স্বপন নাগ : আশির দশক অব্দি তেমন ছোট পত্রিকা খুব কম আছে যেগুলিতে লিখিনি। কত পত্রিকাই তো বেরতো সেই সময়, তার অধিকাংশই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ছাপার কাজ আজকাল অনেক সহজ হয়ে গেছে, পত্রপত্রিকাও বেরচ্ছে অনেক। নিজে থেকে সেই সব কাগজে বড় একটা লেখা পাঠানো হয় না। লেখা চাইলে দিই। আমাদের লেখা আমরাই প্রকাশ করব, এই তাড়নায় লিটলম্যাগ শুরু করেছি। তাই একসময় 'পল্লব'-এ যেমন নিয়মিত ছাপা হত আমার লেখা, পরে 'খেয়া'-তে, বন্ধ হওয়ার আগে অব্দি নিয়মিত লিখেছি 'নবাবী'-তে।

★ রাজদীপ : কবিতা কীভাবে লেখেন? স্বতোৎসারিত হয় শব্দ? পঙ্‌ক্তি? তারপর কাটাকুটি করেন যথেষ্ট? 

# স্বপন নাগ : একটা পঙ্‌ক্তি হঠাৎ করে এসে মাথায় পাক খায়। অনেকক্ষণ ধরে সে থেকে যায়। রোজকারের কাজের মধ্যেও তাকে কিছুতেই সরাতে পারি না। এসে যায়, কীভাবে আসে জানি না। আমাকে সে বাধ্য করে তার লগ্নতা পেতে। এই অস্বস্তির আয়ু ততক্ষণ, যতক্ষণ না পরের পংক্তির সঙ্গে তাকে হেঁটে যেতে মদত করি। তৈরি হয়ে যায় পরের পংক্তি। হাঁটা তখন সহজতর হয়ে ওঠে, একটার পর একটা পংক্তি তখন এসে যেতেই থাকে। একটা কবিতার শরীর নেয়। পরে সময়মত সেটিকে সারিয়ে নিই। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এভাবেই একদিন 'ও মেয়ে তোর শরীর জুড়ে ফুল ফুটেছে' এই পঙ্‌ক্তিটি ঢুকে পড়েছিল মগজে। কিছুতেই তাকে বিস্তার দিতে পারিনি। পঙ্‌ক্তিটিকে একটি কবিতায় অন্তর্ভুক্তি দিতে লেগে গেছিল বেশ কয়েক মাস। আমার ক্ষেত্রে কবিতা এভাবেই আসে। ফরমায়েশি বিষয়ভিত্তিক কবিতা তাই বড় একটা লিখতে পারি না।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কিছু আছে? 

# স্বপন নাগ : না, নেই। যে কবিতা লিখতে চাই, তা লিখতে চাওয়ার আকুতি না-হয় বেঁচেই থাক। তাতে যদি অক্ষর আর শব্দের সঙ্গে সহবাস দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়, তা তো কম সুখের নয়! 'ভবিষ্যৎ ভাবনা' আর কী! কবিতা ভালোলাগার বোধ যেন কোনদিন ফুরিয়ে না যায় - এই বাসনায় রোজ কবিতা পড়ি, তার খুব কাছে গিয়ে বসি। কবিতার জন্যেই আজও বেঁচে থাকাকে এত অর্থময় মনে হয়।

★ রাজদীপ : কবিতা লেখার সঙ্গে জনপ্রিয়তা, বই বিক্রি, পুরস্কার - এই সব শব্দের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই। 

# স্বপন নাগ : একটি-দুটি জনপ্রিয় কবিতা হয়তো কবির পাঠকবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বিক্রি পুরস্কার ইত্যাদি হয়তো তার কবি পরিচিতির ব্যাপ্তি দিতে পারে, কিন্তু দিনের শেষে আরও ভালো কবিতার চাহিদাই তৈরি হয়। তা সামাল দিতে কবিকে সক্রিয় হতেই হবে। প্রবল মার্কেটিংয়ের বাজারে আজ জীবনানন্দ দাশ কিংবা বিনয় মজুমদার বেঁচে থাকলে কী করতেন, কোথায় থাকত তাঁদের কবিতা - এসব ভাবলে শিউরে উঠি। পুরস্কার, তা সে খারাপ হবে কেন, সে তো একপ্রকার স্বীকৃতি। সেই স্বীকৃতিকে সম্মান জানিয়ে কবিও সচেতন হন, সৃষ্টিশীল থাকেন।

★ রাজদীপ : এই পৃথিবী এবং সেখানে নিজের বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, অস্তিত্বহীনতা, সময়প্রবাহ - এইসব বিষয় আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

# স্বপন নাগ : অস্তিত্বহীনতার সংকট পৃথিবী জুড়ে এই মুহূর্তে প্রবল। যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনেতাদের আস্ফালনেই তার প্রমাণ। ভাবায় তো বটেই, ভীষণভাবে ভাবায়। ভাবতে ভাবতে যখন নিজস্ব অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতার কথা ভাবি, অসহনীয় এক অসহায়তা আমাকে গ্রাস করে ফেলে। অসহায় বোধ করি, কিন্তু আমি বরাবরেরই আশাবাদী একজন মানুষ। 'একদিন স্বপ্নের ভোর' আমার কাছে নিছক কোনো গান নয়। কয়েকজনের আস্ফালনে যখন পৃথিবী জুড়ে অশান্ত হয়ে ওঠার কালো মেঘ ঘনায়, মানুষ তখনই জেগে ওঠে। ভোগবিলাসের এই মোহজাল ভেঙে বেরিয়ে আসে, উঠে দাঁড়ায়।

★ রাজদীপ : পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ও জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে ইচ্ছে করে।

# স্বপন নাগ : মানবসভ্যতায় লুকিয়ে আছে যে সভ্যতা শব্দটি, তার ব্যাখ্যা এক একজন মানুষের কাছে এক একরকম। সেই ব্যাখ্যায় জীবজগতের কেউ আরাম-আয়েস বুঝলে কেউ বোঝে উন্নততর আর একটা জীবনের কথা। সে উন্নয়ন বোধের। উন্নততর বোধের জীবনকেই মানুষ বেছে নেয় শেষমেশ। নেবে যে, সে বিষয়েও আমি আশাবাদী।

★ রাজদীপ : আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন বা কবিতাকে নতুন কোনো রূপে দেখতে চাইতেন? 

# স্বপন নাগ : পুনর্জন্মে বিশ্বাস নেই। এতটা হেঁটে এসে তাই আরেকটা সুযোগ পেতে গেলে পুনর্জন্ম ছাড়া উপায় কী! তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই, এই জন্মের স্মৃতি দিয়ে পুনর্বার পাঠানো হয় আমাকে - প্রথমেই আমি দৌড়ে সেই সেই জায়গায় গিয়ে সেই সব মানুষের কাছে হাঁটু মুড়ে আমার ভুলগুলোর জন্যে ক্ষমা চাইব। এমনভাবে চাইব, তারা ক্ষমা করবেনই। তারপর নতুন করে শুরু করব - সতর্ক, নিখুঁত।

★ রাজদীপ : আপনার নিজের দুটি সবচেয়ে পছন্দের কবিতার দিন, যেদুটি আমরা পাঠককে পড়ার জন্য দেব। 

# স্বপন নাগ : 'সবচেয়ে পছন্দের কবিতা' বললে আমার ঝুলি শূন্য। আগেই বলেছি আমার কালকের লেখাটি আজকেই মনে হয় কিস্যু হয়নি। তবু সাম্প্রতিক লেখা একটি কবিতা দিলাম। সেই সঙ্গে ইচ্ছে করে বছর পঞ্চাশ আগে-লেখা আর একটি :

অকারণ কবিতা

°°°°°°°°°°°°°°°°°°

তেমন কোন কারণ ছিল না 

কারণ, কোন কারণ ছিল না 


অথচ তার 

দুটো হাতেই দুরন্ত বুলবুলি 


ছড়িয়ে যেতে ভরিয়ে দিতে 

সত্যিকারের বারণ ছিল না 


কী হবে আর কী হবে না 

তাও কি নির্ধারণ ছিল না 


সেভাবে ঠিক পরম্পরায় 

স্পষ্ট কোন কারণ ছিল না 



বস্তুত অন্ধকারে 

°°°°°°°°°°°°°°°°°

সকালকে গর্ভে নিয়ে নিয়তই রাত্রি কাঁদে পোয়াতির যন্ত্রণায়।

শিমুলের ডাল ভেঙে আরও বেশি ওপরে যদি ওঠে গোল চাঁদ, 

সেও তার সুখ নয় ; সুখ নেই স্রোতস্বিনীর কলধ্বনিতে তার।

আঁধারের হিমেল হাওয়া শুধু তার প্রসবের যন্ত্রণা বাড়ায়।

বেশি রাতে ডুমুরের ডালে ডেকে উঠলে কালপেঁচা, ভয়ঙ্কর ফাঁদ

পেতেছে জটিল আয়োজনে কেউ - ভেবে কাঁপে রাত্রির বুকের পাহাড়।


বস্তুত অন্ধকারে সবই মূল্যহীন - নদীজল নারী কিংবা ক্রিসেনথিমাম,

সবই যেন মেকি বলে মনে হয় আয়োজিত যাবতীয় প্রকৃতির সাজ;

মনে হয় জলের প্রপাতেও সংকেত ভেসে যায় ভীষণ ভয়াল!

শাস্তি বলে মনে হয় সুখ বলি যাকে, স্বপ্ন হয় প্রকৃতই প্রাণের আরাম।


বিনিদ্র লাখো চোখ অপেক্ষায় থাকে অমলিন সবুজ আশায়; সলাজ

জড়তা ভেঙে যায় রাত্রির : ভ্রূণ থেকে জেগে ওঠে আদিগন্ত দীপ্র সকাল।


* [ এই সাক্ষাৎকার বা তার অংশবিশেষ কোনোপ্রকারে পুনর্ব্যবহারের জন্য রাজদীপ ভট্টাচার্যের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক ]

★★★

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register