Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ১৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ১৯)

কেল্লা নিজামতের পথে

গিরিয়ার প্রান্তর। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে এ যেন আর এক অধ্যায়। পলাশী মনে রেখেছে মানুষ। কিন্তু ভুলে গেছে গিরিয়া। হয়তো মানুষ ভুলে গেছে সরফরাজকেও। সে যুগের ক'জন মানুষই বা জানত রাজা-রাজড়াদের কথা? নিজের ঘরের চাল আনতে পান্তা পুরনো অবস্থায় কজনই বা খোঁজ রাখতো মুর্শিদাবাদের সিংহাসনের দিকে? মুর্শিদাবাদ ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি আসলে নবাবী সিংহাসন এক জনবিচ্ছিন্ন শাসকের ভার বহনকারী হুংকার এর জায়গা ছাড়া আর কিছুই নয়। মুর্শিদাবাদই বা কতটুকু খোঁজ রাখতো সেই বিশাল বাংলা বিহার উড়িষ্যা সুবার? শুধুমাত্র ইংরেজ আগমনের কালো অধ্যায় হিসেবে আজও মানুষ কেমন সুন্দর করে মনে রেখেছে পলাশীর কথা। কিন্তু গিরিয়ার তেমন কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব কোথায়? আলীবর্দী খাঁ আর সরফরাজ খাঁয়ের লড়াইটাই বা কজন মানুষ জানতে পেরেছিল সেই যুগে? আজ মিডিয়া এবং খবরের কল্যাণে মানুষ দেশের রাজনৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে কতই না ওয়াকিবহাল। কিন্তু সে যুগে? সত্যি কি হঠাৎ করে দেখা কোনো জাঁকজমকপূর্ণ হাতি ঘোড়ায় অধিষ্ঠিত শাসককে দেখে সাধারণ মানুষ চিনে উঠতে পারতো নবাব বলে? সেখানে গিরিয়ার যুদ্ধ আর রাজধানীর পট পরিবর্তন তো দূরের কথা। তবু গিরিয়া ঘটেছিল, যা মুর্শিদাবাদের মাটিতে ঘটে যাওয়া একমাত্র প্রহসনবিহীন যুদ্ধ। নবাব সরফরাজের ছিল সিংহাসন বাঁচানোর লড়াই। আর আলীবর্দির জন্য এ ছিল নবাবী আসন দখলের লড়াই। আসলে বিশ্বাসঘাতকতার তকমা সেটা দেওয়ার আগে কিছু বিচার বিবেচনা করা তো অবশ্যই প্রয়োজন। আর সময়কাল বিচার করাটাও আশু প্রয়োজন। একদিকে নবাব সরফরাজের অধীনে পরপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সেনাপতি গাউস খাঁ এবং সরফ-উদ্দিন। তারপর হোসেন খাঁ মহম্মদ, মীর মহম্মদ বাকর খাঁ, মীর কামেল, মীর গদাই, বিজয় সিংহ, রাজা গন্ধর্ব সিংহ, পঞ্চু ফিরিঙ্গী, ফৌজদার সুজাকুলী খাঁ, মীর হাবিব, মর্দান আলি খাঁয়ের মত যোদ্ধারা। আর বিপরীতে আলীবর্দীর পাশে মোস্তাফা খাঁ, সামসের খাঁ, রহিম খাঁ, করিম খাঁ, ছেদন হাজারী, মীর মোহম্মদ মাসুম, বক্তার সিংহ, সেনাপতি নন্দলাল, আলিবর্দীর জামাই নওয়াজেশ মোহম্মদ খাঁয়ের মত যোদ্ধারা। মুখোমুখি অবস্থান। যুদ্ধ অনিবার্য। লক্ষ্য বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবী মসনদ। যুদ্ধের পরিণতি বর্ণনার আগে আলীবর্দী খায়ের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বিচার বিবেচনা করা খুব প্রাসঙ্গিক। মুর্শিদাবাদের পথে চলতে চলতে যে আলিবর্দী সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তিনি বিশ্বাসঘাতক এবং চক্রান্তের প্রধান সূত্রধর এ কথা বিশ্বাস করতে যেন অনেকটাই বেগ পেতে হয়। ধর্মপরায়ণ এবং প্রজাবৎসল আলিবর্দী মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে একজন সত্যিকারের সুশাসক এবং দীর্ঘদিন সংগঠনে বসে থাকা নবাব। আর সময়ে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। সুজাউদ্দিনের পর আলিবর্দী, বাংলা দেখেছিল এক প্রকৃত সাহসী নবাবকে। কিন্তু মাত্র এক বছর নবাব থাকা সরফরাজের ইন্দ্রিয় পরায়নতা মুর্শিদাবাদের মাটিতে বেশ চর্চিত একটি বিষয়। তবু প্রভুর পুত্র সরফরাজের প্রতি চিরকালই নমনীয় স্বভাবের ছিলেন আলিবর্দী। এমনকি যুদ্ধের শুরুতেও তিনি কখনোই সরফরাজের হত্যা চাননি। যুদ্ধে জয়লাভ করলে নবাব কে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন আর হেরে গেলে তার আজ্ঞাবহ দাস হয়ে বাকি জীবন বসবাস করবেন, এমনই সংকল্প ছিল আলিবর্দীর। যদিও যুদ্ধের সময় সেইসব কতটা মাথায় নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। সিংহাসনে বসার পর আর যাই হোক সরফরাজ সুশাসক ছিলেন না। যেমন একটি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যাক। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা বলছেন, আক্রমণের সময় যেভাবে সামনে থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আলীবর্দী, তা যদি সরফরাজ খাঁ থাকাকালীন হত, তবে বাংলার যে আরো করুন হাল হত তা সহজেই করে নেওয়া যায়। পালা পরিবর্তন হয়েছে মুর্শিদাবাদে। অনেকের পিঠেই পড়েছে বিশ্বাসঘাতকের তকমা। কিন্তু সেকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক জমিটায় দাঁড়িয়ে বিচার করলে সিদ্ধান্ত অনেকগুলো মাপকাঠির উপর সুতোর মতো দাঁড়িয়ে যায়। আর এই সুতোগুলোর ওপর হাঁটতে হাঁটতে বারবার প্রশ্ন করতে হয়, ইতিহাস তুমি কিসের কথা বল? আসলে কারা বিশ্বাসঘাতক? আলীবর্দী খাঁ? হাজী মোহম্মদ? মীরজাফর? ঘসেটি বেগম? রাজা রাজবল্লভ? জগতশেঠ? প্রশ্নটা সত্যিই আপেক্ষিক। হয়তো সময়ের চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে চাপা পড়ে গেছে ওই কেল্লা নিজামতের ভাঙা ইটগুলোর নিচেই। যুদ্ধের কথায় ফেরা যাক। নবাব সরফরাজ তার পুত্র হাফেজ উল্লা বা মীর্জা আমানীকে ফৌজদার ইয়াসিন কার সাথে কেল্লা সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাজধানী থেকে। লক্ষ্য তার যুদ্ধক্ষেত্র। সেদিনের যুদ্ধ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। বলেন বহু অর্থ ব্যয় করে আলীবর্দী সেদিন হাত করেছিল নবাবের সেনাপতিদের। আবার কারো মতে গিরিয়ার যুদ্ধ এ কেমন যুদ্ধ, মুর্শিদাবাদের মাটিতে একমাত্র যেখানে নবাবের মৃত্যুর পরেও তার সেনাপতিরা বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে গেছিলেন আলীবর্দির বিরুদ্ধে। রাত পেরিয়ে ভোর হতেই খেপে খেপে যুদ্ধ চলে বিভিন্ন সেনাপতিদের মধ্যে। প্রথমে নন্দলাল এবং গাউস খাঁর মধ্যে চলতে থাকে আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণ। পরে সেনাপতিদের মধ্যে আলাদা আলাদা করে যুদ্ধ শুরু হয় নদীর ধার ঘেঁষে। আলিবর্দী কী ভেবেছিলেন আর তার যুদ্ধসাজ তাকে কী করিয়েছিল সে বিচার হয়ত গিরিয়াই জানে। কারণ যুদ্ধের পরিণতি ছিল নবাব সরফরাজের মৃত্যু। হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধের ময়দানে সামনা সামনি হবার মুহূর্তেই বন্দুকের গুলি এসে বিঁধে যায় তার শরীরে। তারপর আর তার প্রাণ তাকে রাজধানী রক্ষায় সঙ্গ দেয়নি। সেই হাতির পিঠেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে হাতির অভিমুখ বদলে নবাবের নিথর শরীর নিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে আসে রক্ষী। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হল সরফরাজের হত্যার পরেও বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যায় তার সেনাপতিরা। মুর্শিদাবাদের নবাবী ইতিহাসে কে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ পলাশীর প্রান্তরে যে প্রহসন এবং চক্রান্ত দেখা গেছিল, তার কিছুকাল আগেও এই প্রহসনের শিকার হয়নি গিরিয়া। নবাবের পরাজয় হয়েছে ঠিকই, আলীবর্দীও পেয়েছেন নবাবী সিংহাসন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে প্রহসন হাজির করেনি বিজয় সিংহ, গাউস খাঁ রা। এমনকি মুর্শিদাবাদের আকাশে বাতাসে আজও কান পাতলে শোনা যায় গিরিয়ার ময়দানে সেদিন বিজয় সিংহের নয় বছরের পুত্র জালিম সিংহের বীরত্বের কথা। পিতার মৃত্যুর পর জালিম সিংহ তরোয়াল হাতে রুখে দাঁড়ায় আলীবর্দির প্রশিক্ষিত সেনাপতিদের সামনে। তখন তার বয়স মাত্র নয়। যদিও আলীবর্দির মত প্রজা পরায়ণ ও জনহিতৈষী একজন শাসক জালিম সিংহকে রক্ষাই করেন এবং তার গায়ে যাতে একটি আঁচড়ও না লাগে সেই ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেন তার সেনাপতিদের কাছে। ধর্মপরায়ণ আলিবর্দী যে সরফরাজকে একেবারে জানে মেরে ফেলতে চাননি সেকথা অনেক গবেষকই মেনে নিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের মসনদ। দাদা হাজির সাথে এক হয়ে তিনি চেয়েছিলেন পরিবর্তন আসুক রাজধানীর মানচিত্রে। কি দিয়া আজও এসবের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবেই। শুধু মুর্শিদাবাদ সেই কথা আজও কতটা মনে রেখেছে সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েই গেল।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register