Wed 12 November 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১৭

maro news
কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১৭

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র 

প্রতিটি পর্যায়ে বাংলার বীর বারোভুঁইয়াদের সঙ্গে মুঘলদের দ্বন্দ্বের বিভিন্ন দিক আপনাদের সামনে তুলে আনছি। একসময়ের বাংলা ছিল বারোভুঁইয়াদের অধীনে থাকা স্বাধীন বাংলা। আর সেই সময় মানসিংহ স্বয়ং বাংলা আক্রমণ করেও বিভিন্ন ভূঁইয়াদের সঙ্গে বারে বারে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তিনি বেশ ভালো বুঝতে পারতেন যে বাংলা জয় করা নিতান্ত সহজ কাজ নয়। এখানকার ভূঁইয়ারা তাঁদের নিজস্ব প্রতাপে বলিয়ান। আজ যে বীর ভূঁইয়ার গল্প বলব তাঁর বীরবিক্রমের কথা যত বলা যায় ততই কম পড়ে। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে একই পংক্তিতে যদি কারো নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন শ্রীপুর বিক্রমপুর পরগনার বীর মহারাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়। যদিও তাঁদের বীরত্বের কাহিনী বাঙ্গালীদের সামনে তেমনভাবে উঠে আসেনি। তুলনায় প্রতাপাদিত্যের কথা এবং তাঁর বিভিন্ন কীর্তির কথা আমরা বেশি পরিমাণে জানি। কিন্তু বঙ্গজ কায়স্থ শ্রেণীর যেসব রাজা ভূঁইয়ারা বাংলাকে শাসন করতেন এবং তাঁদের সু রাজত্বে প্রজাদের সন্তুষ্ট রাখতেন, তাঁদের মধ্যে এই দুই ভাই চাঁদরায় ও কেদার রায় অন্যতম। যাঁরা স্বয়ং মানসিংহের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে অহংকারী বলবার সাহস এবং স্পর্ধা রাখতেন। যাঁদের নৌবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণকে ভয় পেত অসমুদ্র হিমাচল। 

বাংলায় যখন সেনবংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন, তখন দাক্ষিণাত্যের কর্নাট থেকে নিমু রায়, মতান্তরে নিমু দেব নামক এক কায়স্থ ভাগ্য অন্বেষণের কারণে বাংলায় এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সামান্য একটি চাকরি। বাংলায় এসে তিনি সেন রাজাদের দপ্তরে কাজ জুটিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন থাকলে যা হয়। ঠিক সেই সময় বাংলায় তুর্কী আক্রমণ এবং লক্ষণ সেনের পতনের কারণ নিমুরায়ের জন্য পৌষমাস হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তুর্কিদের সমর্থন দিলে তাদের থেকে উপহারস্বরূপ বিক্রমপুর জেলা লাভ করেন। তাই সামান্য এক কর্মচারী থেকে ভাগ্যের বলে হয়ে যান একেবারে রাজা। আর সেই বংশেই সম্রাট আকবরের সময়ে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদ রায় ও কেদার রায় নামক দুই ভাই। যাঁরা বারোভূঁইয়ার মধ্যে অন্যতম ক্ষমতাশালী ভূঁইয়া হিসেবে পরিগণিত হন। তাদের বীরত্বের কথা বাংলার মুখে মুখে আজও প্রচলিত। শুধু রামরাম বসুর মত বা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দরের মত বাংলার ইতিহাসে প্রতাপাদিত্যের গুণগান যেভাবে গাওয়া হয়েছে, ঠিক সেভাবে কেউ চাঁদ রায় বা কেদার রায়দের নিয়ে ভাবেননি। তাই ইতিহাস তাঁদের ভুলে গেছে, এবং ভুলে গেছে আপামর বাঙালিও। তাই একসময়ের বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে এই দুই রাজার রাজত্বের এবং বীরত্বের কথা জানতে পারা যায়। রামায়ণের রাম লক্ষণের মতো ছিল চাঁদরায় ও কেদার রায়ের সম্পর্ক। দুই ভাই যেন একে অপরকে ছাড়া অন্ধকার দেখে। তাই একজনের বিপদে আর একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে মুশকিল আসানও হয়ে যায় বিভিন্ন সমস্যার। এভাবেই চলতে থাকে ভূঁইয়া চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের শ্রীপুর ও বিক্রমপুর রাজ্য। তাঁদের শ্রীপুর ছিল সোনার মতো সুন্দর। যেন রামায়ণের স্বর্ণলঙ্কা। সেখানে যেমন সুন্দর শস্য ফলত, ঠিক তেমন মানুষের ছিল না কোন দুঃখ দুর্দশা। সুখে শান্তিতে দুবেলা খেয়ে পড়ে সব প্রজারা নিশ্চিন্তে দিন কাটাত। তাঁদের রাজত্বে যেমন সোনার ফসল ফলত, ঠিক তেমন আবার বাঙালি শিল্পীদের হাতে লোহা গলিয়ে তৈরি হতো কামান। আর বিধ্বংসী সেইসব কামানের গোলায় শত্রুরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ত। তাঁদের বীরত্বের কথা তখন বাংলার বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল অতি অল্প সময়ের মধ্যেই। প্রজাদের কল্যাণের দিকেও ছিল তাঁদের নজর। পুকুর কাটিয়ে, ঘাট নির্মাণ করে, অথবা বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় নির্মাণ করে এবং আরও বিভিন্নভাবে প্রজাকল্যাণে তাঁদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। আর যে কারণে চারিদিকে মানুষ সন্তুষ্ট ছিল তাদের রাজাদের ভূমিকায়। সেই সুশাসনে প্রজারা দরজা খুলে রাতে শুয়ে পড়লেও চোরের উপদ্রব ছিল না। কারণ পাহাড়ার ব্যবস্থা এবং সঠিক শাস্তি অপরাধীর মধ্যে ভয়ের জন্ম দিত। 

এদিকে সেই সময় বাংলায় পর্তুগিজ জলদস্যুদের দাপট। ইউরোপ থেকে তারা ছোট ছোট ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাংলায় এসে পৌঁছতো৷ বাংলা তখন সোনার ভূমি। ইউরোপে বাংলার নুন, পশম ইত্যাদি জিনিসের খুব চাহিদা। আর সেই বণিকদের মধ্যে কিছু সম্প্রদায় ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর এবং ক্ষতিকর। মানুষ তাদের রীতিমতো ভয় পেতো। সেই সময় তারা মূলত চট্টগ্রামের আশেপাশে এবং আরাকান প্রদেশে জায়গা বানিয়ে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছিল। আর তার প্রভাব এসে পড়ত এই বাংলায়। মুঘলরাও তাদের কাজে সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু তাদের দমন করবার মতো ক্ষমতা বা সাহস বাংলার রাজন্যবর্গের হয়ে ওঠেনি। এমনকি ইশা খাঁ থেকে শুরু করে প্রতাপাদিত্য পর্যন্তও কেউ তাদের খুব একটা শায়েস্তা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেখানে রাজনীতির চাল চাললেন শ্রীপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায়। সরাসরি যুদ্ধে যে তাদের পরাস্ত করা যাবে না তা বুঝে তাঁরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করলেন। এবং একসময় তাদের দিয়েই মগদের দেশ থেকে তাড়ালেন। আসলে রাজনীতির চাল ছাড়া সেই সময়ের বাংলাকে শান্ত রাখার আর কোন অন্য উপায় ছিল না। বাংলা তখন রাজনীতিতে উত্তাল। এদিকে মগ, অন্যদিকে আরাকান, আবার আরেক দিক থেকে পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার - সব মিলিয়ে সে পরিস্থিতি বড় ভয়ঙ্কর এবং জটিল। আর সেই সময় অভ্যন্তরীণ মুঘল অত্যাচার তো ছিলই। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে বাংলার বারোভুঁইয়া এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নিজেদের জায়গা ধরে রাখার লড়াইটা লড়তেন। আর তার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে লড়াই তো ছিলই। যুদ্ধবিগ্রহের যেন কোন শেষই ছিল না। যেমন রামচন্দ্র রায়ের সঙ্গে লক্ষণমাণিক্যের লড়াই লেগেই থাকতো। ঠিক তেমন ভাবেই প্রতাপাদিত্যের সঙ্গেও লড়াই বেঁধেছিল রামচন্দ্রের। আবার এদিকে চাঁদ রায় কেদার রায়ের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয় সোনারগাঁয়ের ইশা খাঁয়ের৷ যদিও প্রথম থেকেই সে লড়াই ছিল না। পরে বাংলার এই দুই ভূঁইয়ার মধ্যে লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করে। আর তার মূলে ছিল এক রমণী। চাঁদরায়ের বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ী দেবী। সেই ঘটনায় না হয় পরে আসব। কিন্তু প্রথমে আসি একটু শ্রীপুরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে। রাজাদের গৃহদেবতা ছিলেন কোটীশ্বর। ভক্তিভরে রাজ পরিবারের তরফে সেই দেবতার পুজো করা হত৷ আর তার প্রধান পুরোহিত ছিলেন শ্রীমন্ত খাঁ। কিন্তু শ্রীপুরের ইতিহাসে এই ব্যক্তির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ সব মিলিয়ে প্রজারা খুশি থাকলেও এবং তৎকালীন শ্রীপুরে কোনো প্রজাবিদ্রোহের সৃষ্টি না হলেও রাজাদের মনে শান্তি ছিল না। একদিকে যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণ, তেমন আবার অভ্যন্তরে বিভিন্ন রকম রাজনীতি। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে শ্রীপুর এবং বিক্রমপুর পরগনা বাংলার ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা দখল করে নেয়। আর তার সঙ্গে উচ্চারিত হয় এই রাজ্যের বিখ্যাত দুই রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের নাম।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register