- 12
- 0
স্বাদকাহন - কাবাব
পেট যতই ভর্তি থাকুক, কাবাবের নাম শুনলেই কেমন যেন জিভে জল চলে আসে। আজকাল স্ট্রিট ফুডের আধিপত্য অত্যধিক মাত্রায় হওয়ার ফলে মানুষের নিত্য জীবনে বাড়বাড়ন্ত বন্ধু হয়ে উঠেছে — হাইপ্রেসার, কোলেস্টেরল, সুগার, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি৷ ফলে লালসার সামনে কে যেন অদৃশ্য গরাদ বসিয়ে দিয়েছে৷ তবে সে গরাদ যেমনই হোক মানুষজনকে কে আটকাবে রেস্তোরাঁতে যেতে? এদের মধ্যেই যারা স্বাস্থ্য সচেতন, তারা রেস্তোরাঁতে গেলেও খাবার চয়েসে একটু অন্যরকম মেনুই খোঁজে এই যেমন বিভিন্ন ধরনের স্যালাদ বা নানান ধরণের কাবাব। আসলে কাবাব রান্নায় খুব বেশি তেলের ব্যবহার নেই আর রান্নাটা কখনই কষিয়ে কষিয়ে করা হয় না। ফলে ধরে নেওয়া যেতে পারে খাদ্যগুণ যেমন বজায় থাকে তেমনি গুরুপাক বা অস্বাস্থ্যকরও হয়ে যায় না৷
তাহলে কি ধরে নেব কাবাব কলকাতার স্ট্রিটেই জন্মেছে, না হলেও মুঘল দরবারে? এরকম ভুল ধারণা করার কোন কারণই নেই। কারণ কাবাবের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আর এই অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী হল আফগান ও তুর্কী সৈনিক এবং বণিক বা ব্যবসায়ীরা৷ সভ্যতার বা সমাজের সব অনুপ্রবেশকারীরা যে বাড়তি বা জীবনের সামঞ্জস্য ভাঙে এমন নয়। কাবাব মুখের মধ্যে ঢুকলে এই কথাটা আমাদের মানতেই হবে৷
আফগান ও তুর্কীদের ছোরার ডোগায় করে কাবাব ভারতে এলেও কাবাবের জন্ম বহুবছর আগে৷ প্রায় ৭৯০,০০০ আগে মধ্যপ্রাচ্যে হোমিনিন প্রজাতির মধ্যে আগুন ব্যবহার করে রান্নার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুরুতেই মানুষ মাংস বা অন্যান্য সবজি ঝলসে খেত এ কথা আমরা ছোটবেলাতেই পড়েছি। মনে পড়ে, ২৫০,০০০ আগের প্রাগৈতিহাসিক আখা, মাটির উনুন, প্রাণীদের পোড়া হাড় পাওয়া গেছে মধ্যপ্রাচ্য সমেত ইউরোপেও। এই সময় মানুষ শিকের ব্যবহার জানত বলে আমার মনে হয় না৷ তমানুষ রান্না করলেও এতোটা সভ্য হয়ে যায়নি তখনও। আকরোতিরির মিনোয়ান বসতি খনন করে আগুনের ওপর শিক রাখার জন্য পাথর পাওয়া গেছে, সময়টা হবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭শ শতক বা তারও কিছু আগে৷ প্রাচীনকালে, হোমারের লেখা ইলিয়াড-এ স্পিট অর্থাৎ একটি লম্বা কঠিন দণ্ড, যা খাদ্য ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয় - এর কথা পাওয়া গেছে যেখানে রেখে মাংস পোড়ানোর কথা উল্লেখ আছে । প্রাচীন ভারতীয় রচনা মহাভারতেও স্পিটে এ পোড়ানো মাংসের কথা পাওয়া যায়৷ এই স্পিটই যে বর্তমানে শিক কাবাবের শিক এ কথা বলে দিতে লাগে না।
এরকমই বহু সংস্কৃতিতেই মাংস পুড়িয়ে বা শিকে গেঁথে ঝলসে খাওয়ার প্রমাণ বা উল্লেখ পাওয়া গেছে। কিন্তু কাবাব আসলেই জনপ্রিয়তা লাভ করে তুর্কীদের হাত ধরে৷ ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও মূলত তুর্কীদের হাত ধরেই ছড়িয়ে পড়ে এই মাংস রান্নার পদ্ধতিটি৷ মরক্কো ভ্রমণকারী ইবন বতুতার মতে, দিল্লি সুলতানির সময় (১২০৬-১৫২৬) রাজবাড়িতে কাবাব পরিবেশিত হত, এমনকি সাধারণ মানুষেরাও প্রাতঃরাশে নানের সাথে এটি উপভোগ করত। মুঘল রন্ধনশৈলী এই কাবাবের স্বাদ বদলে অনেকটাই হস্তক্ষেপ করেছে। এই হস্তক্ষেপ যদিও প্রশংসনীয়। কারণ মুঘল রাঁধুনিদের ছোঁয়া পাওয়ার পর কাবাব অনেক বেশি নরম ও সুস্বাদু হয়েছিল। কারণ তারা নতুন কিছু মশলা, নানান ধরণের বাদাম, ক্রিম ইত্যাদির ব্যবহার করত। সেই থেকেই ভারতে নরম কাবাব মানুষের জিভে জায়গা করে নেয়৷ আজও কি মানুষ কম জায়গা দেয়? বাজারে কাবাবের যে কতো রকম ভ্যারাইটি পাওয়া যায় তা তো সকলেরই প্রায় জানা৷ তবে আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে, আদ্যপান্ত একটি মাংসের রন্ধনপ্রণালী মানুষের চাহিদার কারণে নিরামিষ পদ হিসেবেও পনীর ও অন্যান্য সবজির ব্যবহারে বাজার কাঁপিয়ে চলেছে৷ কত মানুষই আছে যারা নানের সাথে এই ধরণের মাংস বর্জিত কাবাব তৃপ্ত হয়ে খায়৷
লিখতে লিখতে মজার কথা মনে পড়ল। বাইরে খেতে যেদিন থেকে শিখেছি মানে কাবাব খেতে অনেক রকমের কাবাবই খেয়েছি। গলৌটি কাবাব যেন কখনও ভেজ হতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। চিরকালই মটন কিমা দিয়ে খেয়েছি। উত্তরপ্রদেশের এক নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ বন্ধুর মুখে শুনে বাড়িতে বানিয়েছিলাম। বললে বিশ্বাস হবে না সত্যিই চমৎকার খেতে। মটনের জায়গায় কি ব্যবহার করে ছিলাম জানেন? সেদ্ধ ছোলা! যাকে বেটে দিলে একেবারে মটন কিমার মতো দেখতে। তাতে নানান ধরণের বাদাম ও।মশলা মিশিয়ে বানিয়েছিলাম। বাড়িতেও সকলেই বেশ খুশি হয়েছিল। নিযে হাতে করে না বানালে বোধহয় কোনদিনই বিশ্বাস করতাম না গলৌটি কাবাবও ভেজ হতে পারে।
গলৌটি কাবাব যখন বললাম, একটা কথা জানিয়ে রাখি, আফগান তুর্কীদের হাত ধরে কেবল মাত্র কাবাব এসেছিল ভারতে৷ আজ বাজারে যত ধরণের কাবার দেখতে পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই ওই কাবাবের ছানাপোনা যাদের জন্ম ভারতের মাটিতেই। এই ছানাপোনারও জন্মের গল্প আছে। যেমন,এই গালৌটি কাবাব — লখনৌ-এর বিখ্যাত কাবাব৷ এই কাবাবের জন্ম নিয়ে বেশ মজার গল্পও রয়েছে। শোনা যার, নবাব ওয়াজিদ আলি শাঁহের দাঁতের সমস্যার কারণে খাবার চিবিয়ে খেতে সমস্যা হয়েছিল। তার জন্য কাঁচা পেঁপের সঙ্গে খাসির মাংস বেটে, তাতে প্রায় ১০০ রকমের মসলা যোগ করে গালৌটি কাবাব তৈরি করা হয়, যা মুখে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুখে গলে যায়, চিবানোর প্রয়োজন পড়ে না। গল্পটির সত্যতা জানি না তবে রাজাবাদশাদের মনোরঞ্জন করতে যে বাবুর্চিরা নানান চিন্তাভাবনা করত রান্না নিয়ে তার পরিচয় আমরা বারেবারেই পেয়ে থাকি।
এছাড়াও ভারতের ইতিহাসে আখটারি কাবাব, শামি কাবাব, খিরি কাবাব, দম কাবাব এবং পাথর কা গোশ্ত (পাথরের ওপর রান্না করা কাবাব) সহ আরও অনেক ধরনের কাবাবের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর কলকাতায় কাবাবের আগমন ঘটে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের কলকাতা আসার সাথে। ধরে নেওয়া যেতে পারে বিরিয়ানির সাথে সাথেই। ঈশ্বরগুপ্তের লেখাতেও আমরা সেই যুগের বাঙালিদের মধ্যে মটন কাবাবের জনপ্রিয়তার কথা পাই।
আজকের দিনে বড় রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তার ধারের টেম্পোরারি ভ্যানেও পর্যন্ত নানান ধরণের কাবাবের গন্ধে পেটুক ঠাকুরদের লাইন দেখলে কে বলবে কাবাবের অরিজিন ভারতের নয়? ভারতের নানান সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার তল দেখলে বারবারই মনে হয়, ভারতবর্ষ ভালো সব কিছুকেই আপন করে নিতে জানে।
0 Comments.