Wed 12 November 2025
Cluster Coding Blog

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || প্রথম আড্ডা - কবি গদ্যকার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী ||

maro news
❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ || প্রথম আড্ডা - কবি গদ্যকার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী ||

❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ - প্রথম আড্ডা



কবি গদ্যকার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী 

জন্ম তারিখ ও সাল : 

৫ চৈত্র, ১৩৫৮ (ইং : ১৯-০৩-১৯৫২) 

বাবা ও মায়ের নাম : ঈশ্বর মধুসূদন চক্রবর্তী এবং ঈশ্বর বিমলাবালা দেবী।

পড়াশোনা : 

টিটাগড় কৃষ্ণনাথ পৌর উচ্চ বিদ্যালয়, তালপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা। স্নাতক স্তরে, রসায়নে সাম্মানিক, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র মহাবিদ্যালয়, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা।

প্রকাশিত গ্রন্থ : 

কাব্যগ্রন্থ - চরাচর, আমাদের, তৃণভূমি, নদীমাতৃক, পাখিমঙ্গল, পতঙ্গপ্রতিভা, মৌল থেকে শুরু, দাহ্য-অদাহ্য, ডিহিবাংলার কথকতা, অন্তর্ধান রহস্য এবং অর্বাচীনের কবিতা।

ছড়া - আগাগোড়া জীবনছড়া, তেপান্তরী ছড়া।

গদ্য ও গল্প - সিংহপুরাণ, উদ্ভিদপুরাণ, একটি লোয়ার ক্লাসিক গদ্য, কিছু শস্য কিছু কষ্ট এবং মুক্তোপুকুর থেকে কাঁটালপাড়া গ্রাম।

★ রাজদীপ: শৈশবের কথা কিছু বলুন। কীভাবে বেড়ে উঠলেন। আজ ফিরে তাকালে কী মনে পড়ে? 

# বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী : জন্ম ব্যারাকপুরের 'অন্নপূর্ণা মন্দির'-নিকটস্থ পার্ক রোডে 'জ্যোতি গুপ্ত'-এর ভাড়াবাড়ির একতলায়। বাবা ঐ বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ছিলেন। আমি মা-বাবার ৬ষ্ঠ সন্তান। খুব মনে পড়ে মা-র শেখানো 'আদ্যাস্তোত্র' ও বাবা-র শেখানো 'শিবস্তোত্র' ও 'দশাবতার স্তব'। তাছাড়া 'গঙ্গাস্তোত্র' ও 'সরস্বতী মন্ত্র' (অঞ্জলি দেওয়ার সময় যে মন্ত্র পড়তে হয়) মুখস্থ ছিল বা এখনও আছে। খুব গল্প শোনাতেন বাবা। তাঁর বগলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেতাম---মা এসে বাবা-র বিছানা থেকে তুলে এনে অন্য ভাই-বোনেদের এজমালি বিছানায় শুইয়ে দিতেন। তখন আমরা তালপুকুরের মুক্তোপুকুর-নিকটস্থ 'গৌর দাসের বাগানবাড়ি'-তে ভাড়া থাকতাম। আমার স্তোত্র-পাঠ এই পরিবারে রোজ সন্ধেবেলায় একটা নিয়মিত অনুষ্ঠান ছিল। মা-বাবা ও ভাই-বোনেরা সবাই জড়ো হত বাবা-র ঘরে আমার স্তোত্র-পাঠ শুনতে। ঐ ঘরের বাইরে প্রতিবেশিদের ভিড় লেগে যেত সুললিত কন্ঠে আমার স্তোত্র-পাঠ শুনতে। আমার বড়দি (আমরা ছোটরা বলতাম : দিদি) নিজে একজনা গল্প-উপন্যাস-লিখিয়ে ছিলেন। ওঁর গল্প-উপন্যাসের খাতা লুকিয়ে পড়তাম আমি। ওঁর প্রেরণাই কারণ আমার কবিতা-লেখার। ওঁর মুখেই প্রথম শুনি কবিতা : 'তেনজিং নোরকে / ফিরে এল ঘরকে / এভারেস্ট জয় কোরকে...'এই ছন্দ আমায় এমনই আকৃষ্ট করল যে আমার কবিতা না লিখে উপায় ছিল না। মা 'রামায়ণ' ও 'মহাভারত' পড়ে শোনাতেন। বাবা-র মুখে শুনতাম ওঁর যশোর জেলার নড়াইল মহকুমা-র 'কুড়িগ্রাম' (আমাদের দেশের বাড়ি, ১৯২৫ সালে যে বাড়ি আমার বাবা ছেড়ে চলে এসেছিলেন এ দেশে)-এর গল্প। আমার ঠাকুরদা ছিলেন নড়াইল 'ভিক্টোরিয়া কলেজ'-এর সংস্কৃত বিভাগের 'হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট'। তাঁর গল্পও শুনতাম বাবা-র মুখে। এসবই কারণ আমার গল্প-লিখিয়ে হয়ে-ওঠা। সেই সময় আমি ও আমার দাদা তালপুকুরের 'টিটাগড় কৃষ্ণনাথ পৌর উচ্চ বিদ্যালয়'-এ যথাক্রমে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই। ঐ বিদ্যালয়ে আমরা দু'ভাই তখনকার দিনের 'স্কুল ফাইনাল' স্তর পর্যন্ত পড়াশুনো করি। দাদা ১৯৬৬ ও আমি ১৯৬৮ সালে 'স্কুল ফাইনাল' পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। বলতে দ্বিধা নেই যে ঐ বিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম আমিই 'জাতীয় বৃত্তি' পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হই। ১৯৬৮ সালে ঐ বিদ্যালয় আমায় 'শ্রেষ্ঠ ছাত্র' হিসেবে মনোনীত করে একটি রুপোর পদক দিয়ে সম্মানিত করেছিল। তখন ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মাননীয় প্রয়াত শম্ভু মল্লিক মহাশয়। আজ ফিরে তাকালে আবার ঐ ছাত্র-জীবনের দিনগুলোয় চলে যেতে ইচ্ছে করে।

★ রাজদীপ : কবিতার দিকে প্রাথমিক ভালোলাগা গড়ে উঠল কীভাবে? 

# বৈ.চ. : খুবই দুর্বল কবিতা লিখতাম আমি, 'আজকাল'-এর আড্ডায় যুক্ত হওয়ার আগে। এই আড্ডা আমায় নতুন করে ভাবতে শেখালো আধুনিক বাংলা কবিতা কেমন হওয়া উচিত ! অনেক নতুন নতুন শব্দ ও শব্দবন্ধ আবিষ্কার করলাম এই আড্ডা থেকে। কারণ এই আড্ডায় আসতেন দূর-দূরান্তের কবি ও লেখকেরা। তাছাড়া আগে থেকেই ঐ আড্ডা জমাতে স্থানীয় তরুণ কবি, যেমন, বাপী সমাদ্দার ('আজকাল' পত্রিকার সম্পাদকও বটে), আলোক সোম, ভাস্কর মিত্র, অমিত নাথ, অমিত ভট্টাচার্য, সুদীপ্ত ভট্টাচার্য, সনৎ দে, এবং, গল্পকার নব শী ও অতনু ভট্টাচার্য---এঁরা তো ছিলেনই। পরবর্তী সময়ে ঐ আড্ডায় আসতেন কবি তন্ময় মৈত্র, মনোতোষ মিত্র ও সুমন গুণ। আসতেন নৈহাটির লেখক সমরেশ বসু, জ্যোৎস্নাময় ঘোষ, সোমনাথ ভট্টাচার্য, অশোক রঞ্জন সেনগুপ্ত, সমীরণ দাশগুপ্ত, কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য, রবীন সুর প্রমুখ ব্যক্তিত্ব, যাঁরা আমাদের সাহিত্য-চর্চা ও 'আজকাল' পত্রিকা-সম্পাদনায় নতুন প্রাণশক্তি ও চিন্তা-ভাবনার খোরাক জোগাতেন। এই সঙ্গ-গুণে আমার কবিতা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। একটা সময় দেখলাম আমার কবিতা অন্য তরুণতর কবি (যেমন জয় গোস্বামী ও সুবোধ সরকার, যাঁরা যথাক্রমে রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর থেকে 'আজকাল'-এর আড্ডায় প্রায় নিয়মিত আসতেন, এবং, আমরাও যেতাম ঐ তরুণ-তর কবিদের শহরে)-দের কবিতায় মৃদু ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।

★ রাজদীপ : কাদের কবিতা পছন্দ হয় আপনার? অর্থাৎ আপনার ভালোলাগার কবি কারা? কেন?

# বৈ.চ. : বলতে গেলে অনেক কবি-র কথাই বলতে হয়, যাঁদের কবিতা আমার ভালো লাগে। একে একে কয়েকজনের নাম করি : কালিদাস, ভবভূতি, কাশিরাম দাস, কৃত্তিবাস, কবীর, দাদূ, দ্বিজ চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম, মাইকেল মধুসূদন, বিহারীলাল, ঈশ্বর গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, যতীন্দ্রমোহন, যতীন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী, জীবনানন্দ দাশ, আলোক সরকার, অরুণ মিত্র, সিদ্ধেশ্বর সেন, অরুণকুমার সরকার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত, বিনয় মজুমদার, মণীন্দ্র গুপ্ত, বীতশোক ভট্টাচার্য, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, রবীন সুর, শম্ভু রক্ষিত, নবারুণ ভট্টাচার্য—এঁরা সবাই আমাদের পূর্বসুরি। বিদেশি কবিদের কথা এখানে উল্লেখ করা যেত। সেভাবে নাম করতে গেলে এই লেখা কয়েক কিলোমিটার লম্বা হয়ে যাবে, তাই সেই চেষ্টায় আর গেলাম না। সমসাময়িক বা উত্তরসুরি কবিদের অনেকের কবিতাই ভালো লাগে, তবে কালের কষ্টিপাথরে তাঁদের কবিতা এখনও যাচাই করা হয়নি। সুতরাং, তাঁদের কারও নাম এখানে উল্লেখ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

★ রাজদীপ : নিজে সিরিয়াসলি কবিতা চর্চা শুরু করলেন কোন সময় থেকে? 

# বৈ.চ. : আমার আন্তরিকভাবে কবিতা-চর্চা শুরু ১৯৭৫ সাল থেকে।

★ রাজদীপ : লেখালেখির জগতে বন্ধুবান্ধব, সংঘ, যাপন ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করে বা করেছিল?

# বৈ.চ. : কবিবন্ধু ও 'আজকাল' পত্রিকার কবি-গোষ্ঠীর সঙ্গ-যাপন অবশ্যই আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল, অন্তত প্রথম ৫ বছর। ১৯৮০ সালের পর থেকে আমি ক্রমশ কবিতায় আমার নিজস্ব ভাষা খুঁজে পেতে শুরু করি। তারপর থেকেই আমি স্বতন্ত্র ঘরানায় কবিতা ও মুক্ত গদ্য লিখে চলেছি বলা যায়। তবে হ্যাঁ, আমার নিজের লেখালেখিও কালের কষ্টিপাথরে বিচারের অপেক্ষায় বসে আছে। সেইসব বিচারক হলে তোমরা, আমার উত্তরসুরি কবি-লেখক-সম্পাদকেরা।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতায় কী বলতে চান? 

# বৈ.চ. : নিজের কবিতায় অনেক কিছুই বলতে চাই। বলার কি আর শেষ আছে ? প্রকৃতি, দেশ, মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, শত্রু, মিত্র, বাজারের ফড়ে, দোকানদার, ভিখারি, পথের ধারের ল্যাম্পপোস্ট, নদী, সমুদ্র, ঋতু-বদল, হাওয়া, মেঘ, বৃষ্টি, বাড়ি, ঘর, জীবন, যৌনতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কুশাসন, মানুষের ওপর দুর্বিষহ অত্যাচার, সামাজিক অন্যায়, নির্বিচারে গণহত্যা, শিশুদের ওপর নির্মম অপরাধ—বলতে গেলে আমাদের চারিপাশে যা কিছু হচ্ছে, হয়ে চলেছে, হতে পারে বলে মনে হয়—তার সবকিছুই আমার লেখার বিষয়। আমি বাছবিচার না করেই যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে চাই, এমনকী বিজ্ঞান ও গণিতও আমার বিষয়ের বাইরে যেতে পারে না।

★ রাজদীপ : আপনার কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থগুলির কোনো প্রেক্ষিত আছে? কোনো পশ্চাদপট? প্রেরণা? 

# বৈ.চ. : প্রেক্ষিত বলতে প্রেমে ব্যর্থতা, হাটে-মাঠে-বাটে দুর্ধর্ষ কর্মজীবন, গ্রামীণ লোকাচার, পথে-প্রান্তরে নিজেকে উধাও করে দেওয়া, উজ্জ্বলন্ত বন্ধুপ্রেম ও তজ্জনিত নৈরাশ্য, মধ্যরাতে ট্রেনে চেপে অজানা স্টেশনে নেমে পড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে অচেনা বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ—এ সমস্তই নতুন ভাষায় কবিতা লেখার জন্য। তারপর কবিতাগুলিকে ঝাড়াই-বাছাই করে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ—প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে টাকা তুলে (মানে,গাঁটের পয়সা খরচ করে) বই ছাপানো।

★ রাজদীপ : মূলত কোন পত্রিকাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখেছেন এতকাল? 

# বৈ.চ. : মূলত 'আজকাল', 'আজকাল টাইটোনিডি', 'শায়ক', 'ঋতুপত্র', 'আঙিনা', 'অধুনা সাহিত্য', 'উন্মেষ', 'মহাবাহু', 'হাইওয়ে', 'ছোটোকাগজ', বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা', 'এ মাসের কবিতা', 'আত্মপ্রকাশ', 'কবিতীর্থ', 'কালবেলা', 'শব্দপথ', 'বইঘর' প্রমুখ পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। আরও আছে, সব নাম মনে পড়ছে না। তবে সবই ছোটো পত্রিকা। 'বড়ো কাগজে লিখিনি' বলবো না। একবার জয় গোস্বামী কবিতা চেয়ে ফোন করেছিল 'দেশ' পত্রিকার জন্য। লজ্জার মাথা খেয়ে পাঠিয়েও ছিলাম গোটা কয়েক কবিতা। ভুলভাল ছাপিয়ে সেই কবিতার গুষ্টিনাশ করেছিল জয়। প্রতিবাদ জানিয়েও ফল হয়নি। তারপর থেকে আর ওমুখো হইনি। আরেকবার বাপী সমাদ্দার আমায় 'দৈনিক আজকাল '-এ কবিতা পাঠাতে বলায় পাঠিয়েছিলাম কবিতা। ওরা তখন প্রতি রবিবারে 'সাপ্লিমেন্টারি' পাতায় কবিতা ছাপাতো। ঐ একবারই। আর কোনো বড়ো কাগজে কবিতা ছাপা হয়নি।

★ রাজদীপ : আজকাল বা পরবর্তীকালের আজকাল- টাইটোনিডি পত্রিকা একসময় বাপী সমাদ্দার সম্পাদনা করতেন। পরে বিভিন্ন সময় আরও কয়েকজন। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে আপনি। বাপীবাবু বিচ্ছিন্ন হয়ে পূষা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলেন। এই ভাঙনের কারণ কী? প্রেক্ষাপট কী? এই বিষয়ে আপনার আলোকপাত আশা করি।

# বৈ.চ. : ১৯৭৫ সালে 'আজকাল' পত্রিকার উদ্যোগে নৈহাটিতে একটি কবি-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, অবিভক্ত ২৪ পরগনা, বর্ধমান, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, এমনকী বাঁকুড়া-বীরভূম থেকেও অনেক কবি-লেখক উপস্থিত হয়েছিলেন ঐ কবি-সম্মেলনে। অনুষ্ঠান-উপলক্ষে 'আজকাল ৮' সংখ্যা ছোটো আকারে বের করা হয়। ঐ সংখ্যার বিশেষ সম্পাদক হিসেবে বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী সর্বসম্মতি-ক্রমে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচন হল পত্রিকার ভাঙনের সূত্রপাত। পরবর্তী ৯ ম সংখ্যা 'আজকাল'-এর সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গল্পকার অতনু ভট্টাচার্যকে। এটাও হল পত্রিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় দুর্ঘটনা। পত্রিকার ভাঙন ত্বরান্বিত হল। "আসলে পত্রিকা-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত লেখক-কবি-রা কেউই অহিংস ছিল না"—এই সত্য আবিষ্কার করেছিলেন নৈহাটির শক্তিমান গল্প ও নাট্যকার জ্যোৎস্নাময় ঘোষ, যা তিনি বাপী সমাদ্দারকে বলেছিলেন পত্রিকা-ভাঙন যখন সম্পূর্ণ হয়। হয়েছিল কী, আমি তখন বর্ধমানের রামগোপালপুরে চাকরি সামলাচ্ছি, এমন এক শুক্রবারে বাপী সমাদ্দার, ভাস্কর মিত্র, আলোক সোম ও আরেকজন (আমার ঠিক মনে নেই) বর্ধমান জেলার জৌগ্রামে হুগলির কবি শীতল চৌধুরীর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। ওখানে গিয়ে ভাস্কর ও বাপী-র মধ্যে তর্ক হয় ''কেন 'আজকাল' পত্রিকার সম্পাদক বদল হয় বার বার!" এই তর্ক অমীমাংসিত থাকাবস্থায় ভাস্কর মিত্র, অমিত নাথ ও অতনু ভট্টাচার্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে 'অক্ষক্রীড়া' নামে একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা বের করে। এই পত্রিকা ২/৩ টে সংখ্যা বেরোতে-না-বেরোতেই বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভাস্কর মিত্র ভাটপাড়ার আরেক কবি হীরক ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে 'ডানা'-নামে আরেকটি পত্রিকা বের করে। এই পত্রিকার আয়ুও দু'এক বছর।

'আজকাল' কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। বাপী সমাদ্দার, আলোক সোম, নব শী ও বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর উদ্যোগে ১৭ সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকা প্রায় নিয়মিত বেরোতে থাকে। ১৮-তম সংখ্যার আমন্ত্রিত সম্পাদক ছিলেন কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী। সেই সময় বাপী সমাদ্দার ঔপন্যাসিক ও গল্পকার সমরেশ বসুর ছোটো মেয়ে মৌসুমীকে বিবাহ করেন। ফলত, বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই ওঁরা স্বামী-স্ত্রী নৈহাটির পাট গুটিয়ে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে যান। বাপী সমাদ্দার ততদিনে 'দৈনিক আজকাল' পত্রিকায় 'সাব-এডিটর' হিসেবে চাকরি পেয়ে গেছে। বাপী সমাদ্দার, আলোক সোম ও বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর প্রথম যৌথ কাব্যগ্রন্থ 'চরাচর, আমাদের' ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে। ঠিক হল যে 'আজকাল' পত্রিকা বন্ধ হবে না। আবার সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ল বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর ঘাড়ে। বৈদ্যনাথ সেই দায়িত্ব হাসিমুখে বহন করতে লাগলেন তাঁর ওপর চেপে-বসা চাকরির ও সংসারের চাপ সামলে। তখন পত্রিকার নাম একটু পাল্টে দিতে হল ''রেজিস্ট্রেশন''-এর খাতিরে : 'আজকাল টাইটোনিডি'। ১৯-তম সংখ্যা থেকে ৩৩-তম সংখ্যা পর্যন্ত ঐ নামে পত্রিকা বেরিয়েছে। একা পত্রিকা চালানো অসম্ভব-বিধায়, অবশেষে, দীর্ঘ ৫২ বছর একাদিক্রমে পথ চলার পর এখন পত্রিকা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ-হওয়া পত্রিকার জন্য আজও মন খারাপ লাগে। সেই লেখা নির্বাচন করা, ছাপাখানা ঠিক করা, টাকা জোগাড় করা, নির্ভুল বানানে পত্রিকা বের করার জেদ নিয়ে বার বার প্রুফ দেখা, ভেতরের কাগজ ও প্রচ্ছদের কাগজ কিনতে বৈঠকখানা বাজারে যাওয়া, প্রচ্ছদে লেখা থাকবে, না, ছবি থাকবে—ঠিক করা, হরফের বিভিন্ন মাপ নির্বাচন-করা, এবং, শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে কাগজ চাপিয়ে নৈহাটি ফেরার উত্তেজনাময় দিনগুলো এখন হারিয়ে ফেলেছি—ভাবলেই মন খুব খারাপ হয়ে যায়।

★ রাজদীপ : কবিতা কীভাবে লেখেন? স্বতোৎসারিত হয় শব্দ? পঙ্‌ক্তি? তারপর কাটাকুটি করেন যথেষ্ট? 

# বৈ.চ. : কবিতা কীভাবে লিখি—এ বলা খুব মুশকিল ! আগে স্বতঃস্ফূর্ত আসতো কবিতা। কোনো কাটাকুটি না করেই সেসব কবিতা ছাপা হয়ে যেত। যখন বর্ধমান জেলার রামগোপালপুরে চাকরি করতাম, ১৯৭৭-'৭৮-'৭৯ সালে, অজ গাঁ, দুপুর আড়াইটের পর শহরে আসার কোনো বাস নেই, সেখানে একটা চৌকির ওপর আমার বিছানা, সেটাই দিনের বেলা আমার চেয়ার, কাজ করি দিনে আর রাতে সেখানেই ঘুমাই—মাঝরাতে অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি, আর, ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় উঠে বসি, চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, টর্চ জ্বালিয়ে কবিতা লিখি : 'ক্ষয় রোধ করো মাটি, করো মাটি গান, কাতর আর্তির মাঝে মূর্তির মরমী মাঠ, দৃকপাত নেই, তবু নড়ে ওঠে নাড়ি, স্মৃতি মহাপ্রাণ...' ('চরাচর, আমাদের' কাব্যগ্রন্থ দেখতে পারো), কিংবা, 'চলেছি রঙিন জামা গায়ে, আঁকাবাঁকা আলের দু'ধারে, ঘোলা জলে কত খেলে সাপ, জরিদার ধানের বাহার...' (উক্ত কাব্যগ্রন্থ দেখতে পারো)। পরে অনেক কবিতাই আমায় সংশোধন করতে হয়েছে। তখন অনেক পরিণত বয়স। বুঝেছি যে কবিতা লিখেই সঙ্গে সঙ্গে ছাপানো উচিত নয়, ফেলে রাখতে হয় কিছুদিন। তারপর দেখেশুনে কবিতা ছাপানো উচিত। এখন সংশোধনের পক্ষে আমি। বার বার সংশোধন করতে চাই।

★ রাজদীপ : নিজের কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কিছু আছে? 

# বৈ.চ. : না। সেরকম কিছু ভাবনা নেই। ভবিষ্যৎ ভেবে তো এতদিন সাহিত্য-চর্চা করিনি—করলে এতদিনে কোন্ মগডালে চড়ে বসতাম, কেউ আমার নাগাল পেত না। যাতে সকলের কাছাকাছি থাকতে পারি, এই যেমন তোমাদের পেয়েছি, তাই কোনোদিন ঐসব চিন্তা মাথায় ঢোকাইনি এযাবৎ। তবে হ্যাঁ, একটা ইচ্ছে সুপ্তভাবে কাজ করে ভেতরে যে যদি কোনো প্রকাশন-সংস্থা আমার কাব্য-সমগ্র ('আলো-পৃথিবী' প্রায় বছর দেড়েক আগে আমার যাবতীয় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা চেয়ে নিয়ে রেখেই দিয়েছে—আজও ছেপে বের করেনি। জানতে চাইলে 'আজ করবো, কাল করবো'—বলছে) ও গদ্য-সমগ্র বের করে দেয়, খুব ভালো হয়। তবে আমার তো কপাল পোড়া—মরণের পরে সবাই ছুটে আসবে, তার আগে নয়। তাই আর ভাবি না, যা হয়, হবে। এখন তো লিখে যাই।

★ রাজদীপ : কবিতা লেখার সঙ্গে জনপ্রিয়তা, বই বিক্রি, পুরস্কার - এই সব শব্দের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই। 

# বৈ.চ. : আমার মনোভাব পরিষ্কার। কবিতা লেখার সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই।

★ রাজদীপ : এই পৃথিবী এবং সেখানে নিজের বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, অস্তিত্বহীনতা, সময়প্রবাহ - এইসব বিষয় আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

# বৈ.চ. : খুব ভাবায়। নিজের বেঁচে-থাকা আপেক্ষিক। আজ ভালো আছি, কাল এমন একটা খবর পেলাম যে দিনটাই বরবাদ হয়ে গেল। যাই হোক, অস্তিত্ব মাঝে মাঝে বিপন্ন হয়ে পড়ে, যখন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কোনো 'পজিটিভ' ভাবনা মাথায় আসে না। কলম কামড়ে চুপচাপ বসে থাকি, লেখা আসে না। রোজকার দিনলিপি লেখার বিষয়বস্তু খুঁজে পাই না। তারপর ধাতস্থ হই, এক কলম-দু'কলম করে লেখা এগোয়। লিখতে না পারলে আমি অস্তিত্বহীন এক শূন্য পৃথিবীর বাসিন্দা বলে মনে করি নিজেকে। সময় খুব সাংঘাতিক জিনিস। 'কোয়ান্টাম থিওরি' পড়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। 'এই আছে, এই নেই'—সে এক অদ্ভুত তত্ত্ব। সবটা যে বুঝেছি, তা নয়—তবে 'সময়' যে অনন্ত, 'আগের আগে' থেকে যাত্রা শুরু করে 'পরের পরে' পর্যন্ত তার অব্যাহত গতি। আমি, তুমি, অন্য কেউ তৃতীয় অস্তিত্ব — সকলের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন- নিরপেক্ষ তার একমুখী গতি। সে কারও জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না।

★ রাজদীপ : পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ও জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে ইচ্ছে করে।

# বৈ.চ. : এই পৃথিবী ভারি অদ্ভুত জায়গা। মানব-সভ্যতা যে ক্রমশ বিপন্ন, এ তো তুমি-আমি সবাই জানি। প্রতি সেকেন্ডে এই গ্রহ ১৮ মাইল গতিবেগে মহাশূন্যে অবস্থান পাল্টে পাল্টে অবিশ্বাস্যভাবে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে, আমরা বিন্দুমাত্র টের পাচ্ছি না। যে কোনো মুহূর্তে উন্মাদ শাসকের ভুলের মাশুল গুনতে হবে সবাইকে। দেখতে পাচ্ছি তাদের বর্বর আক্রমণ দেশে দেশে, প্যালেস্টাইন, ইউক্রেইন, আফগানিস্তান, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো দেশে—প্রায় সর্বত্র ধনতান্ত্রিকতার গ্রাস খেয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ ও জীব-উদ্ভিদ জগতের ভবিষ্যৎ। সুইডেনের সেই মেয়েটি, গ্রেটা, কিংবা, আফগান মালালা—কারও প্রয়াসই সফল হচ্ছে না পৃথিবীর ভয়াবহ দূষণ ঠেকাতে। সমুদ্র, পাহাড়, নদী, হ্রদ, মরুভূমি, মালভূমি, উপত্যকা, সমভূমি, বনভূমি—সবকিছুই মহাবিপর্যয়ের মুখে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে। এই তো আমরা সবাই দেখলাম সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে ও কলকাতা শহরে অতিবৃষ্টির কী বীভৎস প্রভাব ! এ অবস্থায় একজন অনুভূতি-সম্পন্ন কবি কতখানি ভালো থাকতে পারে, তুমিই বলো। আমাদের পরের প্রজন্ম ভীষণ বিপদে পড়তে চলেছে, এ কথা আমি এখনই লিখে দিতে পারি। আমাদের কাল তো ফুরিয়ে এল—আমাদের নাতি-নাতনীদের কথা ভেবেই আমি আতঙ্কিত হই।

★ রাজদীপ : আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন বা কবিতাকে নতুন কোনো রূপে দেখতে চাইতেন? 

# বৈ.চ. : আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন অন্যরকমভাবে শুরু করতে পারতাম হয়তো—এবং, ফলত, কবিতাও আমার অন্যরকম হতে পারতো হয়তো—কিন্তু, কী জানো রাজদীপ, আমি এরকম একেবারেই ভাবি না। এই যে জন্ম ও জীবন পেয়েছি, এর জন্য আমার পূর্বপুরুষদের কাছে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। হয়তো অন্য জন্ম ও জীবন পেলে আমি কামচাটকায়, কিংবা, মাদাগাসকারে জীবন কাটাতাম—কিন্তু, এই 'সোনালি ডানার চিল'-এর দেশে, এই 'মেয়েদের চাল-ধোয়া হাতের' পাশে করুণ বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে, এই 'ডিহিবাংলার কথকতা' শুনতে পেতাম কি ? তাই, এই জীবন নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। শুধু যদি শাসককুল একটু সমঝদার হত, তাহলে আর কোনো সমস্যাই ছিল না। নিশ্চিন্তে সাহিত্যচর্চা করে যেতে পারতাম ; কিন্তু, তবুও এত 'কিন্তু' আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি ধ্বসিয়ে দিচ্ছে যে স্বস্তি নেই এতটুকু। তোমরাই ভাবিকালের কবি। তোমরাই এই পৃথিবী-সভ্যতা ও সাহিত্যিক ধারাকে টেনে নিয়ে যাবে—এই আশায় আজকের মতো শেষ করছি।

★ কবি বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী’র ‘'ডিহিবাংলার কথকতা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা –

৬৮

একটি নতুন শোক আসবে 
আরেকটি নতুন গাছের চারা পুঁতে 
সেই শোক সামলে নিতে হবে...

আকাশ-তৃষ্ণা আমাদের 
মৃত্তিকা-স্পৃষ্ট আমরা ঐ তৃষ্ণায় কাতর 
ভ্রূণে ভ্রূণে ওভাবেই বার বার ঘুরে মরতে থাকি...

বদ্ধমূলের গোড়ায় মারি কোপ 
দেখি যে যেটুকু ওপড়ানো যাচ্ছে না 
সেটুকুই রূপ পেল কিনা।

একটি নতুন আনন্দ আসবে 
আর সেই গাছে ফল ছিল যত 
বিলিয়ে আনন্দ বরণ ক'রে নিই...

আনন্দ করে না কাজ, শোক কাজ করে 
উবে যাওয়া কর্পূরানন্দের পর 
শোক দেখি দাগা রেখে গেছে…

৭০

অথৈ শূন্য মাথায় নিয়ে আছি বসে 
তার ওজন যে এত বেশি 
তা বুঝিনি কখনো...

কতকিছু যে বোঝার বাইরে রয়ে গেল 
যেটুকু বুঝেছি তার বোঝাও কম নয় 
এটাও বুঝেছি...

অথচ ওজন ও বোঝা না থাকলে 
শিরদাঁড়াটি যে শক্ত হত না 
এটা তো সত্যি ...

আর তা ধরতে গিয়ে পেলব কৌশলী 
সঠিক সেভাবে, ভাঁজে ভাঁজে ভাঁড় সাজা 
হওয়াও গেল না...

কেবল আস্থা জোগাচ্ছে পূর্ণ 
যার শিরস্ত্রাণ-কুণ্ডল-কবচ হয়ে 
রণক্ষেত্রে পড়ে আছি আজও…

★ সাক্ষাৎকারটি বা তার অংশবিশেষ কোনো ভাবে পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাজদীপ ভট্টাচার্য-এর অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। 

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register