Tue 18 November 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৮)

শহরতলির ইতিকথা

নৈহাটি থেকে গোরার জন্য কাছা ও ওড়নির কাপড় কিনে, মেজো মামা এসে পৌঁছে গেছে; গোরাই মুখাগ্নি করবে, তাই গোরাই কাছা পড়বে,কৃষ্ণকে কাছা পড়তে হবে না। মামার বাড়ি থেকে কারুর আসার অপেক্ষায়, সবাই দাদুর নশ্বর দেহ বাড়ির সামনে খাটুলিতে রেখে অপেক্ষা করছিল। এবার হরি-বোল,বল-হরি বলে পাড়ার ছেলেরা খাটুলি কাঁধে তুললো,গোরা-কৃষ্ঞকে,একবার কাঁধ ছুঁইয়ে, পাড়ার ছেলেরা কাঁধে নিয়ে চলেছে খাটুলি; দাদু স্বর্গারোহণে চলেছেন। রমেনের বাবা, ন্যায়তীর্থমশাই, ভ্রাতৃপ্রতিমকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলেন।

পাড়ার গঙ্গার ঘাটে, মিউনিসিপ্যালিটির দেওয়া কাঠ মিলবে না, তাই খাটুলি বহে নিয়ে যাবার জন্য ছেলেরা বাদে, অন্যরা দাদুর গোয়ালে থাকা শুকনো বাবলা কাঠ, রিলে পদ্ধতিতে ঘাটে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছে। পাড়ার জাগৃতি সংঘের ছেলের সংখ্যাও তো কম নয়,দাদুও ছিলেন সঙ্ঘের অন্যতম পৃষ্টপোষক; সুতরাং দাদুর শেষ যাত্রায় সবাই শরিক। রিলে করে কাঠ নিয়ে যাবার সময় দেখে,পাড়ার ডাক্তার দাদা, এত রাতেও রেলিং-এ বুক চেপে, চিন্তিত মুখে সিগারেট খাচ্ছে;রজতকে দেখে বললো,"পারলাম না রে, দাদুরে রাখতে পারলাম না"; শেষ সময়ে,ডাক্তারদা-ই,দাদুর চিকিৎসা করেছিল; বললো, "দ্যাখস দাদুর কাজ যেন ঠিকমত হয়।"

রজতও ওর বন্ধুরা বলাবলি করে,ডাক্তার এইরকমই হওয়া উচিত; মানুষ তো মরবেই,ডাক্তার তো আর ভগবান নয়,যদি ডাক্তারেরা চেষ্টা করে, রোগীর বাড়ির মানুষের সহমর্মী হয়,তবে তো হাসপাতালগুলোতে যে প্রায়শ গণ্ডগোল দেখা যায়,তা বন্ধ হতে পারে,স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক সমস্যাই সুস্থ পরিবেশে দূর করা সম্ভব; না, সে তো আর হয় না; এ পোড়া দেশে,ডাক্তার মানেই যেন অন্য গ্রহের মানুষ; রোগীদের প্রতি অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য মনোভাবই সমস্ত গণ্ডগোলের একটা অন্যতম কারন হয়ে থাকে।

শ্মশানে দাদুর মরদেহ আনা হয়েছে।

রমেনের দাদা, রজতের "বাবার ঘড়ি",গোরা ও কৃষ্ণকে গঙ্গার জলে মুখ হাত ধুইয়ে আসতে বললেন। ওদের মধ্যে কয়েকজন,মেইন রাস্তার উপরে সাইকেল সারাবার দোকানের টালির চালের উপর থাকা দুটো খারাপ সাইকেল টায়ার আনতে গেছে; টায়ার দিয়ে চিতার কাঠ ধরানো সহজ হবে।

একদিকে পারত্রিক ক্রিয়া-কলাপের মন্ত্র পাঠ করানো চলছে, তিলও আতপ চাল দিয়ে চটকে পিণ্ড করে যা, যা করণীয়, সব রমেনের দাদা,বাবার কাছ থেকে লিখে নেওয়া নির্দেশ মত ক্রিয়া সম্পন্ন করে, দাদুর সারা শরীর ঘি ও জল লেপা সম্পন্ন করে সাদা কাপড়ে ঢেকে দিয়েছেন, অন্যদিকে দাদুর লাশের মাপে গর্ত করে তার উপর মোটা মোটা কাঠের লগগুলো সাজিয়ে চিতার প্রস্তুতি চলছে। পারত্রিক ক্রিয়া-কলাপ শেষ হলে, দাদুর নশ্বর দেহ ঐ সাজানো কাঠের উপর শোয়ানো হল। এবার গোরাকে দিয়ে,সঙ্গে আনা পাটকাঠিতে আগুণ ধরিয়ে দাদুর মুখাগ্নি সম্পন্ন হল; কৃষ্ণ, গোরাকে ধরে পাটকাঠির আগুন সমেত দাদুর নশ্বরদেহের চারদিকে ঘুরে, দাদুর মুখে আগুণ ছুঁইয়ে পাড়ের উপর ওঠে গেছে। এবার সবাই একটা একটা করে রমেনের দাদার নির্দেশ মত কাঠ সাজিয়ে, চিতার তলার গর্তে টায়ার জ্বালানো হয়েছে।শুকনো কাঠ,অল্প-চেষ্টাতেই আগুণ ধরেছে।

কিছুক্ষণ পরেই, আগুনের লেলিহান শিখায় দাদুর নশ্বর দেহ পুড়তে আরম্ভ করলো; সবাই আছে নিঃস্তব্ধ, আগুণের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে;মনে হচ্ছে, ঐ শিখায় স্বর্গের পথে দাদু যাত্রা শুরু করেছেন,সবাইকে আশীর্বাদ করে চলেছেন,কখন যে সবাই হাতজোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে আছে দাঁড়িয়ে, জানে না। কিছুক্ষণ পরে,রমেনের দাদা, কাঠগুলোকে খুঁচিয়ে দিতে বলায়,ছেলেরা সম্বিতে ফিরলো। সবাই যেন কিছুক্ষণের জন্য দার্শনিক হয়ে গেছে; রজতের মনে হোল, সব স্বার্থপর মানুষগুলোকে, মাঝে,মাঝে, শ্মশানমুখী করাতে পারলে, সমাজ থেকে হয়তো অন্যায়, অবিচার,অসৎ প্রবৃত্তির প্রবনতা কমার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

দাহ শেষ, চিতা থেকে, নাভিকুণ্ডলীর অবশিষ্টাংশ নিয়ে মাটির মধ্যে পুরে, গোরা-কৃষ্ণকে জলে ভাসিয়ে দিতে বললেন। এবার চিতা নেভানোর পালা। সবাই কলসী করে জল এনে চিতা নিভিয়ে ঘরে ফেরা। ঊষার আলো উঁকি দিচ্ছে,সবাই গোরাদের বাড়ি ঘুরে,নিজের নিজের বাড়ি চলে এসেচে। মনটা ভারাক্রান্ত; স্বজন-হারা হলে বোধ হয় এ রকমই অনুভূতি হয়!

হাতে সময় নেই,দাদুর পারলৌকিক কাজকর্ম সাড়তে হবে নির্বিঘ্নে। গোরার মেশোমশাইরা, এসব সামলাচ্ছেন।দাদুর অবর্তমানে, ঐ মেশোরাই এখন ওদের গার্জেন। রাণীদি ও তার বরও রয়েছেন; তিনি এখান থেকেই কোলকাতার অফিসে, যাতায়াত করছেন; পাড়ার ছেলেদের দিয়ে টুকিটাকি কাজ করাচ্ছেন। গোরার মা,জেঠিমা 'র মুখে একটা উদ্বেগের ভাব চোখে পড়ছে;পাগল ছেলেদের নিয়ে,দাদু যে কী মনোকষ্টে ছিলেন, তা কখনো বৌমাও নাতি-নাতনীদের বুঝতে দেননি, বটবৃক্ষের মত সবাইকে আগলে রেখেছিলেন; সেই বৃক্ষ আজ অন্তর্হিত, সবাই রয়েছে একটা অনিশ্চয়তার উদ্বেগে। বামুন,তাই শ্রাদ্ধাদি হবে দশ দিনে,অনেক কাজ,পাড়ার ছেলেরা সবাই, যে কোনও কাজ করতে পরাঙ্মুক নয়।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register