Tue 18 November 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন (ধোকলা)

maro news
কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন (ধোকলা)

স্বাদকাহন - ধোকলা

"গৌরব সুইটস" - নামটা শুনলেই কেমন যেন মিষ্টির দোকান মনে হয়৷ কিন্তু চোখ আর একটু এগোলেই দেখতাম ছোট অক্ষরে লেখা "গৌরব সুইটস অ্যান্ড নামকিন"। থানেতে থাকতাম যখন মাঝে মধ্যেই চলে যেতাম সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। মুম্বাই পুণে এরিয়াতে এই "গৌরব সুইটস অ্যান্ড নামকিন" বেশ বিখ্যাত নাম করা দোকান। এখানেই প্রথম খেয়েছিলাম ধোকলা। যদিও মুম্বাই মানে মহারাষ্ট্রের খাবার দাবার বলতে পাওভাজি, বড়া পাও মিশেল পাও ইত্যাদি এগুলোই বিখ্যাত। তবে গুজরাট পাশের রাজ্য হওয়ার কারণে ধোকলা, থেপলা, খান্ডভি, ফাপড়া ইত্যাদির কোন কমতি নেই৷ নতুন খাবার দেখলেই যেমন খেতে ইচ্ছে হয় তেমনি খেতে খেতে খুবই প্রিয় হয়ে গেছে ধোকলা। 

ধোকলা আসলে কি? খুব সোজা ভাষায় বললে ধোকলা হল এক ধরণের ভারতীয় কেক, যেমন বাঙালির পোড়া পিঠে হল এক ধরণের চালের কেক। তেমনি ধোকলা হল গুজরাটিদের চাল ও চানা বা ছোলার ডালের মিশ্রণে তৈরি কেক৷ 

হ্যাঁ। কেকই। ব্রিটিশরাই কেবল কেক খায় এমন নয়। ওদের আটা ময়দার ব্যবহার বেশি যেমন ভারতীয়দের ডাল চালের ব্যবহার বেশি৷ খুবই সহজ ভাবে যদি দেখি, বাঙালি মাছে ভাতে বাঁচে বাকি ভারতীয় ডাল চাওল-এ। ভারতীয় এই কেক ব্রিটিশদের বা অন্য কোন বিদেশী আদলের কেক দেখে তৈরি হয়েছে বা অন্য কোনরকম অনুকরণে তৈরি এমন নয়। এটি বিদেশী আগমনের আগে থেকেই প্রচলিত। ১০৬৬ খ্রীস্টাব্দে একটি জৈন্য গ্রন্থে দুককিয়া নামে একটি খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার বৈদিক গ্রন্থেও এর উল্লেখ ছিল দধিকেরা নামে। এটি ছিল চাল, ডাল ও দই মিশিয়ে ফারমেন্ট করে বানানো একধরনের লবণাক্ত কেক। ধোকলার রেসিপি বলে দধিকেরাই হলো ধোকলার প্রাচীন সংস্করণ।  

১৫২০ সালে ‘বর্ণক সমুচায়’ নামক একটি গুজরাটি বইতে প্রথমবার ধোকলা শব্দটি পাওয়া যায়। শব্দটি খুব সম্ভবত ‘ঢোকলাই’ থেকে এসেছে, যার অর্থ গাঁজানো বা গাঁজন করা। ধোকলা তৈরিতে ব্যবহৃত গাঁজন প্রক্রিয়ার দিকেই নামকরণের কারণ ইঙ্গিত করে। মজার বিষয় আজও অবাঙালিদের মধ্যে ঢোকলা বলার প্রচলন ভালোই দেখা যায়৷ গুজরাটে বহু শাসক, বিশেষ করে সোলাঙ্কি ও পরে বৈষ্ণব সংস্কৃতির বিস্তারে, নিরামিষ, কম-মসলা, জাতীয় খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। সাথে ফারমেন্টেড বা গাঁজন করা খাবারও৷ ধোকলা তখনই “ঢোকলা/ঢোকরী” নামে ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছিল। এই খাবারের জনপ্রিয়তার বিশেষ কারণ কিন্তু প্রাকৃতিক। তৎকালীন গুজরাট আজকের গুজরাটের মতো ছিল না। মহারাষ্ট্রের পাশের রাজ্য একথা যেমন ঠিক তেমনি গুজরাটের আরেক পাশে রয়েছে রাজস্থান। এর ফলেই গুজরাটের জলবায়ু যেমন ছিল শুষ্ক তেমনি উষ্ণও। আজকের গুজরাটে চাষ আবাদ গাছপালা পরিমানে বেশি দেখা গেলেও উষ্ণতার কমতি নেই। এর কারণেই ফারমেন্টেশন সহজে হত এবং ফারমেন্টেড খাওয়ারগুলো শরীর ঠান্ডা রাখে, কম তেল মশলার কারণে হজমেরও সুবিধে হয়। অর্থাৎ খাওয়ারের অভ্যেসে জলবায়ুর কতটা আধিপত্য তা স্পষ্টই বোঝা যায়। 

১৬-১৭ শতকের দিকে গুজরাটের স্থানীয় ডালভিত্তিক খাবারগুলির মধ্যে বেসন জাতীয় খাবার খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময় থেকেই ঢোকলা বা ধোকলার পাশাপাশি খামন নামক খাবারটির পরিচিতি ঘটে। দুটো খাবার রান্নার পদ্ধতি একই হলেও উপকরণ সামান্য আলাদা৷ খামন তৈরি হয় বেসন দিয়ে। অর্থাৎ গুঁড়ো ছোলার ডাল দিয়ে। আর ধোকলা তৈরি হয় চাল ডাল ফারমেন্ট করে। খামনেও ফারমেন্টেশন আবশ্যক। এটি তুলনায় সহজ এবং দ্রুত স্টিম করে বানানো যায়৷ বর্তমানে হলুদ রঙের যে খাবারটি ঢোকলা বা ধোকলা নামে বাজারে বিক্রি হয় বা ইনস্ট্যান্ট মিক্স পাওয়া যায় তা আসলে খামনই। 

এরপর যখন দেশে বিদেশী মানে ব্রিটিশরাজ শুরু হল তখন এই সহজপাচ্য এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য বাজারে আমদানি হল ধোকলা স্টিমার। যেমন ইডলি মেকার ঠিক তেমনিই ধোকলা স্টিমার৷ তখন থেকেই গুজরাটিদের ঘরে ঘরে ধোকলা বানানোর প্রচলন বাড়ে। আর গুজরাটিরা যেহেতু বণিক সম্প্রদায় তাই বলার জায়গা থাকে না যে তাদের হাত ধরেই দেশের অন্যান্য রাজ্য সমেত সারা বিশ্বে ধোকলা ছড়িয়ে পড়ে৷ 

শুধু ছড়িয়ে পড়েছে বললে ভুল হবে আজকাল বাঙালির মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ধোকলাটি। তবে বেশিরভাগ ঘরেই দেখা যায় ইনস্ট্যান্ট মিক্স বাজার থেকে কিনে এনে দশ মিনিটে বানিয়ে ফেলে৷ সহজে কম সময়ে যেটুকু করা যায় আরকি। এই ধোকলার সাথে আসল।ধোকলার কিন্তু স্বাদে, টেক্সচারে অনেক তফাৎ। এটা ভুললে চলবে না।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register