Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব - ৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে তনিমা হাজরা (পর্ব - ৭)

ছড়িয়ে জড়িয়ে

ছড়ার আশ্রয় কেন, গদ্য কেন নয়? কারণ ছড়ার ছন্দে অতি দুরূহ তত্ত্বও সহজে মনে রাখা যায়। বিশেষত যে যুগে অধিকাংশ মানুষই যেখানে সামান্য শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। তাদের পক্ষে পুঁথি পড়ে জ্ঞানার্জন অসম্ভব তাই ছন্দে গাঁথা ছড়ায় তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া এবং তাঁদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া। এইসব ছন্দে গাঁথা মৌখিক জ্ঞানই বংশ পরম্পরায় রক্ষিত ও প্রবাহিত হয়ে থেকে গেছে গ্রামীণ মানুষের ব্যবহারিক জীবনের অতি প্রয়োজনীয় জীবনযাত্রার জন্য আবশ্যিক নথি হয়ে।।
বিখ্যাত জোতির্বিদ ও কৃষিবিজ্ঞানী খনার নাম আমরা কে না জানি। তাঁর রচিত ছোট ছোট ছড়াগুলি "খনার বচন" নামে পরিচিত। কৃষি, বৃষ্টিপাত, অনাবৃষ্টি, মড়ক, বন্যা, ভূমিকম্প, শস্যরোপণ, গাছের সার প্রদানবিধি, গৃহ নির্মাণের দিকনির্ণয়,বায়ুর গতিপথ গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাস্তুবিধি, যাত্রার শুভাশুভ সব বিষয়েই তার কথিত ও রচিত ছড়াগুলি আজও প্রচলিত এবং আদৃত।।
আজকের বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে নানা যন্ত্র আবিস্কারের ফলে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে লিখিত এই ছড়াগুলির তাৎপর্য আমরা প্রায় হারাতে বসেছি।। এখনো যাথার্থ্য বিচার করে দেখলে দেখা যাবে এই নিরীক্ষণের কি সঠিক ভিত্তি। এখনকার দিনে এই ছড়াগুলি প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক যুগের যেন ধূসর স্বরলিপি।।
১. প্রথম বছরে ঈশানে বায়, হবেই বর্ষা কয় খনায়।।
বর্ষাকালের প্রথমে যদি ঈশান কোণ থেকে বায়ু বয় তাহলে সে বছর প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা।।
২.আমে বান, তেঁতুলে ধান।।
যে বছর আমের ফলন ভালো হয়, সে বছর বৃষ্টি বেশি, যে বছর তেঁতুলের ফলন বেশি সে বছর ধানের ফলন বেশি।।
৩.চৈতে কুয়া, ভাদরে বান। নরের মুন্ড গড়াগড়ি যান।।
চৈত্র মাসে অতিরিক্ত কুয়াশা এবং ভাদ্র মাসে বন্যা হলে অনেক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা।।
৪.পৌষের কুয়া, বৈশাখের ফল। যদিন কুয়া, তদিন জল।।
যে বছর পৌষ মাসে যতদিন কুয়াশা থাকবে, সে বছর বৈশাখ মাসে ততদিন বৃষ্টি পাত হবে।।
৫. জাওলা তাতে, চাষা মাতে।।
ধান যখন ছোট তখন অধিক সূর্য তাপ পেলে অধিক ফসল হয়ে থাকে।।
৬. শনির সাত, মঙ্গলের তিন। আর সব বারে দিনে দিন।।
শনিবারে বৃষ্টিপাত শুরু হলে সাত দিনের আগে ধরে না, মঙ্গলে শুরু হলে ধরে তিন দিনে, আর বাকি সব দিনে সেইদিনেই ধরে যায়।।
৭. বৈশাখের প্রথম জলে, আউশ ধান দ্বিগুণ ফলে, খনা বলে শুন ভাই, তুলায় তুলা অধিক পাই।।
বৈশাখ মাসের প্রথমে বৃষ্টিপাত হলে আউশ ধানের ফলন ভালো হয়, কার্তিক মাসে সূর্য তুলা রাশিতে প্রবেশ করে, সেই কার্তিক মাসকে তাই তুলা রাশির মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। এইসময় বৃষ্টিপাত তুলাচাষের অনুকূল।
৮.জ্যৈষ্ঠে খরে আষাঢ়ে ঝরে কেটে মেড়ে গোলা ভরে, যদি বর্ষে মকরে, ধান হয় টিকরে, মাঘ মাসে বর্ষে দেবা, রাজায় করে প্রজার সেবা।
জ্যৈষ্ঠে খরা, আষাঢ়ে প্রবল বৃষ্টি হলে সেবছর গোলাভরা ধান হয়। পৌষ মাসে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই পৌষ মাস মকর রাশির মাস। পৌষের বৃষ্টিতে উচ্চভূমিতে অধিক ফসল জন্মে। আর মাঘ মাসে যদি বৃষ্টি হয় তবে এত অধিক ফসল হয় যে রাজাও আনন্দে কৃষক প্রজার কদর করেন।
৯. পশ্চিমে ধনু নিত্য খরা, পুবের ধনু মুষলধারা, পাঁচ রবি মাসে পায়, ঝরায় কিংবা খরায় যায়। চৈতের তেরো শনির বারে, কাঠার ফসল কুড়ায় ধরে। পাঁচ শনি পায় মীনে, শকুনি মাংস না খায় ঘৃণে। দূর সভা নিকট জল। নিকট সভা রসাতল।।
পশ্চিম দিকে রামধনু দেখা গেলে সেটি আসন্ন খরার লক্ষণ আর পুব দিকে দেখা গেলে সেটি মুষলধার বৃষ্টির পূর্বাভাস। যে মাসে পাঁচটি রবিবার পড়ে সেই মাসে হয় অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি। চৈত্র মাসের তের তারিখ যদি শনিবার হয় তবে সেবছর ধান্যের কোষে চাউল ধরে না, শুধু খোসা জন্মে কুড়া তৈরি হয়। চৈত্র মাসে সূর্য মীন রাশিতে প্রবেশ করে তাই চৈত্র মাসকে মীন রাশির মাস বলা হয়ে থাকে। এই মীন রাশির মাসে যে বছর পাঁচটি শনিবার পড়ে সেইবছর শস্যের ফলন খুব কম হয় ফলে চারিদিকে এত মড়ক হয় যে শকুনেরও মৃতদেহ ভক্ষণ করতে করতে ক্লান্তি ধরে যায়। চন্দ্রমন্ডল থেকে অনেক দূরে নক্ষত্রের সমাবেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান হলে তা আসন্ন বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস এবং চন্দ্রমন্ডল এর খুব কাছাকাছি অনেক নক্ষত্র স্পষ্ট দেখা গেলে তা অনাবৃষ্টির পূর্বাভাস।
১০. ডাক দিয়া বলে, মিহিরের স্ত্রী শুন পতির পিতা, ভাদ্রমাসে জল হলে নড়েন বসুমাতা, রাজ্যনাশ, গোনাশ, ঘটে অগাধ বান, হাতে কাঠা ফেরে চাষা, নাহি জোটে ধান।।
এটি ভূমিকম্পের আগাম সাবধান বাণী। ভাদ্রমাসে বৃষ্টিপাত বেশি হলে ভূমিকম্পের প্রবল আশঙ্কা। তার ফলে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি এবং হাতে পাত্র নিয়ে চাষিকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বের হতে হয়।।
১১. গাছের সারবিষয়ক কি সুন্দর একটি ছড়া পেলাম এই খনার বচনেই
মানুষ মরে যাতে, গাছলা সারে তাতে। গোঁধলা দিয়ে মানুষ মারে, পচলা পেয়ে গাছলা সারে।।
অর্থ্যাৎ পচা গোবর থেকে উদ্ভূত গ্যাস মানুষের পক্ষে অত্যন্ত হানিকর অথচ পচা গোবর থেকে তৈরি সার দিয়ে গাছের জন্য সবচেয়ে উত্তম সার প্রস্তুত হয়ে থাকে।।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register