শীত শুরু হওয়ার সময় থেকেই হিমালয়ের গুহাবাসী সাধু সন্ন্যাসীরা তাদের বাসস্থান ছেড়ে দলে দলে নীচে আসেন। এই দুজনও যে তাদেরই দলের, একথা পরে গুরুপদবাবার কাছ থেকে জেনেছি। এই দীর্ঘদেহী সাধুটি যে বাঙালি, সেটা ওর শ্রীমুখ দেখে একেবারে বোঝার উপায় নেই। একদমই উত্তর ভারতীয় বৈদিক সাধুদের মতো চেহারা। শুধুমাত্র রক্তাম্বরের কারণেই ওকে শাক্তমতে দীক্ষিত বলে বোঝা যায়। ওর সঙ্গী ভদ্রলোক একেবারেই একজন সাধারণ হিন্দিভাষী মানুষজনের মতো দেখতে।
ধ্রুবদা চোখের ইশারায় আমাকে ওর কাছে ডেকে নিলেন। কাছে গেলে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
--" ইনি হইলেন সুবুদ্ধ মহারাজ। পরম যোগী। কূমায়ুনের গুহাবাসী। এনার বয়স কতো ক' দেখি "
আমি ঠোঁট ওল্টালাম,
-- " লোকে কয় একশো আশী বছর, কিন্তু ওনারে জিজ্ঞেস করলে শুধু গোঁফের তলায় মুচকি হাসি দেন। "
--" কি বলো? একশো আশী? ধুস, যত্তোসব গাঁজাখুরি গল্প। ওনার কতো হবে, বড়জোর পঁয়ষট্টি --
--" দ্যাখ, আমি তো আর ওনার লগে থাইক্যা দেখি নাই, তবে গুরুপদবাবার কাসে শুনসি এইসমস্ত মানুষেরা যোগসাধনা কইরা তেনাগো শরীররে এক জায়গায় ধইরা রাখেন। ত্রৈলঙ্গস্বামীর নাম শুনছস? রামঠাকুর, যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী, এইরকম আরও অনেক যোগী আছেন যারা শুধুমাত্র --"
আমার কিশোরাবস্থায় একজন সাধুকে একবার আমাদের পাড়ার পুকুরের জলে ভেসে থাকতে দেখেছিলাম। একটা শুকনো কাঠ যেভাবে জলে ভাসে, তিনিও তেমনি করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জলে ভেসে থাকতে পারতেন। এরকমভাবে ভেসে থাকাকে নাকি কুম্ভক বলে। সেই ভদ্রলোক যাদের বাড়ি উঠেছিলেন, তাঁর সেই শিষ্যদের মুখে শুনেছিলাম সেই সাধুর বয়স ছিলো নাকি একশো চল্লিশ বছর।
কথা বলতে বলতে আমরা যে কখন শ্মশানের ওদিকটায় ফেরিঘাটের সামনে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। হঠাৎ ধ্রুবদার নাম করে একজন কেউ ডাক দিতে খেয়াল হলো। দেখি সোনাবাবা, বেশ বড় বড় দুটো ব্যাগ ভর্তি মালপত্র নিয়ে ঘাটের এপারে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। --" ও ধ্রুববাবু, একটু এদিকে আসেন না কেনে গো.. "
ধ্রুবদা ব্যস্তসমস্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। আমিও গেলাম পিছুপিছু। দেখি, দু'ব্যাগ ভর্তি চাল, ডাল, সবজি, ফল, ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোনাদা।
--" একটু হাত লাগান না গো --"
--" নিশ্চয়, নিশ্চয় -- তা এতো বাজার কিসের লিগ্যা? হিমালয়ের সাধুবাবারা কি আইজ কোনো --"
--" আরে না রে বাপু, আজ যে মা জগদ্ধাত্রীর পুজো গো। সেজন্য ভান্ডারার আর পুজোর ব্যবস্থা। "
আজ জগদ্ধাত্রীপুজো? তার মানে, আজ চন্দননগর জুড়ে আলোর বন্যা ?
-- " একটু হাত লাগাও না পদীপ ভাই। এই বোঝা একা আমার পক্ষে.. "
--" আরে আপনে চিন্তা কইরেন না। তুই একটা ব্যাগ ধর আর আমি আর সোনাদা দুইজনে অন্যডারে লইতাসি। "
আমার ভাগে যে ব্যাগটা পড়লো সেটার প্রায় তিরিশ কিলো ওজন হবে। চাল, ডাল, আলু আর মুদিমশলা। ঘাট থেকে আশ্রম -- এই দেড় দু'শো মিটার পর্যন্ত নিয়ে যেতেই যেন একদম কালঘাম বেরিয়ে গেল।
--" দেখো গুরুপদ, শরীরের একটা ওজন আছে। সেই ওজনটাকে বাদ দিয়ে যদি মনকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তাহলে শরীরও মনের সাথে বেঁচে থাকে। "
-- " এটা কীভাবে সম্ভব? শরীর বাদ দিয়ে শুধু মন বাঁচে কীভাবে? "
--" বাঁচে গো, বাঁচে। শরীরটা আসলে কী? একটা খাঁচা। দেহপিঞ্জর। আর মন হচ্ছে গিয়ে পাখি। ধরো, একটা ছোট্ট খাঁচার ভেতর যদি পাখিটাকে বন্দী করে রাখো? তাহলে কী হবে? "
--" পাখিটা ছটফট করবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য। "
--" ঠিক। এবারে খাঁচাটাকে যদি এমন বড় করে বানানো যায়, যে সেটার মধ্যে একটুকরো বনকে সেঁধিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পাখিটা সেই খাঁচার ভেতর আর ছটফট করবে না। সে মিষ্টি সুরে গান গাইবে, এ ডাল সে ডালে উড়ে বেড়াবে, ফল খাবে, ফুলের মধু পান করবে। কি করবে কি না?"
কথাগুলো বলে সেই খর্বাকৃতি সাধু গুরুপদবাবার দিকে চাইলেন।
--" রিপুগুলো আমাদের শরীরটাকে আটকে রাখে, ওটাকে বড় হতে দেয় না, তাই সেই ছোট পিঞ্জরে আবদ্ধ পাখিটাও শুধুমাত্র রিপুর দংশনে ছটফট করতে থাকে। শরীরকে যতো রিপুমুক্ত করো, ততই সে শরীরে তৈরি হতে থাকবে ঈশ্বরের বাগান। নির্মোহ বাগিচায় প্রেমের ফুল ফুটবে, সাধনার ফল ফলবে, আর মনপাখি সে বাগিচায় ঈশ্বরের পূজা সঙ্গীতে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে। "
0 Comments.