Wed 12 November 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন (খিচুড়ি)

maro news
কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন (খিচুড়ি)

স্বাদকাহন - খিচুড়ি 

বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলেই মা উনুন পেড়ে হাঁড়িতে চাল ডাল চাপিয়ে দিত। বাড়িতে যা কিছু সবজি থাকত, সাথে সোয়াবিন বাদাম তো আব্যশিক। হাঁড়িতে ঘি পড়লেই গন্ধে আমাদের খিদে হার্লে ডেভিডসনের স্পীডে বাড়ত৷ আবার শীতকাল এলেই রাতের দিকে ফুলকপি, গাজর মটরশুঁটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হত খিঁচুড়ি৷ বাঙালির বর্ষা, খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার ত্রিকোণ প্রেমের বাইরে শীতের খিচুড়ির গল্পটাও কিন্তু মন্দ নয়। আজ দেবাদি ড্যামে যখন পোটলাক পিকনিকের জমজমাট মেনু খিচুড়ি তখন ভাবলাম, আজকের স্বাদকাহনে খিচুড়ির গল্পই বলি। 

খিচুড়ির কথা শুনলেই যেমন ছোটবেলার নানান ঘটনার কথা মনে পড়ে তেমনি মনে পড়ে মনসামঙ্গলের গল্প৷ যেখানে মা দুর্গা গাঁজাখোর নন্দীকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন ডাব আনতে। কারণ দেবাদিদেব মহাদেব খিচুড়ি খেতে চেয়েছেন। সত্যিই ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ির গল্পটা কেবল বইতেই পড়েছি। খেতে কেমন আজও জানা হল না। এদিকে বাঙালির প্রাচীন খাদ্য তালিকায় কোথাও ডালের উল্লেখ পাওয়াই যায় না৷ ডাল ভারতীয় শস্য নয়। বিদেশ থেকে এসে এখানে থাকতে থাকতে বংশ বিস্তার করে ভারতীয় সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছে৷ কথাটা হাস্যকর শোনালেও ডাল আসলেই মধ্যপ্রাচ্যের শস্য। মধ্যযুগে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান তারপর ভারতে ঢোকে৷ মধ্যযুগ মানে আনুমানিক ১২০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ। আর মনসামঙ্গলও এই সময়তেই লেখা বলে অনুমান করা হয়। প্রশ্ন আসে শিব কিভাবে খায়! শিব তো আর মধ্যযুগের নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যেই সময় সাহিত্য রচনা হয় সেই সময়কার পরিবেশের প্রভাবও তার ওপর পড়ে৷ এখন যে কোন কাব্য উপন্যাসে ঝোল মোমো, কলকাতা দম বিরিয়ানি ইত্যাদি নানান নিত্যনতুন রেসিপির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ কিন্তু আবারও প্রশ্ন আসে, খিচুড়িই কেন উল্লেখ করলেন! কি আর এমন খাবার! অবশ্যই দামী খাবার। বিদেশ থেকে আগমন হয়েছে বলে কথা! কেন আমরা কী পিৎজা, বার্গার ট্যাকো ইত্যাদিকে উচ্চবিত্ত খাবার ভাবি না? অবাক করার মতো বিষয় হলেও এ কথা সত্য, মধ্যযুগে ডাল ছিল উচ্চবিত্ত মানুষের খাবার। ডাল ভাত বিষয়টা পরে ধীরে ধীরে সহজলভ্য হওয়ার পর প্রচলিত হয়েছে৷ বাংলা নদীমাতৃক দেশ। জাল ফেললেই ভুরি ভুরি মাছ। সে যুগে সস্তাও ছিল। তাই অযথা সাধারণ গরীব মানুষরা ডাল খাবেই বা কেন বেশি টাকা খরচা করে। 

ডাল যে উচ্চবিত্তের খাবার ছিল তা বোঝা যায় ভারতের সিংহাসনে বসে থাকা রাজারাজড়াদের খাবারদাবারের ইতিহাস জানলে। বাবর বা হুমায়ুনের রাজত্বকালে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায় না। তবে আকবরের সময় উল্লেখ পাওয়া যায়৷ সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুলফজলের লেখা আইন-ই-আকবরি তে নানান ধরণের খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ প্রায় সাত রকমের। আবার সম্রাট জাহাঙ্গীরের খিচুড়ির প্রতি আলাদাই ভালোবাসা ছিল। তার জন্য রান্না করা খিচুড়িতে মেশানো হত পেস্তা, কিসমিস। জাহাঙ্গীর নাম দিয়েছিলেন লাজিজাঁ। আবার আওরঙ্গজেবের সময় প্রচলিত হল খিচুড়িতে মাছ ডিম মেশানো। কোন একটা রান্না পর পর নানান রাঁধুনির হাতে যে নতুন স্বাদ পায় ও সংযোজন বিয়োজন ঘটে তা বোধহয় আর বলে দিতে হবে না৷ 

ইংলিশ প্রাতঃরাশ কেডগেরিও কিন্তু ডাল চাল এক সাথে মিশিয়ে রান্না করা খিচুড়িই। ভিক্টোরিয়ান যুগে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের হার ধরে ডালচালের রান্না গিয়ে পৌঁছেছিল ইংলেন্ডে৷ কেডগেরিতে অবশ্য মাছ কেইন পেপার আর ডিম মেশানো থাকে। আসলে বিষয়টা হল, যে যা খেতে চেয়েছে সে তাই মিশিয়েছে ডালচালের সাথে। এরকমই আরও একটা উদাহরণ দিলে ব্যপারটা স্পষ্ট হয়। মিশরীয়দের মধ্যে একটি খাবার বেশ জনপ্রিয় ছিল উনিশ শতকের দিকে তা হল কুশারি। এই কুশারিও এক প্রকার খিচুড়ি। ডাল চালের মিশ্রণে রান্না হওয়া খাবার। এতে আবার মেশানো হত চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পেঁয়াজ আদা রসুন। কী অদ্ভুত তাই না? 

বর্তমানে অনেকেই হালিম খেতে খুব ভালোবাসেন। এই হালিমও এক প্রকার খিচুড়িই৷ 

দেশ বিদেশের নানান খিচুড়ির গল্প করার পর মন যেন আবারও বাংলায় ফিরে আসতে চায়। আমাদের পুজোর ভোগ এমনকি বেলুড় মঠের খিচুড়িও বেশ জনপ্রিয়। শোনা যায় স্বামী বিবেকানন্দের নাকি খিচুড়ি ভীষণ প্রিয় পদ ছিল। বিদেশে থাকাকালীন খিচুড়ি রান্নার জন্য যে সবজি কাটা হত তা উনি নিজেই তদারকি করতেন। খিচুড়ির সহযোগী হিসেবে থাকত টমেটো আমড়ার চাটনি। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে আবার খিচুড়ি দই দিয়ে খাওয়ার প্রচলন ছিল। এমনটা আমি আজও কোন বাঙালিকে খেতে শুনিনি। 

চৈতন্য মহাপ্রভুর যে খিচুড়ি পছন্দের ছিল এ আর বলে দিতে হয় না। আর সেই কারণেই আজও জগন্নাথদেবের মন্দিরে মহাভোগ হিসেবে খিচুড়িই ভক্তদের মধ্যে বিলি করা হয়। 

এতো সকলের খিচুড়ি প্রিয়, এতো প্রচলনের পেছনে কিন্তু স্বাস্থ্যবিজ্ঞানই দায়ী৷ খিচুড়ির বিশেষ কিছু গুণও রয়েছে এর পেছনে। প্রথমত কম সময়ে ঝঞ্ঝাট ছাড়াই রান্না করা যায়। তাছাড়া ডাল উচ্চ প্রোটিন সর্বরাহ করে আবার চাল কার্বোহাইড্রেট। সাথে নানান সবজি মানেই ভিটামিন মিনারেলসের যোগান। অতয়েব খিচুড়ি হল সুষম খাদ্য। আবার খিচুড়িতে ভাতের ফ্যান থাকে। তাছাড়া সব এক সাথে ঘি সহযোগে খাওয়া যেমন সুস্বাদু তেমনি গুরুপাকও বটে। তাই তো বর্ষাকালের পাশাপাশি শীতকালেও খাওয়া যায়। কারণ শীতকালে যেকোন খাবার হজম সহজেই হয়। 

তাছাড়া শুধু কি খিচুড়ি খেয়ে আমরা ক্ষান্ত হই? কথায় আছে, খিচুড়ির চার ইয়ার – ঘি পাঁপড় দহি আচার”। দই না খেলেও খিচুড়ির সাথে কিছু না হোক ঘি পাপড় আর চাটনি বা আচার তো থাকেই। তবে বর্ষাকাল হলে ইলিশ তো থাকছেই গল্পে। এই যে আজ এক থালা খিচুড়ি খাবার পর এতো গল্প করলাম তাতেও কি জিভ শান্ত হল? হয় না। কারণ “নান- ক্যান- বিট” টাইপের একটা আলাদাই ব্যাপার আছে। আর সেকারণেই হয়তো সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও বাঙালি সহ সারা ভারতের নানান প্রদেশে খিচুড়ি নানান নামে, নানান সংযোজন বিয়োজন সমেত সেরার সেরা মুকুট পরে খাবারদাবারের লাস্যময়ী রাণী হয়ে বেঁচে আছে।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register