- 168
- 0
❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ - দ্বিতীয় আড্ডা
কবি মীরা মুখোপাধ্যায়
বাবা ও মায়ের নাম : অমিয় মুখোপাধ্যায় এবং কুসুম মুখোপাধ্যায় (উভয়ই প্রয়াত)
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
ছন্ন সেরেনাদ কিম্বা - ১৯৯৬
অরোরা বোরিয়ালিস - ২০০৭
বিরহের অতুলপ্রসাদে - ২০২৩
★ রাজদীপ : শৈশবের কথা কিছু বলুন। কীভাবে বেড়ে উঠলেন। আজ ফিরে তাকালে কী মনে পড়ে?
# মীরা মুখোপাধ্যায় : চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে ছেলেবেলা কেটেছে। সমস্ত চাওয়াই অপূর্ণ থেকে গেছে। তবু আজ ফিরে দেখলে কেন যেন এক মায়ার আলো আমাকে আচ্ছন্ন করে। এ হয়তো সেই নস্টালজিয়া যা আমাদের সকলের এক সম্পদ বিশেষ।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে মূলত পল্লীগ্রামে। আমাদের বাড়ি ছিল বারাকপুর নীলগঞ্জের অদূরে সাঁইবনা গ্রামে। পরে একসময় বাংলা ছাড়িয়ে আমরা পাড়ি জমিয়েছিলাম দূর উড়িষ্যার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে পানীয়জল বলতে সারা গ্রামে একটিমাত্র ইঁদারার আশ্বাস। অনেক অসুবিধা থাকলেও আমি কিন্তু প্রকৃতিকে নিজের করে পেতাম সেখানে। বাড়ির সামনে দূরবিসর্পি এক নীলাভ পাহাড়, রাস্তা পেরিয়ে বিস্তৃত এক করঞ্জবন। বসন্তে সমস্ত বন যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠত সে তখন এক অমর্ত্যলোকের দোরগোড়া।
আমার বাবা বোহেমিয়ান প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, ভাগ্য সন্ধানে বহু ঘোরাঘুরির ফলে আমার প্রথা মাফিক লেখাপড়া হয়নি। প্রথম স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস সিক্সে, মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের অদূরে কাঞ্চনতলা গ্রামের সন্তদাস নলিনীকান্ত হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। সপ্তম শ্রেণি অব্ধি পড়ে আবার ঠাঁইনাড়া হলাম। তারপর দীর্ঘ গ্যাপ। পুনরায় ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম গাংনাপুরের কাছে এড়ুলি গ্রামে সরিষাডাঙা ড. শ্যামাপ্রসাদ হাইস্কুলে। তারপর থেকে অবশ্য আর গ্যাপ নেই। রাণাঘাট কলেজে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ সম্পূর্ণ হলো। তা করতে আবারও বদলে গেল ঠিকানা। অবশেষে গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ থেকে বি.এ. পাস করলাম।
★ রাজদীপ : তারপর চাকরি জীবন শুরু হলো কীভাবে?
# মী.মু. : সে সময় মার্কশিটের কিঞ্চিৎ মূল্য ছিল। ছাত্রী হিসেবে খুব খারাপ ছিলাম না। তাই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই ভারত সরকারের ডাক বিভাগে চাকরি পেলাম। তখন আমার বয়স ওই বাইশ মতো হবে। আর সেই থেকে পারিবারিক দায় দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। আগেই বলেছি যে আমার বাবা অত্যন্ত বোহেমিয়ান ধরনের ছিলেন। ফলে আমার এক ভাই ও এক বোন এবং বাকিরা -এই সকলের ভালোমন্দ আমার কাঁধে এসে পড়ল। অবশেষে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে সেই চাকরি থেকে অব্যহতি পেলাম।
★ রাজদীপ : কবিতার দিকে প্রাথমিক ভালোলাগা গড়ে উঠল কীভাবে?
# মী. মু. : সত্যি বলতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে। যা আমার হৃদয়ের রত্নমালা। তাছাড়া উড়িষ্যায় থাকতে সেখানকার সেই অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আমি ওখানেই প্রথম হিজল ফুল দেখেছিলাম। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি এত সম্ভারের সান্নিধ্যেও, সেই অল্পবয়সেই বিষাদ অনুভব করতাম। বোধহয় এভাবেই আমি একটা নিজের জগত তৈরি করেছিলাম অবচেতনে। এই বোধই হয়তো আমাকে কবিতার প্রতি অনুরক্ত করেছিল পরবর্তীকালে।
★ রাজদীপ : কাদের কবিতা পছন্দ হয় আপনার? অর্থাৎ আপনার ভালোলাগার কবি কারা? কেন?
# মী. মু. : রবি ঠাকুরের পর, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন, মৃদুল দাশগুপ্ত এবং আরও অনেকে। এই স্বল্প পরিসরে যা বলা যায় না।
★ রাজদীপ : আর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কাদের কবিতা ভালো লাগে?
# মী. মু. : সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আমার পছন্দের তালিকা দীর্ঘ। এভাবে বলতে গেলে নার্ভাস হয়ে যাব।
★ রাজদীপ : নিজে সিরিয়াসলি কবিতা চর্চা শুরু করলেন কোন সময় থেকে?
# মী. মু. : ‘সিরিয়াসলি’ হাঃ হাঃ আমি তো কখনও এভাবে ভাবিইনি। ভালো লাগত তাই লিখতাম। তা ঐ কলেজবেলা থেকেই মনে কর। সেই সময় কীভাবে যেন একবার ‘যুবমানস’ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলাম। সেই লেখা পত্রিকায় ছাপা হতে খুব উৎসাহ পেলাম।
★ রাজদীপ : লেখালেখির জগতে বন্ধুবান্ধব, সংঘ, যাপন ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করে বা করেছিল?
# মী. মু. : তা তো করেই বা করেছিল। তবে তা কোন সংঘ নয়। কাছের কিছু বন্ধু বান্ধব বা প্রতিষ্ঠান ছিল কিছু, তবে তা সামান্যই। কলেজ জীবনে গোবরডাঙা থাকতে অমলেন্দু বিশ্বাস, পঙ্কজ মণ্ডল, তীর্থঙ্কর মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে কিঞ্চিৎ আলাপ পরিচয় ছিল। ‘নৌকো’পত্রিকায় তখন লিখেছিও দু-একবার। ওঁরা বিনয় মজুমদারকে ঘিরে থাকতেন। আমি চাকরি সামলে অতকিছু করতে পারতাম না। তাছাড়া তখন যাঁরা লেখা ছেপেছেন তাঁদের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। সেসময় তো চিঠি ছাড়া পথ নেই। আর বহু চিঠি শেষপর্যন্ত পৌঁছাতো না গন্তব্যে। আমি কোনদিনই সেভাবে কবিতার জন্যে কোথাও যেতে পারিনি, তাই সংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে বেশিরভাগ।
★ রাজদীপ : তাহলে শিমুরালিতে আপনি এলেন কীভাবে?
# মী.মু. : আমার চাকরিতে বদলি হয়ে চলে এলাম রাণাঘাট। এভাবেই লাস্ট বছর তিরিশেক আমি স্থায়ী ভাবে শিমুরালির বাসিন্দা।
★ রাজদীপ : রাণাঘাটে চাকরি করাকালীন সেখানকার সাহিত্য জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়নি?
# মী.মু. : হুম, তা হলো ধীরে ধীরে। নিজন দে চৌধুরী, জয় গোস্বামী। জয় আমাদের পোস্ট অফিসে মাঝে মাঝে একটা লম্বা ছাতা হাতে নিজের বইপত্র সংগ্রহ করতে আসতেন। ওঁর বাড়ি যেখানে ছিল সেখানে যে পোস্টম্যানের ডিউটি থাকত তাকে একদিন বললাম যে আমি ওঁর সঙ্গে বাড়ি গিয়ে দেখা করতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করতে। তা শুনে উনি আমাকে যেতে বলেছিলেন। তারপর একদিন গেলাম। আরও লোকজন ছিলেন। আলাপ হলো মুখোমুখি। আমাকে ওঁর পড়া এক গোছা বই ধরিয়ে দিয়ে বাড়িতে পড়তে বললেন। সেইসব বই-পত্রিকা মাথায় করে বাড়ি ফিরলাম।
★ আমরা জানি আপনার স্বামী কবি সমর সুর। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?
# মী.মু. : ওই কবিতার হাত ধরেই পরিচয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমরের সঙ্গে দেখা হতো। এভাবেই ঘনিষ্ঠতা। ২০০৪ সাল নাগাদ ব্যাপারটা পাকা হল।
★ রাজদীপ : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ বিষয়ে কিছু বলুন।
# মী.মু. : তখন কবি স্বপন মোদকের ‘বিরোধীপক্ষ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতাম। উনি বারবার আমার কাছে পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে নিতেন। স্বপনবাবুই এক সময় একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বললেন। বিরোধীপক্ষ থেকে প্রকাশ করবেন। ওঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন নারীর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হল। ‘একালের বোধিসত্ত্ব’ পত্রিকার মন্দিরাদি, কবি টিপু দাস আর আমি। এভাবেই প্রকাশ পেলো ‘ছন্ন সেরেনাদ কিম্বা’।
★ রাজদীপ : এরপর বাকি দুটি বই?
# মী.মু. : দ্বিতীয় বইটি সমরের উদ্যোগেই ‘রক্তকরবী’ থেকে প্রকাশিত হয়। আর ২০২৩-এ অংশুমান করের চেষ্টায় ‘সপ্তর্ষি’ থেকে আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়।
★ রাজদীপ : নিজের কবিতায় কী বলতে চান?
# মী. মু. : বোধহয় জীবনের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের কথা, ব্যর্থতা। মোটকথা কোন আশার বার্তা খুঁজে পাই না চেষ্টা করেও।
★ রাজদীপ : আপনার কবিতায় নস্টালজিয়া, ফেমিনিজম ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গীভাবে থাকে। আর থাকে অদ্ভুত বিষণ্ণতা। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
# মী. মু. : হ্যাঁ, আমার লেখায় কেন যেন এক ধূসর বিষণ্ণতা এসে পড়ে প্রায়ই। আমি বুঝি। একে আমি চেষ্টা করেও অতিক্রম করতে পারি না। আমি জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই সেই দ্বাদশতম খেলোয়াড় যার হাত থেকে শেষপর্যন্ত ক্যাচ পড়ে যায়।
আর মেয়েজীবনের জন্যই লেখায় ফেমিনিজ্ম এসে পড়ে অনিবার্যভাবে।
★ রাজদীপ : আপনার কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থগুলির কোনো প্রেক্ষিত আছে? কোনো পশ্চাদপট? প্রেরণা?
# মী. মু. : আছে, তবে তা আজ উহ্যই থাক।
★ রাজদীপ : মূলত কোন পত্রিকাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখেছেন এতকাল?
# মী. মু. : আগে নৌকো আর বিরোধীপক্ষের কথা বলেছি। সাম্প্রতিক কালে তোমার বারাকপুর স্টেশন পত্রিকায়, ছায়াবৃত্তে, আরও দু-চারটে পত্রিকায়… যারা আমার লেখা ছাপে আর কি।
★ রাজদীপ : কবিতা কীভাবে লেখেন? স্বতোৎসারিত হয় শব্দ? পঙ্ক্তি? তারপর কাটাকুটি করেন যথেষ্ট?
# মী. মু. : একটা লেখা মনে মনে তৈরি হয় প্রথমে তারপর লিখি। হ্যাঁ, কাটাকুটি করি তো বটেই তবে যথেষ্ট নয়।
★ রাজদীপ : নিজের কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কিছু আছে?
# মী. মু. : কিস্যু না।
★ রাজদীপ : কবিতা লেখার সঙ্গে জনপ্রিয়তা, বই বিক্রি, পুরস্কার - এই সব শব্দের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই।
# মী. মু. : কেউ লেখাটা ভালো বললে ভালো লাগে এটুকুই। তা বাদে অন্যগুলোর কথা স্বপ্নেও আসে না।
★ রাজদীপ : এই পৃথিবী এবং সেখানে নিজের বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, অস্তিত্বহীনতা, সময়প্রবাহ - এইসব বিষয় আপনাকে কীভাবে ভাবায়?
# মী. মু. : ভাবায়, তবে তা খুব বিষণ্ণতায় ঢেকে থাকে প্রায়শই। এক গভীর অস্তিত্বহীনতা আমাকে ঘিরে রাখে ধূসর অসুখের বলয়ে।
★ রাজদীপ : পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ও জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে ইচ্ছে করে।
# মী. মু. : বড্ড কঠিন প্রশ্ন। এটা আপাতত বাদ রাখি ভাই।
★ রাজদীপ : আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন বা কবিতাকে নতুন কোনো রূপে দেখতে চাইতেন?
# মী. মু. : তুমি দেবে সে সুযোগ? দিলে বলব।
★ রাজদীপ : আপনার নিজের দুটি সবচেয়ে পছন্দের কবিতার নাম বলুন, যেদুটি আমরা পাঠককে পড়ার জন্য দেব।
# মী. মু. : মায়ের কাছে সব সন্তানই সুন্দর, তাই আমার কানা বোঁচা সব লেখার জন্যেই বুকে জায়গা থাকে। তবু যখন বলছ দুটো লেখার নাম দিলাম –
১. স্যানাটোরিয়াম ২. ক্যাপসুলা মুণ্ডি
★ রাজদীপ : আর এই সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আপনার একটা সুন্দর ছবি দিতে হবে তো দিদি।
# মী. মু. : বয়স যখন কম নাকি বয়স যখন বেশি?
চৈত্রদিনের নাকি যখন শীতের শেষাশেষি...
হাঃ হাঃ… ভালো থেকো।
★ কবি মীরা মুখোপাধ্যায়-এর পছন্দের দুটি কবিতা –
# স্যানাটোরিয়াম
প্রিয় নারী ব'লেছিল
ক্ষয়রোগ সেরে গেলে
সে আমায় ঠোঁট ছুঁতে দেবে
অথচ গহন রাতে আতপ্ত ক্ষতমুখ
ঘুনপোকা মাতৃকোষ ভাঙে,
যারা কথা দিয়েছিল
আসবে রোদ্দুর নিয়ে
তারা কেউ প্রতিজ্ঞা রাখেনি
বলেনি বৃষ্টির রাতে
‘এসো স্পর্শ করো’
স্যানাটোরিয়ামের হিম বিষণ্ণ বিকেল জুড়ে
রক্তকণা তবু জেগে থাকে,
ক্ষয়রোগ-সেরে গেলে
প্রিয় নারী বলেছিল
সে আমায় ঠোঁট ছুঁতে দেবে।
[ছন্ন সেরেনাদ কিম্বা]
# ক্যাপসুলা মুণ্ডি
মৃত্যুর পর হয়তো তুমি হলে কৃষ্ণচূড়া গাছ
আমি নাগকেশরের চারা,
তুমি কি আমায় আর চিনতে পারবে।
করতোয়া নদীর ওপারে
তোমার অজস্র ফুল ঝরে পড়লে
পূর্বজীবনের চেনা বন্ধুরা এসে
সে ফুল কুড়িয়ে নেবে
যখন তোমার নাম সুসান ডি রোজারিও ছিল
আমাকে দেখতে কেউ আসবে না।
কোনো জলোচ্ছ্বাসে হয়তো ভেসে গেছে
আমাদের দ্বীপ...
আমার নামের আগে আলেফ বা ওরকম কিছু
বাকি সব মুছে গেছে আর
নাগকেশরের ফুল কোনোদিন আমিও দেখিনি
[বিরহের অতুলপ্রসাদে]
[ এই সাক্ষাৎকার বা তার অংশবিশেষ কোনোপ্রকারে পুনর্ব্যবহারের জন্য রাজদীপ ভট্টাচার্যের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক ]
0 Comments.