Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নীলম সামন্ত (পর্ব - ১৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নীলম সামন্ত (পর্ব - ১৮)

মহাভারতের মহা-নির্মাণ (মাদ্রী)

মাদ্রীর সাথে বিবাহের কারণ কিন্তু সুস্পষ্ট। সেই হেতু হস্তিনাপুর অধিপতি নিজেকে আগের থেকে অনেকবেশি শক্তিশালী মনে করলেন৷ দিগ্বিজয়েও বেরিয়ে পড়লেন৷ দিগ্বিজয়ের অর্থ সব সময় যুদ্ধ করা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমঝোতা, আলাপ আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যের কাছ থেকে কর নেওয়া বা বশ্যতা স্বীকার করানো, নিদেনপক্ষে বন্ধুত্ব তৈরি করা। বহু দেশ ঘুরে পাণ্ডু হস্তিনাপুর ফিরে এলেন। খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখেননি। যে কারণে অসুস্থ পাণ্ডু আরও বেশি হতাশ হলেন। শারীরিক ব্যাধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক হতাশাও তাঁকে গ্রাস করল। ঠিক করলেন বাণপ্রস্থে যাবেন। প্রথম স্ত্রী কুন্তীর পরামর্শেই তিনি দুই স্ত্রীকে নিয়ে মৃগয়ার উদ্দেশ্যে বনে যান এবং সেখানেই ঘুরতে ঘুরতে মৈথুন-রত এক মৃগদম্পতিকে শরবিদ্ধ করেন। সেই মৃগদম্পতি ছিলেন কিমিন্দম মুণি ও তাঁর স্ত্রী। রাজার ঘাড়ে বর্তালো ব্রহ্ম হত্যার দায়। ঋষি তাঁকে অভিশাপ দিলেন প্রিয়তমা রমণীর সাথে সংসর্গ ঘটলে তোমারও মৃত্যু ঘটবে– ত্বমপ্যস্যামবস্থায়াং প্রেতলোকং গমিষ্যসি। কিন্তু এভাবে চললে রাজসিংহাসন কে পাবে? অতয়েব পুত্রসন্তান চাই৷ যেহেতু কুন্তী প্রথম স্ত্রী তাই তাঁরই ডাক পড়ল। এবং সমস্যার সমাধান হিসেবে কুন্তী জানালেন তাঁর পুত্র-জন্মের স্বাধীন উপায় হিসেবে দুর্বাসার দেবসঙ্গম মন্ত্রের রহস্য, পাণ্ডু সুযোগ হাতছাড়া না করেই সানন্দে কুন্তীকে অনুমতি দিলেন। পাণ্ডুর পরামর্শে কুন্তী প্রথমে ধর্মকে আহ্বান করে শতশৃঙ্গ পর্বতে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র এবং প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। এরপর পাণ্ডুর অনুরোধে কুন্তী যথাক্রমে বায়ু (পবন) ও ইন্দ্রের সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে তিনি আরও দুই পুত্রের জন্ম দেন যথাক্রমে ভীম ও অর্জুন। ওইদিকে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারী জন্ম দেন শতপুত্র৷ একজন নারী একশটি সন্তানের মা! মাত্র কয়েক দিনে? কিভাবে সম্ভব? এতো কোন ম্যাজিক নয়। সত্য হল কুন্তীর পুত্রলাভের খবর পেয়ে গান্ধারী অত্যন্ত ঈর্ষাপরবশ হয়ে কাউকে না জানিয়ে লোহার মুগুর দিয়ে নিজের গর্ভপাত করেন। এর ফলে তাঁর গর্ভ থেকে বেরলো লৌহকঠিন মাংসপিণ্ড। গান্ধারী দাসীদের তা নষ্ট করার আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাঁকে নিষেধ করলেন। তিনি ভ্রুণকে শীতল জলে ভিজিয়ে শত ভাগে ভাগ করেন এবং তা ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখলেন। জন্ম হয় শতপুত্র। এ কোন আশ্চর্য বা দৈবঘটনা নয়। ভেবে দেখুন নলজাতক সন্তানের কথা! হয়তো এমনই কোন বিজ্ঞান প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেও ছিল। যা ব্যাসদেব প্রয়োগ করেছিলেন৷ কিংবা পাঁচ হাজার বছর পর বিজ্ঞানের উন্নয়ন এই নলজাতক সন্তানের উপায় সমাজে আনতে পারে তারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। গান্ধারীর শতপুত্র, কুন্তীর তিন, মাদ্রী একাই নিঃসন্তান। এই অবস্থা বলা যায় সমস্যা সমাধান করার ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি জন্মাননি, আর সমস্যা মেটানোর জটিল প্রয়োজনে মাদ্রীকে পাণ্ডু ব্যবহারও করেননি। কিন্তু মাদ্রী থেমে থাকেননি৷ পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা তিনি তাঁর স্বামীকেই বললেন৷ বললেন ইন্তু মে মহদুঃখং তুল্যতায়ামপুত্রতা৷ পাণ্ডুর অনুরোধে কুন্তী মাদ্রীকে দুর্বাসার দেব সঙ্গমনী মন্ত্র শেখালেন এবং বলেও দিলেন মাত্র একবার কোনও দেবতাকে এই মন্ত্রে আহ্বান করা যাবে৷ মাদ্রী সংখ্যায় গুরুত্ব দিয়ে ডাকলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয় যিনি ছিলেন সেযুগে স্বর্গের ডাক্তার এবং জন্ম দিলেন যমজ কনিষ্ঠ পাণ্ডব নকুল ও সহদেব৷ কিছুদিন পর পাণ্ডু অত্যন্ত কামার্ত অবস্থায় মাদ্রীর সাথে মিলিত হন। ভুলে যান অভিশাপের কথা। কিন্তু অভিশাপ তো অভিশাপই। সে কি আর ভুল করে৷ মিলনরত অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটে পাণ্ডুর। এই পরিনতির জন্য মাদ্রী নিজেকে দায়ী মনে করে সহমৃতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।  মৃত্যুর দুই পুত্রকে তুলে দিলেন কুন্তীর হাতে। অনুরোধ করলেন নকুল সহদেবকে কুন্তী যেন তাঁর নিজের সন্তান হিসেবেই তাঁর শিক্ষায় বড় করেন। শেষ হল মাদ্রীর পরিধি। দেখা যাচ্ছে নিষ্ক্রিয় মনে হলেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল মাদ্রী। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের এই চরিত্রটি শক্তিশালী, বুদ্ধিমতী হিসেবে অনেক কিছু করতে পারত কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতায় নিজেকে বলি দিয়ে মেনে নিলেন একটি তাপ-উত্তাপহীন জীবন। তাও এই সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল। কারণ কোথাও গিয়ে মনে হয় এই দুঃখী মাদ্রীই আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে কৌরব আর পান্ডবের লড়াই নিভৃতে স্থাপন করে দিয়েছিলেন৷ আর সাথে দেখিয়েছিলেন প্রেম পূজার নির্ভরশীলতার হাত ছাড়া চরিত্রটি যেন সংসারে নিজের বলে কিছুই রাখেননি। অর্থাৎ পান্ডুর হাত ধরে এলেন পাণ্ডুর প্রতিই প্রেম নিবেদন করে ফুরিয়ে গেলেন। অর্থাৎ পার্শ্বচরিত্র হলেও, পরিধি ছোট হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হলো মাদ্রী।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register