- 18
- 0
যেহেতু রবি ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করা স্থান থেকেই আমার ছবি তোলার সূত্রপাত, তাই এই ব্যাপারটা মাথায় প্রথিত হয়ে গিয়েছিল। যাই ছবি তুলবো, বাসস্থানের আশপাশেই তুলবো এরকম স্বভাব সেই শান্তিনিকেতন থেকেই তৈরি হয়েছে। ২০২০তে এসে সেই সুযোগ নিজের শহরেও পেয়ে গেলাম। সূত্রপাত অনেক আগেই হয়েছিল যদিও, এবার শুরু হল শহরের আশপাশে পাখির খোঁজে যাত্রা। ২০১৭ নাগাদই বেশ কিছু জায়গা খুঁজে বের করেছিলাম যেখানে কাপাসি, মুনিয়া এসব দেখতে পেতাম। একটা জলাশয়ও পেয়েছিলাম যেখানে অনেক পাখি দেখতে পাই এখনো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কমন কিংফিশার বা ছোট নীল মাছরাঙা। আমি এদের ছবি বেশ কয়েকবার তুলেছি আগে। কিন্তু একটা জায়গায় আটকে থাকলেই তো আর হবে না। চরৈবেতি চরৈবেতি উচ্চারণ করতে করতেই খুঁজতাম নতুন স্থান। খুঁজতে খুঁজতে শেষে পেয়েও গেলাম স্বপ্নের মত একটা জায়গা। এভাবেই একদিন অসমবয়সী সঙ্গী শুভদীপ আর কৌশিককে নিয়ে স্কুটিতে যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম এক গ্রামে। বড় এক কাঁদরের ধারে বিস্তৃত উঁচু জমি যেখানে প্রচুর সব্জী, আখ, ধান চাষ হয় সেরকম এক জায়গায় গিয়ে রাস্তা শেষ হল। কপাল অত্যন্ত ভালো ছিল। জীবনের প্রথম শেয়াল বা গোল্ডেন জ্যাকেল দর্শনও সেদিনই হল। এর পরে মোটামুটি মার্চ পর্যন্ত নিয়মিত যেতে থাকলাম সেই জায়গায়। ততদিনে অবশ্য শহরের আরেকদিকেও ঢুঁ মারতে শুরু করেছি। সেই রাস্তাতে সোজা যেতে থাকলেই বৈধরায় ব্রাহ্মণী নদীর বাঁধে পৌঁছে যাওয়া যায়। এভাবেই আস্তে আস্তে ছবির ভান্ডারে আবার জোয়ার আসতে লাগলো। ঠিক এমন সময় বাজারে এল জীবনমৃত্যুর মাঝামাঝি পর্যায়ের এক জীব, যাকে আমরা ভাইরাস বলে চিনি। চীন দেশের উহান থেকে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়লো গোটা পৃথিবীতে। প্রথমে মভেল করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত হলেও শীঘ্রই নাম সংশোধিত হয়ে পরিচিত হল কোভিড-১৯ নামে। সেই ভাইরাসের আগমন এ দেশেও হল। ফলাফল তো আপনারা জানেনই। লকডাউন হয়ে দেশের স্বাভাবিক গতি যেন এক ধাক্কায় থমকে গেল। থমকে গেল আমার ছবি তোলাও।

এতদিন আমি খালি পাখি আর ম্যাক্রো ছবিই তুলতাম। এবার এই লকডাউনে আকাশের দিকে নজর দিলাম। আগেই বলে দিই, আমি ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফির 'ম' জানি না। এবার ভাবতে পারেন 'ম' কোথা থেকে এল? যেটা ভাবছেন ঠিক ভাবছেন, ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি শব্দদুটোয় যেমন 'ম' নেই, আমার ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফির জ্ঞানও সেরকম, অস্তিত্বই নেই। আর ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি এবং তার পোস্ট-প্রসেসিং যেমন তেমন করে করলে হয় না; রীতিমত সময়সাধ্য ব্যাপার। তাই ক্যামেরায় আকাশ এবং মেঘের ছবি তোলার দুঃসাহস আমার কখনো হয় না, ফোনেই কাজ সেরে দিই। আমার এই পোকোফোন এফ ওয়ান ফোনের ক্যামেরা এমনিতে ভালো নয় তবে গুগল ক্যামেরা মড দিয়ে ভালোই ছবি ওঠে। বাকিটার জন্য তো অ্যাডোবি ফটোশপ লাইটরুম মোবাইল আছেই; সম্ভবত অ্যান্ড্রয়েড ইকোসিস্টেমে এটাই সবচেয়ে ভালো ফটো এডিটিং অ্যাপ্লিকেশন। এই লকডাউনে তাই পাখির ছবি আর ম্যাক্রোর সাথে সাথে মেঘের ছবিও প্রচুর তুলেছি এবং আত্মপ্রসাদে ভুগেছি। কালবৈশাখী ঝড় হোক বা বিকালের সাধারণ ঝড়, এই বছর গ্রীষ্মে মেঘের অভাব হয়নি। বরং এতই বৃষ্টি হয়েছে এবছর গ্রীষ্মও সেভাবে জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। নয়তো এই মে জুন মাসেও এমন দিন গিয়েছে যখন চাদর নয়তো কম্বল ঢাকতে হয়েছে রাতে। অনেকে মনে করছেন, পরিবেশ নিজেকে সুস্থ করে নিচ্ছে। আদতেই কি তাই? জানি না। মাস্টার্স থিসিস লেখার সময় আমার একটা টপিক ছিল গ্লোবাল অ্যাভারেজ টেম্পারেচার কেমন ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা। তখন অনেক পেপার পড়তে পড়তে বুঝেছিলাম, গ্লোবাল ওয়ার্মিং শুধু পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার মত সামান্য ব্যাপার নয়, এর অনেক কারণ এবং অনেক রকমের ফলাফল আছে। তাদের মধ্যে একটা হল আবহাওয়ার স্বাভাবিক প্যাটার্নে ব্যাপক পরিবর্তন। এই বছর পশ্চিমবাঙ্গালায় গ্রীষ্মের প্রকোপ কম হওয়াও সেরকম কোনো কারণে হতেই পারে। যদিও এই বক্তব্যের সপক্ষে আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। ফলে মতামত ব্যক্তিগত হিসাবেই গ্রহণ করবেন।
এই লকডাউনে বাড়িতে বসে থাকলেও সেভাবে বিরক্ত হইনি আমি। কারণ বাড়ি বসেই যা পেয়েছি সেটা কম নয়। আমার বাড়ি থেকে একটা পাহাড় দেখা যায়। ঝাড়খণ্ডের পাহাড় সেটা। কী নাম মনে নেই আর। টেলি দিয়ে ছবিও তুলেছি সেটার। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা সম্ভবত ৪ঠা জুন হল। আমি এর আগে কখনো সূর্যের চারিদিকে হ্যালো দেখিনি। সেদিন সেটাও দেখার সুযোগ হল। ছবিও তুলেছি, সেই ফোনেই। এখন অবশ্য লকডাউনের পঞ্চম দশা চলছে। আস্তে আস্তে লকডাউন অনেক শিথিল হয়েছে। মানুষজন মুখে মাস্ক নিয়ে বের হচ্ছে রাস্তায়। আমিও দুয়েকদিন বেড়িয়েছি এই লকডাউনের মধ্যেই। চেনা রাস্তায় যেতে যেতে ফোনেই ছবি তুলেছি প্রিয় জায়গাগুলোর। আমার বাবা প্রাক্তন রেলকর্মী। ছোটবেলা ব্রিটিশ আমলে তৈরি বড় রেল কোয়ার্টারে কেটেছে। বড় লাল রঙের সেই বাড়ি এখনো আমাকে টানে। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় টুক করে একটা ছবিও তুলে রাখি। কে বলতে পারে, আর ১০ বছর পরে হয়তো বাড়িটা আর থাকবেই না। থেকে যাবে শুধু ছবিগুলো।
0 Comments.