Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী

maro news
গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী

অলোক লোকের কথা

শিউলি তলায় আলতাপায়ে কে ওই কুড়ায় ফুল। দুলছে দোদুল দুইকানে তার ঝুমকো লতার দুল। ওই তো উমা। দেখতো কি কান্ড! আমি এই মেয়েকে কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াই আর এই মেয়ে সকাল হলেই কখন যে ঘরথেকে বেড়িয়ে পরে কেউই বুঝতে পারিনা। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই ফুলের সাজি হাতে নিয়ে চলে যায় ফুল কুড়াতে। যখন থেকে শিউলির গন্ধে বাতাস ভরেছে তখন থেকেই ওর যেন ফুলের নেশা ধরেছে। কিছুতেই ওকে আর রাখা যায়না ঘরে। কতবার বুঝিয়েছি যে ভোরের ওই আধো আঁধারে ঘরের বাইরে কেউ যায়না। আমাদের মা ঠাকুমারা বলতেন যে ওই সময়ে একলা বাইরে গেলে পরীতে ধরে। আর তখন লোকে নিজের মা বাবাকেও চিনতে পারে না।এমনকি নিজেকেও চিনতে পারেনা। আসল কথা হল দিনের শেষে সন্ধ্যা হলে যেমন পাখিরা বাসায় ফেরে তেমনই রাতের শেষবেলাতে নিশাচর কিছু পশুপাখি ফিরে যায় নিজেদের গুহায়। কেবল পশুপাখি নয় কিছু মানুষও এইসময়ে নিজেদের আস্তানায় ফেরে। তারাও এই অন্ধকার জগতের লোক। অন্ধকারের সাথেই তাদের আত্মীয়তা। তাদের মনের আকাশ জুড়ে আছে চিরন্তন রাত্রি। দিনের আলোর উজ্জ্বলতা কখনো সেই মনের গহীন গহ্বরে প্রবেশ করতে পারেনা। তাই তারা থাকে তমসার তীরে আলোর পৃথিবী থেকে দুরে বহুদুরে। আলোর সাথে বিরোধ তাদের চিরকাল। কোথাও আলো দেখলে তারা ভয়ে লুকিয়ে থাকে। আলোর কাছাকাছি থাকলে যদি তাদের মনে আলোর কিরণ লাগে যদি অন্ধকার মুছে যায় তবে যে তারা দলছুট হয়ে যাবে। আর যদি নিজের দল থেকে বেরিয়ে যায় তবে একদিকে যেমন তার দলের গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবার ভয় আছে তেমনি অন্ধকারের সঙ্গীসাথীদের হাতে প্রাণ হারাবার ভয়ও আছে। তাদেরোতো নিজেদেরকে প্রাণে বেঁচে থাকতে হবে। তাই গোপন কথা সংগোপনে রাখার চেষ্টাতেই তারা আলোকে ভয় করে। আর সেই জন্যেই তারা অন্ধকারকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। নৃশংসতা এদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা মারাত্মক হিংস্র হয়ে ওঠে। এদের ক্রুর মানসিকতা সাধারণ মানুষের জীবনে অমঙ্গল ডেকে আনে। এইসব মানুষের সামনে পরলে আর রক্ষা নেই। ঘাড় মটকে নিয়ে যাবে অন্ধকারে। আর ফেরার পথ খুঁজে পাবি না। তাই বলি কি, যাসনা তখন। আকাশ পাড়ে যখন আলো ফুটবে, অন্ধকার কিছুটা পাতলা হয়ে আসবে তখন নাহয় গেলি। তখন তোকে কেউ বারণ করবেনা বুঝলি। তা সে কি শোনে আমার কথা! উল্টে আমাকেই কত কিছু বলে যায়। তার কথা শুনে আমি তো অবাক হয়ে যাই। ভাবি এই মেয়ে এই বয়সে এতকিছু শিখল কি করে? কে শেখালো ওকে এসব? কি বলে জানো? বলে, শিউলি তলায় যখন ঘাসের মাথায় শিশিরের জল জমে থাকে তখনই তাজা শিউলিফুল কুড়িয়ে সাজিভরে নিতে হয়। ভোরের আলো ফুটলে ঘাসের ওপর জমে থাকা কাঁচকাটা হীরেগুলো হারিয়ে যায়। শিউলিও তখন মনের দুঃখে শুকিয়ে যায়। আর ঘাসের জলে পা ডুবিয়ে শিউলি যদি আনো, ওরা তোমায় করবে আশীর্বাদ, জানো! টুপটাপ করে ওরা ঝরে পড়বে তোমার মাথায় গায়ে যেন ঠানদিবুড়ি কত আদর সোহাগ করে শরীর জুড়ে হাত বুলিয়ে দেয়। হয়তোবা শরৎকুমারী ভালোবেসে নিজেই তোমার আঁচলে এসে ঝরে পড়বে একটু শান্তির আশ্রয়ে। তুমিতো জানো শিউলি হল রাতের শেষপ্রহরের সাথী। সূর্য যে তার মরণ আনে সপ্তরথের অগ্নিবানে। তাইতো ভোরের আলোয় শিউলি নিজেকে ধরিত্রীর কোলে সঁপে দেয়। নিজের বিদায়বেলায় সূর্যদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানায় আর সাজিয়ে দিয়ে যায় বসুমতীর সবুজ আঁচল শিউলি রংয়ের আগুন ছটায়। দিন ফুরালে নতুন করে শিউলি আসে আঁধার হলে। জ্বালে সে তার গন্ধভরা আগরবাতি বিদায়ী সূর্যের বন্দনাতে। সাঁঝ আকাশের তারার মতো একটি দুটি ফুল ফুটিয়ে গান ধরে সে আগমনী। সন্ধ্যারাগে ইমন সুরে কাশের বনেও দোলা লাগে হিমেল বাতাসে। জানিনা কখন শরতের বার্তা আনলো বয়ে কাশের বন? সাজলো কখন ময়ূর পেখম কাশের মাথায়? বসুন্ধরা উঠল সেজে নতুন সাজে কলাবতীর ষোলোকলায়। দোপাটির দুই পাটিতে রংয়ের বাহার ঝরছে যেন ঝর্ণাধারায়। অতসী তার কাঁচা হলুদ রংয়ের ফুলে ঝুমঝুমিতে বোল তোলে কন্টিকারী হলুদ গাঁদা হাসনুহানার হিল্লোলে। আচ্ছা বলো, মেয়েকে যে এতো করে বোঝালাম, তা সে কি বুঝল কিছু? তা তো নয়, শুধু আমাকেই ওর কথা শুনতে হয়। সারাদিন শুধু বকবকম করেই যায়। তবুও ওর কথাতেই আঁচলে গিঁট বেঁধে মায়ের নামে হাত ঠেকাই কপালে। বলি, দুগ্গা দুগ্গা, মাগো তোমার আসন এই জগজন আগলে তারে রাখ। ঢাকির ঘরের সুখের চাবি তোমার হাতের মুঠোয় থাকে। মাগো, সামলে নিতে ভুল করোনা একটু সজাগ থেকো। বছর বছর বর্ষায় যখন মাঠঘাট জলে ডুবে যায় তখন আমাদের এই বাদ্যকরগ্রামের প্রায় সবাই উপোস দিয়ে দিন কাটায়। বরাত ভালো থাকলে বন্যার জল নেমে যায় নইলে ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থীশিবিরে কোনোমতে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা চলে। তবুও মহালয়ার ভোরে রেডিওতে যখন বাজে "অহং রুদ্রেভি বসুভিশ্চ রামম্যহম্..." তখন বুকের ভেতর আশার আলো জ্বলে ওঠে। ঢাকিপাড়া, ঢুলিপাড়া, বাজনাপাড়ায় নতুন করে জীবন জেগে ওঠে। কাশের বনথেকে গোছায় গোছায় কাশ আসে বাড়ি বাড়ি। আলতা দিয়ে, হলুদ দিয়ে, নীল দিয়ে রংছুপিয়ে সেগুলো সেজে ওঠে ঢাকের মাথায়। তারপর বাড়ির মেয়ে মরদের কাঁধে চেপে চলে আসে শহরে। সেখানে দেবীর বোধন থেকে ভাসান পর্যন্ত ঢাকের বোলে লহর তোলে। কাঁসর হাতে মেয়েটাও তখন ঢাকের বোলে তাল মেলায়। ঢাক কাঁসরের ছন্দ লাগে ধুনূচীর গায়ে। একটা একটা করে এহাত ওহাত হয়ে পায়ে পায়ে থিরথিরিয়ে কোমর দুলিয়ে জমে ওঠে সন্ধ্যারতীর রংগরসের আসর। চলতি পথে আলগা ঘরে মা মেয়ের ঠিকে সংসারে আসে খুশির হাওয়া। নগদ কিছু টাকাকড়ি আর কিছু জামাকাপড় এইটুকুই তো পাওয়া। তাই বা কম কিসে? হোক পুরানো তবুও তাতে লজ্জা ঢাকার কাজতো চলে। টেনেটুনে একটা বছর জোরাতালির ঠেকনা দিয়ে প্রদীপ শিখার সলতে পাকানো। আবার পাবো মায়ের দেখা আগমনীর বোলে বাজবে ঢাক। কাশের পেখম নাচবে আবার ঢাকের মাথায় দুলিয়ে শাখ। তোমরা যারা দিলে আমায় ভালবাসায় ভরিয়ে ঝুলি তাদের সবার পরিবার ভালো থাকুক এই প্রার্থনায় মায়ের কাছে দুহাত তুলি। আসছে বছর আসবে আবার মহালয়ার পূণ্যক্ষণ। ততদিন সবাই শান্তিতে থাকুক এই কামনা করি সর্বক্ষণ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register