Tue 18 November 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ১৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ১৩)

ক্ষণিক বসন্ত

দুর্গা কুর্গে ফিরে আসতেই কেমন যেন ভিতর ভিতর হাল্কা লাগছিল দুর্গার। কে বলবে এই দুর্গা কয়েক দিন আগেই মুম্বই পুলিশের স্পেশাল অপারেশনে মুলতান শেখের মতো একজন বড় ক্রাইমলর্ডকে কুপোকাত করে এখন তার বাড়ি ছুটি কাটাতে এসেছে। কুর্গের পাহাড়ি স্টেশন থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে তার বাড়ি। সেখানেই দুর্গা রেশমি উন্নিথান বড় হয়েছে। অবশ্য তার এক দোসর বন্ধুও ছিল সেখানে। গিরিজা আইয়ার গোমস। দুর্গারা হিন্দু আর গিরিজারা ক্রিশ্চান। কিন্তু দুজনেরই আরাধ্য দেবতা এক। ভরতনাট্যম। দুর্গা আড়াইমণ্ডীতে দাঁড়ানোমাত্র গিরিজা তান ধরবে হারমোনিয়ামে। গিরিজার তান আর দুর্গার পায়ের নুপূর একে অপরকে টেক্কা দিতে চাইবে। জীবনের নাটমঞ্চেও অনেকটা তেমনই। দুর্গা আইপিএস ক্র্যাক করতেই গিরিজা জেদ ধরল। তার আইপিএস হবে না চোখের কারণে। ছোটবেলা থেকেই তার চোখে নানান সমস্যা। কিন্তু তাতে কী? গিরিজা দিন রাত এক করে পড়াশোনা করে অবশেষে বাঙ্গালোরের একটি ল স্কুলে ভর্তি হয়েছে।পরে সে তার নিজের বাবা মাকেও বাঙ্গালোর নিয়ে যাবে বলে মনস্থির করেছে। গিরিজার সঙ্গে তার যতোই রেষারেষি থাকুক, মনে মনে তাকে খুব মিস করে দুর্গা। স্টেশনে নেমে লাগেজ অটোতে তুলেই দুর্গা প্রথমে ভাবল গিরিজার কাছে যাবে। পরক্ষণে সে মত বদল হল। ফোন করে জেনে নিতে আগে কখন সে থাকছে ঘরে। বরং পথেই তার নাচের গুরুমার বাড়ি। গুরুমা এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও ল্যাণ্ডলাইন মোবাইল ফোন রাখেন না। মুম্বাই পুলিশে কাজের ব্যস্ততার ভিতরেও দুর্গা দু একবার চিঠি লিখেছিল গুরুমাকে। প্রথমে চিঠির উত্তর আসত। পরবর্তীতে আর আসেনি। ঘর থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি ভালো নেই। দুর্গা ঠিক করল ঘরে ঢোকার আগে তার গুরুমার ঘরে একবার দেখা করে যাবে। অটোকে সেই মতো নির্দেশ দিয়ে দুর্গা মোবাইলে গিরিজাকে একটা মেসেজ করে দিল। গিরিজা অফলাইন। তাৎক্ষণিক উত্তর এল না। পাহাড়ি মোড় পেরিয়ে নারায়ণমন্দিরের পাশেই ভারতনাট্যম কিংবদন্তী ধর্মাবতী কৃষ্ণমূর্তির ঘর। ছোট টালির ছাদ। সামনে দাওয়া। সেখানে সিঁড়ির ওপর চালের গুঁড়ো দিয়ে যত্ন করে কোলাম আঁকা। গুরুমার কোনও শিষ্যা এঁকে রেখেছে হয়তো। সিঁড়িতে প্রণাম করে দুর্গা লাগেজ আর চটি বাইরে রেখে আলতো করে ভেজানো দরজায় চাপ দিল। দরজা ইষৎ খুলতেই দেখা গেল খাটের উপর গুরুমা শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। এতো বছর পরেও তার মুখের বিভা এতোটুকু কমেনি। কিন্তু দেহ স্থুলতর হয়েছে। আর শরীরে সামান্য অসুস্থতার স্বাক্ষর পড়েছে যেন। দরজা খোলার আওয়াজে গুরুমা চোখ খুলেই দুর্গাকে দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর তার দুই চোখ দিয়ে অঝোরধারায় জল গড়িয়ে পড়ল। দুর্গা তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই তিনি পরম মমতায় তার চুলে মাথায় বিলি কেটে কী যেন বলতে চাইলেন। খাটের উপর উঠে বসতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন ক্লান্তিতে। সেইসব শব্দে ভিতর থেকে বাসনের শব্দ শোনা গেল। এক তামিল তরুণী ঘরে দৌড়ে এসে দুর্গার দিকে তাকিয়ে রইল অবাক চোখে। দুর্গা সেই বিস্ময় লাঘব করতেই বলল। -বনক্কম। মেয়েটি কড়জোরে প্রত্যুত্তর জানিয়ে জানাল সে গুরুমার কাছেই থাকে। গুরুমা বিয়ে করেননি। একাএকাই থাকেন। গেল দুই বছরে গুরুমার পরপর দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে। দ্বিতীয় স্ট্রোক এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে ডাক্তার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর জীবন ফিরে পেলেও গুরুমা তার কথা বলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন। চলচ্ছক্তিও। মেয়েটির নাম ভূপেশ্বরী। দুর্গার বড় ভালো লেগে গেল মেয়েটিকে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে এখন। ওর মা গুরুমার ছাত্রী ছিল। এখন ভূপেশ্বরী হয়তো তার মায়ের হয়েই গুরুদক্ষিণা দিয়ে চলেছে। গুরুমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার কাঁপা কাঁপা হাত যেন দুর্গাকে অনন্ত আশীর্বাদে ভরিয়ে তুলছিল। দুর্গা বুঝতে পারছিল কেন সে তার চিঠির উত্তর পাচ্ছিল না। ভূপেশ্বরী তাকে থেকে যেতে বলছিল আরও খানিকক্ষণ। কিন্তু দুর্গা আর দাঁড়াল না। তাকে এইবার বাড়ির দিকে যেতে হবে। আবার পরে আসবে জানিয়ে উঠোন থেকে সাবধানে কোলামটুকু বাঁচিয়ে নেমে জুতো গলাতে গলাতে দুর্গা ভাবছিল। মানুষের জীবন কতো অনিশ্চিত। কতো ক্ষণস্থায়ী। শুধু যদি কিছু চিরকাল থেকে যাবার হয়, তা হল সঙ্গীত আর ভরতনাট্যম। দুর্গার ঘর গুরুমার ঘরের পাশেই। অটো করে বড় জোর মিনিটচারেক। পাহাড়ি পথে অটো চলে দুলকি গতিতে। দুর্গার বাবারা চার ভাই। যৌথপরিবারে দুর্গার বাবা সেজ। একটা পরিবারের এতোগুলো পাতের ভিতরেও দুর্গার ভাগ আরও কম হয়ে আসে যখন দুর্গার বাবা আর মায়ের তার দুই ভায়েদের প্রতি পক্ষপাত আর গোপন থাকে না। দুর্গার দুই ভাই এখন স্টেশনসংলগ্ন একটি দোকান ভাড়া করে মুদীখানার সরঞ্জাম বিক্রি করে। ইদানিং দুর্গার পুলিশি খবর প্রচার হওয়াতে দুর্গাদের পরিবারের সকলে ছোটখাটো কাজ সারিয়ে নেয় তাকে দিয়ে। মেজ জ্যাঠা লোক পাঠাতেন মুম্বাইয়ে নানান কাজ নিয়ে। আজ দুর্গা মনে মনে হাসে। শহরে ভরতনাট্যম অনুষ্ঠান করার অপরাধে এই জ্যাঠাই তো একদিন তাকে 'পরাত্তাইয়ার' বলতে ছাড়েনি।পরাত্তাইয়ার মানে যে 'বেশ্যা' সেটা সতেরো বছর বয়সে দুর্গা বুঝে গিয়েছিল।তার বাবা মা সেদিন তেমন প্রতিবাদ করেনি। কেউই ছিল না পাশে গিরিজা আর গুরুমা ছাড়া। বাড়ির কাছাকাছি আসার সঙ্গে তাই নিজের ভিতরেই কেমন একটা বিচ্ছিন্নভাব অনুভব করল সে। নিজের অজান্তেই আবার মোবাইলের দিকে হাত চলে গেল তার। সারা ইন্টারনেট জুড়ে তার জয়ধ্বনি বেশ মুখরিত হয়ে চলেছে। কিন্তু সেইসব দুর্গাকে তেমন স্পর্শ করতে পারল না। সে দেখল গিরিজা তাকে আসতে বলেছে। গিরিজা লিখেছে। -তায়াভু সেতু ভালুনকাই। দুর্গা ভাবল। গিরিজা ঘরের দরজা ভেজানো। তার বাড়ির পাশের বাড়িটিই তার। সে শুনতে পেল তার নিজের ঘরের আধা ভেজানো দরজা দিয়ে ভিতরের ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। ন্যদিকে গিরিজার ঘর থেকে মৃদু হারমোনিয়ামের শব্দ ভেসে আসছে। অত্যন্ত মৃদু স্বরে গিরিজা গাইছে। এতোগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও দুর্গা ভুল করল না। সার্ভিস রিভলভারের বুলেটের মতোই তার সিদ্ধান্ত মুহূর্তে নিবদ্ধ হয়ে উঠল। সে লাগেজ সমেত গিরিজার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। গিরিজা ভাবতন্ময় হয়ে যোগিনীর মতো গাইছে। প্রণামু প্রণভাকরম। দেয়াভু লয়কারাম। ভঙ্গিনা অভিনয়রূপম। দুর্গা নিঃশব্দে বসে পড়ল মাটিতে। তার শরীরের ভিতর কী যেন এক কুহুতান জেগে উঠছে। তার হৃদস্পন্দন যেন আপনমনে বেজে উঠছে নাচের তালে। তা ধিন তাত ধিন। তা ধিন তাতা ধিন। তা তেরেকেটে ধিন নানা তিন। তার আত্মা যেন আর তার অধীনে নেই। সে আর মুম্বাই পুলিশের স্পেশাল অফিসার নয়, কুর্গ নিবাসী নয়। স্বর্গের কোনও নাটমন্দিরে তার অমলভঙ্গিমা যেন ক্রমশ মূর্ত হয়ে উঠছে। দুর্গা নিজের অজান্তেই যেন বশীভূত রোবটের মতো উঠে দাঁড়াল। যেভাবে কোনও মন্ত্রমুগ্ধ সাপিনী তার ফনা তুলে জেগে ওঠে। তারপর সে ধীরে ধীরে তার পায়ে ঝঙ্কারে ফুটিয়ে তুলল নটরাজমূর্তি। তালেতালে গিরিজাও এইবার চোখ খুলে দেখল তার অনয়া আরাধিকা যেন মানবী শরীর পেয়েছে। সে এক অপূর্ব পৃথিবী যেখানে শুধুমাত্র নৃত্য আর সঙ্গীত রয়েছে।বাকি সব সেখানে গৌণ। গিরিজার ঘরের পিছনেই নারিকেল আর কফি গাছের বন। জানলা দিয়ে সামান্য নীচ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন দেখতে পাওয়া যায়। দুর্গা আর গিরিজা আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে সেইদিকেই তাকিয়ে ছিল। তাদের দুই শরীর যেন সে মুহূর্তে অবিচ্ছিন্ন এক সত্তা। গিরিজা দুর্গার সঙ্গে দেখা করতে বাবা মাকে বাঙ্গালোর রেখে একাই এসেছে। দুর্গার শরীরে এক দুরারোগ্য ব্যাধি দানা বাঁধছে। দুর্গার ঘরে সে কথা কেউ জানে না। গিরিজা দুর্গার অধরে নিজের ওষ্ঠ রেখে মনে মনে তার অবশিষ্ট শ্বাসপ্রশ্বাসটুকুও তার সমকামিনীকে অর্পণ করতে চায়। তবু ভয়ানক দুশ্চিন্তায় সেই মুহূর্ত কেঁপে ওঠে যেন। এই রোগ ক্রমশ দুর্গাকে মূর্তির মতো শিথিল করে দেবে। আর সে নাচতে পারবে না, বড় বড় মাফিয়া গুণ্ডাদের এক চুটকিতে পরাস্ত করতে পারবে না। দুর্গা তাকিয়ে থাকে গিরিজার দিকে। গিরিজা দুর্গার দিকে। হঠাৎ দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠে। -নান উন্নে নেছিকেরে। কেন তারা বিয়ে করছে না ঘরের লোক কী সে খোঁজ রাখে? সঙ্গীত বিনা নৃত্য অসম্পূর্ণ, তাল বিনা সুর, আর দুর্গা বিনা গিরিজা। এই উচ্চারণ যে ভালোবাসার উচ্চারণ। তার কোনও ক্ষয় নেই, জরা নেই। একে অপরের সম্পৃক্ত। ফোন বেজে চলে দুজনেরই। অথচ কেউ সেই কল রিসিভ করে না। পৃথিবীতে অন্তত একটি মুহূর্তক্ষণ তাদের নিজস্ব হয়ে থাক। থাকলে ক্ষতি কী?
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register