Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

এক মাসের গপ্পো - সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ৯)

maro news
এক মাসের গপ্পো - সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ৯)

মুখী - ৯

ওঁ হ্রীঁ হ্রীঁ হুঁ হুঁ স্বাহা ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ ফট স্বাহা
বন্ধ দরজার বাইরে থেকেই জলদ গম্ভীর গলায় বারবার এই মন্ত্রোচ্চারণে গোটা বাড়ি কেঁপে কেঁপে উঠছে... কয়েক মিনিট হোলো..আমরা দু'জন বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি... আশঙ্কা আমার আর নেই... আতঙ্ক থাকলেও...যার সাথে মুখী থাকে...তার আর কিসের ভয়!!! "বলির মন্ত্র পড়তেছে..." হি হি করে হেসে উঠলো মুখী..."দ্যাকো... তোমার বাড়ির কারে বলি দিচ্চে বাবাঠাউর..." একটু শিউরে উঠে...দরজায় করাঘাত করলাম‌...আর প্রাণপনে দুহাত দিয়ে ঠেললাম...পুরোনো দিনের পেল্লাই দরজা এতটুকুও নড়লো না... "সরো একোবার...ইদিকে এসো দেকি..."....মুখীর আঙুলের স্পর্শে ঘড়ঘড় করে খুলে গেল পেল্লাই দরজা...আর নির্ভয়ে প্রবেশ করলাম আমি...আমি তো জানি...মুখী যা বলেছে...আমাকে শুধু সেই কাজ টুকু করতে হবে....ভয় কি....মুখী আছে তো অন্ধকার,ধোঁয়ায় ভর্তি... প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হওয়ার বদলে অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে এসেছে ঘরটায়....গোটা ঘর জুড়ে পাক খাচ্ছে এক শ্বাসরুদ্ধকর গুমোট, ধূপ ধূনোর গন্ধের সাথে মিশ্রিত একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ.....চোখ সয়ে এলে প্রথমেই চোখে পড়লো প্রজ্জ্বলিত হোমকুন্ডের লেলিহান আগুনের আশপাশে ছড়ানো নানাবিধ... কিছু চেনা... আবার কিছু অদ্ভুত অচেনা পুজোর সামগ্রী....আর তার সামনে ..... বড়'জার সাড়হীন‌ নগ্ন দেহের (নাকি মৃতদেহ??) উপর অদ্ভুত ভঙ্গীতে বসে আছে রক্তাম্বর পরিহিত সেই মানুষ টা... যাকে আমি এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণা করি...ধবধবে ফর্সা বিশাল শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘামের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালচে তরল...সেটা যে কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না...আর ঠিক তার পাশেই... লাল রঙ(রঙ না অন্য কিছু তা বুঝতে পারিনি তখন) দিয়ে আঁকা একটা চতুর্ভুজ... আবার তার মধ্যে আর একটা ত্রিভুজ....আবার তার মাঝে একটা বৃত্ত.... তার মধ্যে জ্ঞানহীন শুয়ে আছে আমার ছোট্ট মেয়েটা... শ্রিয়া....আর অদূরে ঘরের আর একটা কোনে ঠিক প্রাণহীন পুতুলের মতো পড়ে আছে আমার স্বামী অর্ক আর আমার শাশুড়ি মা....আমি শ্রিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য এগোতে গিয়েই আমার পা টা কি যেন একটা তরলে পড়ে পিছলে গেল.... আমি নীচের দিকে তাকালাম.... আমার পায়ের তলার মেঝেটা লাল তরলে পিছল হয়ে রয়েছে....আর আশেপাশে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে প্রচুর মৃত কাকের দেহ...আর কালো কালো পালক.... একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম.... হঠাৎ একটা তীব্র হীঁইইইইই চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেলাম.... চিৎকার টা বেরিয়ে আসছে ছোটকাকার দেহের নীচে চাপা পড়ে থাকা বড়'জার দেহের মুখ থেকে...আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট কাকার মন্ত্রোচ্চারণের জোর বেড়ে গেল... 'উরুভারুকম্ভিয়া...বান্ধানামমৃত্যুয়র...মুখশিয়াঃ ফট্'...অনবরত মন্ত্রজপের সাথে সাথেই মাথার খুলি থেকে তরল সেই হাঁ করা মুখে ঢেলে দিলেন ছোটকাকা... আবার নেতিয়ে পড়লো দেহটা.... "ফিরে যা... ফিরে যা...যেখান থেকে এসেছিস...এই দেহ তোর নয়...তোকে আর চাইনা আমি...মহাপিশাচ জাগবে... শিশু ভ্রুনের...কুমারী মেয়ের...পূর্ন বয়স্ক যুবকের...পঙ্গু বৃদ্ধার আহুতি প্রস্তুত...তুই তার পথ পরিস্কার করে দে... ফিরে যা..." "অথাতঃ সংপ্রবক্ষ্যামি মহাপিশাচসিদ্ধিসাধনং...ক্রোধাধিপং নমস্কৃত্যোৎপত্তি স্থিতি-লয়াত্মকম্ …" ‌ বলার সাথে সাথেই আমার দিকে আরক্ত চোখে তাকিয়ে ইশারায় পাশের আসনটাতে বসতে ঈশারা করলো সম্পর্ক অনুযায়ী পিতৃতুল্য মানুষ ‌নাকি অমানুষ টা... "ঝাও..য্যাতো তাড়াতাড়ি পারো ঐ হলদে সুতোর তাবিচ টা খোলোগো...কাঁটা দিয়িই কাঁটা তুলতি হবেগো নাইলে তোমারে...আর তোমার গুষ্টি রে...." "আমি ঐ মহাসংকটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মুখীর দিকে তাকিয়ে হাসলাম.. "তোমার লীলা বোঝার সাধ্য কি আমার আছে!!! জানি তো... এটুকু আমাকে করতেই হবে...তোমার পরীক্ষায় আমাকে পাশ করতেই হবে.....আমরা চেষ্টা না করলে... তুমি কিছুই করতে পারো না....তবে তুমি পাশে থাকলে ভয় কি...এই যে যাই...." "আ মরণ...এ মাগী কেমনি নাটক করতেছে দ্যাকো...মরবে কি বাঁচবে তার নাই ঠিক..." "মরলেই বা কি... তোমার কাছেই তো থাকবো....মরার ভয় নেই আর... তুমি করতে বলেছ..না করার সাধ্য কি মানুষের...." বলতে বলতেই নির্ভয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম..আর ভেবে দেখে বুঝলাম খুড়শ্বশুরের পাশের আসনটাতে বসার বদলে ওনার পিছন দিক দিয়ে গেলে বোধহয় তাবিজ টা খুলে নেওয়া সহজ হয়.... যেতে যেতে ভরসা পাওয়ার জন্য পিছন ফিরে মুখীর কুৎসিত মুখটার দিকে তাকালাম.... দেখলাম ধোঁয়া.... গোটা ঘর ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেছে...আর তা বেরিয়ে আসছে মুখীরই সর্বাঙ্গ থেকে.... বুঝলাম.....এই ধোঁয়া আমার গতিবিধি গোপন রাখবে...চোখে জল ভরে আসছিল...মনের অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার মত তুচ্ছ প্রানীর নেই.. আমি কি এত করুণার যোগ্য!!! এর পরের ঘটনাপ্রবাহ দুঃস্বপ্নের মতো অমোঘ আর ভয়ঙ্কর...আর দ্রুত আমি সেদিন অসমসাহসে হ্যাঁচকা টানে ঐ হলুদ সুতোর বাঁধনে আটকানো তাবিজ টেনে খুলে নিতেই....ছোটকাকার দেহের নীচে বন্দি বড়'জার শরীরটা বিদ্যুতের মতো লাফিয়ে উঠেছিল....আর তার অভিঘাতে আর এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ছোটকাকা ছিটকে পড়ে গিয়ে চিৎকার করে ভয় দেখাতে শুরু করলেও...ওনার মুখে আর কন্ঠস্বরে আতঙ্ক যেন ছেয়ে গেছিল...যে সারাজীবন অন্যের ভয়ের কারণ হয়ে থেকেছে....আজ নিজে আতঙ্ককে অনুভব করতে কেমন লাগে...তা হয়তো উনি অনুভব করেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না.... অবিশ্বাস্য মৃত্যুভয়ে বিকৃত মুখ নিয়ে উনি প্রথমে ছুটে এলেন আমার কাছে... ততক্ষণে বড়'জা....নাকি সেই মহাভয়ঙ্করী পিশাচিনী নিজের স্বরূপে... অর্থাৎ..সেই সাক্ষাৎ আতঙ্কের নারকীয় মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে.. "এ হতে পারে না...আমার শরীরবন্ধন তাবিজ টা আমায় ফেরৎ দে... আমি তোর সর্বনাশ করে দেবো কিন্তু... আমার সব কিছু এত দূর এগিয়ে পন্ড হয়ে যেতে আমি দেবো না..." ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেও ওনার গলাটা হাহাকারের মত শোনালো... "এই বুড়ি....এই মেয়েছেলেটার হাত থেকে তাবিজটা ছিনিয়ে নিয়ে আমায় দে এক্ষুণি...." "এত গুলান কাক মেরে..এত গুলান মানুষের সব্বোনাশ করে...এত নোভ করে তুমি ভালো করো নাই বাবাঠাউর...." বলেই মুখী বড়'জার দিকে তাকালো..."কই গো???তোমারে দিয়ি এতগুলান দিন ‌য্যাতো কিছু করিয়েছে....নিজি সব কিচু ভোগ করেছে....আর তোমারে নোভ দেখায়ি ঠিক করে খেতেও দেয়নি...ওরে ছেড়ে দিলি আবার বশ করি তোমারে কি করাবে.... তুমি ঝানো না...ওখেনে ডাঁরিয়ে না থেকে..এ্যাদ্দিনের খিদা টা মিটাও গো .." এরপরের দৃশ্যগুলো আমি ভালো করে বর্ণনা করতে পারবো না.... কারণ 'আ্যাহহহহহ্যা' করে অদ্ভুত খ্যাসখেসে হাসি হাসতে হাসতে বুকে ভর দিয়ে তার শিকারের দিকে বড়'জা কে এগোতে দেখেই আমি আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম... সুতরাং মুখীর খলখল হাসি....ছোটকাকার ভয়ার্ত গলার মরণ আর্তনাদ আর তার পরে চপচপ্ করে কিছু চিবিয়ে খাওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারিনি... "এবার বাচ্চাটারে খাবো....আ্যাহহহহা" এই কথাটা শুনে আমি চোখ খুললাম... দেখলাম..কয়েক ফোঁটা পড়ে থাকা রক্ত ছাড়া....ছোটকাকার অস্তিত্ব এই পার্থিব জগত থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে... কিন্তু তার সাথে অসম্ভব আতঙ্কে..এটাও দেখলাম ....রক্তমাখা মুখ মুছতে মুছতে বড়'জা এবার ধীরে ধীরে শ্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে.... আমি একটা আর্তনাদ করে প্রায় দৌড়ে গিয়ে শ্রিয়ার অচৈতন্য শরীর টাকে জড়িয়ে ধরলাম....আর এক মূহুর্তের মধ্যেই আমার হাতে ধরা হলুদ তাবিজ টা শ্রিয়ার গলায় পড়িয়ে দিলাম....বড়জা এক মূহুর্ত থমকে গেল....তার পর রক্তমাখা ছুঁচলো দাঁত বার করে হেসে উঠলো....." ওরে মাগী...তোর সতীনঝি রে নয় বাঁচালি....কিন্তুক তোরে...তোর সোয়ামী রে কে বাঁচাবে....মাদুলি তো একটা.... হিহিহিহি...আয় তোরে দিয়েই খিদে মেটাই আগে....." " তার আগে যে আমার খিদা মেটাতে হবে তোরে...তোর মতো আমার খিদাও যে কখনো মেটেনা " এক ঘন্টাধ্বনির মতো গমগমে কন্ঠস্বরে গোটা ঘর...নাকি গোটা বাড়ি না না...গোটা পৃথিবীটাই কেঁপে উঠলো বোধহয়... পিশাচিনীটাও বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো.... হঠাৎ কোথা থেকে কি এক মন্ত্রবলে মাটিতে পড়ে থাকা সবগুলো কাক জীবিত হয়ে উড়তে শুরু করলো ওরা মালার মত করে মুখীর মাথার উপর উড়তে শুরু করলো....আর ওদের আওয়াজের সাথে মিশে যাচ্ছিল মুখীর গলার খলখল্ হাসি অপার্থিব এই গলা আগে কখনো পৃথিবীর কেউ শুনেছে কি না জানি না.... আমার সারা শরীর অবশ হয়ে এল.....ভয়ে...শ্রদ্ধায়...এ কি রূপ তোমার মা...!!! " তিনি বিবর্ণা..... চঞ্চল...রুষ্টা ও দীর্ঘাঙ্গী...তাঁর পরিধানের বস্ত্র মলিন....মুক্তকেশীর কেশকলাপ বিবর্ণ ও রুক্ষ...তিনি বিধবারূপিনী‌ ও কাক দ্বারা পরিবেষ্টিতা...নয়নযুগল রুক্ষ ও নির্মম..নাসিকা বৃহৎ...ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর মুখ...দেহ ও নয়ন কুটিল....তিনি ভয়ঙ্করাকৃতি ও কলহতৎপরা....তার কৃপাপাত্রের উপর কোনো অশুভ ক্ষতিকারক ক্রিয়াদির প্রভাব পড়ে না.... একহাতে বড়'জার অশুভ...নষ্ট... নারকীয় শরীর টা টেনে এনে গলা ধরে অবলীলায় গলাটা ধরে একহাতেই পুতুলের মতো উঁচু করে ধরে হাঁ করলো মুখী... অন্ধকার এক বিশাল হাঁ।
পশ্য ভদ্রে মহাভাগে পুরুষো নাস্তি মাং বিনা... তদন্যা বনিতা নাস্তি পশ্য ত্বং জ্ঞানচক্ষুষা বিধবাসি কুরু ত্যাগং..শঙ্খসিন্দুরমেবচ..... সাধব্যং লক্ষণং দেবী....কুরু ত্যাগং পতিব্রতে।
আগামী পর্বে সমাপ্ত
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register