Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড ( ত্রয়ো ত্রিংশত্তম পর্ব )

" যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবো সে তৃষা আমার জাগায়ো না যে ভালোবাসায় তোমারে ভুলিবো সে ভালোবাসায় ভুলায়ো না যে জ্ঞানের দীপ তোমারে লুকায় সে জ্ঞানের দীপ জ্বালায়ো না যে যাতনা পেলে তোমারে লভিবো সে যাতনা মোর হরিও না যে নেশা আমায় তোমা ছাড়া করে সে নেশা আমার জাগায়ো না যে সুখ লভিলে তোমারে ভুলিবো সে সুখ সাগরে ভাসায়ো না যে কথার মাঝে তব কথা নাই সে কথা আমারে শুনায়ো না যে আঁখি ঝরিলে তোমারে লভিবো সে আঁখির ধারা মুছায়ো না.. "
এ কার গলা, থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। এতো আকুতিভরা টলটলে উচ্চারণ আমি কানাইদার গলাতে কোনও দিনও শুনিনি। সবচাইতে বড় কথা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মরণে এই গান আমি দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের নাটমন্দিরে যেমন শুনেছি য়েমনি ঠাকুরের শয়নকক্ষেও শুনেছি, কিন্তু এতো দরদ, এতো তদগত ভাব আমি সেখানেও শুনিনি। বিশেষ করে একজন তারাপীঠের বাউল, তিনি খুব বেশী হলে বামদেবের গাওয়া শ্যামাসংগীত বা পল্লীগীতি গাইতে পারেন কিন্তু এই শ্রীরামকৃষ্ণগীতি ! অবিশ্বাস্য। ধীরে ধীরে পিটুলি তলার দিকে এগিয়ে গেলাম। সূর্য তখন তার ছড়াতে উন্মুখ। কিন্তু মহাশ্মশানের গাছগাছালির ঠাসবুননে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কচিৎ কদাচিৎ একটু ফাঁকফোকর গলে যেন নিজেকে খুঁজে ফিরছে।
একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন কানাই বাউল। তার দু'চোখের ভেতর লেপ্টে থাকা আঁখি পল্লব গলে জলের ঝর্ণাধারা বেয়ে পিছলে যাচ্ছে। অথচ সারাটা মুখমন্ডল জুড়ে এক আশ্চর্য জ্যোতির্বলয়। কাছে গিয়ে বসলাম। খুব ইচ্ছে করছে কানাইদাকে একটু আদর করে দিই। আমি নিশ্চিত জানি যে কানাইদার মনে এখন এক আশ্চর্যরকমের বিষাদ যুক্ত আনন্দ খেলা করছে। এ রকম আত্মনিমগ্ন অবস্থা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। ভাবলাম ছোট্ট করে একটা ডাক দিই -- কানাইদা... হঠাৎ করে যেন সাগরের তলদেশ থেকে উঠে আসা বুদবুদের মতো একটা আওয়াজ উঠে এলো কানাইদার গলায়। --" পদীপদাদা..." --" উঁ... " --" তোমার কাচে আমি হার মেনেচি গো " -- " মানে " --" তোমার অন্তরস্থ পেম যে কী বিশাল গভীর তার তল আমি খুঁজে পাই না কেন? "
এ কথার আমি কী উত্তর দেবো? একটা অনুত্তাল হাওয়া, যে হাওয়ায় মাঝি নিশ্চিন্তে পাল খাটিয়ে নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসে হুঁকোয় তামাক সাজেন, সেরকম একটা হাওয়া বইছে।
-- " নইলে তুমি কীবাবে আমারে আদর কত্তে চাও বলো দেকি? এই যে পেমভাব, সে ভাব যে কতো গভীর সে আমি... আচ্চা ঠাকুর সে পোড়ারমুকি কি তোমারে বুজচে না? "
আবার এমন একটা প্রশ্ন তিনি আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন যে আমার চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর গত্যন্তর রইলো না।
--" একটা কতা কি জানো ঠাকুর, সমুদ্দুরের তলায় আলোর সাতে আঁদারের যে পেম, সে বুজি এমনই অবুজ গো। আলো চায় আঁদারের হিদয়ের দকল নিতে আর আঁদার চায় আলোকে নিজের বুকের মদ্যে জাপটে রাকতে। কিন্তুক ককন যে আলোর বুক জুড়ে আঁদার ঘনায় আবার ককন যে আঁদারের বুক জ্বলজ্বল কইরে ওটে সে বুজি দু'জনার কেউই বুজে উটতে পারে না। "
আমি চুপ করে বসে আছি। আমার চতুদ্দিকে যেন এক আশ্চর্য জ্যোতির্বলয়। হাল্কা দুধের মতো রঙ। সাদা অথচ ঘোলাটে। আমার বুকের হাড়পাঁজরের মধ্যেকার জমাটবাঁধা অন্ধকারে সে আলো যেন ধীরে ধীরে সুতোর মতো চুঁইয়ে পড়ছে। শ্যাওলার মতো আমার ফুসফুসের মধ্যে সে আলোর উদ্ভাস আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। ধীরে ধীরে সে আলোয় ফুটে উঠছে একটা অবয়ব। একটা মুখের অবয়ব। সে অবয়ব আমার চেনা, কিন্তু... দূরে, বোধকরি গুরুপদবাবার ঘরে কে যেন গান ধরেছে --" আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী...

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register