পঞ্চভূতে গড়া এই মানবশরীরের কতগুলো নিজস্ব চাহিদা আছে... মনের উপর যতই আঘাত লাগুক...মন যতই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠে হিম হয়ে থাকুক না কেন... শরীরের খিদে তৃষ্ণা কখনও থেমে থাকে না... তেমনি যতই ক্লান্ত অবসন্ন শরীর-মন হোক না কেন...তার উপরেও একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদ নেমে আসা আটকানো যায়না... আমিও পারিনি
আমার মাথার উপর আসন্ন বিপদের খাঁড়া ঝুলছে এবং তার থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় দূরদূরান্তেও দেখা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও কখন যে আমার টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুগুলো শিথিল হয়ে অঘোর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে...বুঝতেও পারিনি...
যখন ঘুম ভাঙলো...ধড়মড় করে উঠে বসলাম...প্রথমেই চোখে পড়লো বিছানাটা খালি...অন্যদিন ঘুম থেকে উঠেই শ্রিয়াকে তুলে...ওর স্কুলের প্রস্তুতি দিয়ে আমার দিন শুরু হয়....আজ শ্রিয়াকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে আমি যত দ্রুত সম্ভব বাইরে বেরিয়ে এলাম... কিন্তু আমার জন্য আরো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল....
আমি তন্নতন্ন করে গোটা বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখলাম..... শুধু শ্রিয়া নয়.....অর্ক..... আমার শাশুড়ি মা....কোনো কাজের লোক...এমন কি বড়'জা র পর্যন্ত কোনো চিহ্নমাত্র নেই....অতবড় বাড়িতে শুধু আমি ছাড়া আর কোনো জীবিত প্রানীর নামগন্ধ নেই....না ভুল বললাম...বাড়ির চারপাশে বেশ কিছু কাক......আর উত্তরে ছোট কাকার ঘর থেকে অবশ্য দূর্বোধ্য ভাষার মন্ত্রোচ্চারণ যথেষ্ট জোরে ভেসে আসছিল..... আমি পাগলের মতো গোটা বাড়ি জুড়ে পাক খেতে খেতে দৌড়তে লাগলাম আর শ্রিয়া অর্ক.... ওদের নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম...
আমার পাগল পাগল লাগছিল.... আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না কি করবো....
"ওদের ডেকে কুনো নাভ নি...."
আমি চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম....দালানে পা ছড়িয়ে বসে আছে মুখী...আর ওর ছড়িয়ে থাকা পায়ের উপর বসে আছে দু তিনটে কাক....অথচ আমি শপথ করে বলতে পারি আমি অন্ততঃ পাঁচবার দালানের সামনে দিয়ে ছোটাছুটি করেছি....এক মূহুর্ত আগেও কেউ সেখানে ছিলো না......
" মুখী তুমি জানো??ওরা কোথায়???কি হয়েছে ওদের??কে কি করেছে?? আমার মেয়ে টা.... ওইটুকু একটা মেয়ে....মুখী দয়া করো আমায়.... আমি আর পারছি না....বলো ওরা কোথায়...." আমি অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মুখীর পাশে শরীর ভেঙে বসে পড়লাম....
মুখী হাত দিয়ে কাক গুলোকে ঠেলে উড়িয়ে দিল...তারপর নোংরা...শনের নুড়ি চুলগুলোর মধ্যে থেকে উকুন টেনে টেনে এনে মারতে মারতে নির্বিকার গলায় বললো...
"ওদের সব ওঘরে নে গ্যাচে গো... তোমার খুড়শউরের ঘরে...আজ মোচ্ছব নেগেচে কি না...এট্টু পর তোমারো ডাক পড়বে... তুমি ই ছিনিমার নায়িকা যে গো...." বলতে বলতে হিহিহিহি করে কুৎসিত ভাবে হেসে উঠলো মুখী.... তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো..." কাল রেতের কতাখান মনে রেখো গো মেয়ে....মেইয়েমানষে পেরান দিতি পারে...কিন্তুক নিজির ইজ্জত গেলি সপ গেল..."
আমি হাতজোড় করে বললাম... " আমাকে বাঁচাও মুখী....এই পরিবারটাকে এই মহাসংকটের হাত থেকে রক্ষা করো.... আমি জানিনা তুমি কে.... কিন্তু এটুকু বুঝেছি... তুমি যা দেখাও তুমি তা নও.... আমার এই বিপদে..."
"কেন??তোমার কালীমা তোমারে বাঁচাতি পারবেনে? তাইলে রোজ এত ঢং করি গিয়ি গিয়ি ফুল দিয়ে আসতে কেন গা ?" বলতে বলতে আবার সেরকম বিশ্রী হাসি হেসে উঠলো মুখী..." "যাই বাবা, দুটো খাবার দেকি গে... তোমার তো আজ আবার উপোস... হিহিহিহি.... আমি তো না খেয়ি থাকতি পারবুনি গো...তবে আজগে আমারো আবার মহাভোজ"
বলতে বলতেই বিধ্বস্ত, হতবুদ্ধি আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রান্নাঘরের দিকে নিজের কুৎসিত দীর্ঘ জীর্ণ..ব্যাঁকাচোরা শরীরটাকে নিয়ে প্রায় ষোড়শী মেয়ের মতো দ্রুত গতিতে মিলিয়ে গেল মুখী..
তারপর সারাদিন কিভাবে কাটলো তা বর্ণনাতীত... বেঁচে থেকেও অসহায় হয়ে... মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ যে কি...তা এই পরিস্থিতিতে যে পড়েছে...সেই একমাত্র অনুভব করতে পারবে... কতবার যে ছোটকাকার ঘরের সামনে গিয়ে কান পাতলাম...চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম যদি আমার প্রিয়জনদের সামান্য আওয়াজ ও শুনতে পাই...আন্দাজ করতে পারি ঘরের ভিতর কি চলছে... অবশ্যই আমার সব চেষ্টা বৃথা হলো...ছোটকাকার গলার দুর্বোধ্য মন্ত্র ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না...একসময়ে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে ভেঙে পড়লাম...এত মানসিক চাপ আমার গর্ভবতী শরীর মন আর নিতে পারছিল না... কিন্তু মনের জোর আমাকে রাখতেই হবে এটাও মাথায় ছিল...শেষ মুহূর্ত অবদি আমার প্রিয়জনদের... আমার গর্ভস্থ সন্তানকে আমায় রক্ষা করার চেষ্টা করতেই হবে...আর না পারলে ওদের সাথে আমিও.....তবুও আমি অন্ধকারের পথে পা বাড়াবো না...এ আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলাম.... আমি একমনে শুধু আমার পাথরের মা কে ডাকতে থাকলাম...কত সময় পার হয়ে গেছে...কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আমি টের ও পাইনি.... আমার টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুতন্ত্রী কেমন যেন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল...হঠাৎ এক বিজাতীয় অনুভূতি আমাকে সজাগ করে তুললো.... আমার ঠিক মুখের সামনেই জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখী....আমাকে চমকে ওঠারও সুযোগ না দিয়ে মুখী বলে উঠলো....
"চলো গো মেয়ে... তোমার ডাক পড়েছে..."
আমি মুখীর হাত চেপে ধরলাম....
"আমি যাবো না...মুখী আমাকে বাঁচাও...."
মুখী ওর শীর্ণ শিরা ওঠা ..বড় বড় নোংরা নখওয়ালা হাত টা আমার থেকে ছাড়িয়ে নিল....
"এতক্কন তো আমার পরিবার আমার পরিবার বলি হেদিয়ে মরতিছিলে...একন..বলতেচ যাবুনি... আমি অতসব জানিনি বাপু....আমারে কয়েচে নিয়ি যেতি আমি নিয়ি যাচ্চি...আর শোনো বাপু কেউ কাউরি বাঁচায় নাকো...তোমারেই আগে বাঁচতি চেষ্টা করতি হবে...নাইলে ভগমানও কিচু কত্তে পারেনেকো...কপালির নিকন কেউ খন্ডাতি পারেনে কো...তবে চেষ্টা করলি হয়তো তোমার ভগমানের দয়া হলিও হতি পারে...." খিলখিলিয়ে হেসে উঠেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল মুখী.... "এট্টা কতা কইতে পারি...বাইরির শত্তুরের চাইতি ঘরের শত্তুর আরো ভয়ের.... পারলি সেটা রে আগে ঝব্দ করোগো..."
" কিন্তু মুখী সেটা কিভাবে?"
"ওর গলার হলদে সুতোয় বাঁধা মাদুলিখান এক টানি খুলে দিলিই সপ হয়... আমি কইনি গো...কয়েছে তোমার বড়'জা"...
"কিন্তু তারপর? বড়'জার হাত থেকে আমাকে আর আমাদের পরিবারকে কে বাঁচাবে??"
মুখী আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘোরালো
"বাবা..এরা নাকি সব পড়ানেকা করা ভদ্দর...মাতায় বুদ্দি তো এতটুকুও নেই... হিহিহিহি...তা এটুকু ঘটে ঢুকচেনে??ঝে মাদুলির জন্যি তোমার বড়'জা বাবাঠাকুরের কাচে মোটে ঘেঁষতি পারেনে...সেই মাদুলি যেতি তোমার হাতে আসে.... তাইলে সে তোমার কাচেও ঘেঁষতি পারবেনে..."
"কিন্তু আমার পরিবারের কি হবে?? সে যদি ওদের কোনো ক্ষতি করে??"
"এত খতেন আমি ঝানিনে বাপু..." ঝাঁঝিয়ে উঠলো মুখী...." কিন্তুক..এটুকুন ঝানি,আপনি বাঁচলি বাপের নাম....একন চলো...আর তোমার ঐ পাতরের মা'রে ডাকতি থাকো...দেকো সে তোমার কি করে..."
আমার হঠাৎ.... কেমন যেন একটা জোর... একটা ভরসা এলো মনে...
নাকি মুখীর থেকে কোনো তরঙ্গ ভেসে এল আমার দিকে...যা আমায় সাহসী করে তুললো...
আমি মুখীর শীর্ণকায়,লোলচর্ম কুৎসিত মুখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম.... খুব চেনা একটা ছবি কেন যে মনে এসেও আসে না!!!
" আমি তোমায় বিশ্বাস করি মুখী... আমি জানি... তুমি হাজার খারাপ হলেও আমার ক্ষতি করবে না...".... আমি মুখীর নোংরা বড় বড় বাঁকা নখওয়ালা,শিরা বেরোনো এবড়োখেবড়ো পায়ের কাছে বসে পড়ে মুখীর মুখের দিকে চাইলাম.....আর....আর.... হঠাৎ..একটা ছায়া ছায়া....ঘন নীলচে ধোঁয়া কোথা থেকে ছুটে এসে আমাদের যেন তার গভীরে লুকিয়ে ফেললো..... নাকি...আমারই দৃষ্টি বিভ্রম হলো.....না জ্ঞান লুপ্ত হোলো জানি না....
আমি.... আমি দেখলাম.... আমার চোখের সামনে থেকে সব চেনা জানা পরিবেশ কোথায় যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে...আমি একটা অন্য জগতে.....এ কোথায় এলাম আমি... আমার চারপাশের সমস্ত আলো কোথায় মুছে গেল?? উফ্...কি এক ভয়ঙ্কর টান আমাকে এক অসীম অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে....মা গো !!!! কি অমোঘ তীব্র সেই টান....আর আমার চারপাশ থেকে ছুটে এসে আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছে... ওগুলো কি....তারা!! চাঁদ.... ধূমকেতু.... আমি কোথায়???কোন ব্ল্যাকহোলে???কোন মহাশূন্যে??কেন?? সেই শালবনীর বিশাল...পুরোনো বাড়িটা....যেটা নাকি আমার শ্বশুর বাড়ি....যে বাড়িতে নাকি আমার আর আমার বর্তমান পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ অপ্রাকৃত, অশুভ বিপদ ওঁৎ পেতে আছে... আমার স্বামী... আমার মেয়ে.... আমার শাশুড়ি....শ্বশ অমানুষ খুড়শ্বশুর.....আর সেই ভয়ঙ্কর পিশাচিনী....আর...আর....মুখী.....এরা কোথায় সব??? নাঃ...এই ভয়ঙ্কর টান আমি আর সহ্য করতে পারছি না....ঈশ্বর...রক্ষা করো...রক্ষা করো....ত্রাহি মাম....বলার নাকি ভাবার সাথে সাথেই আমি যেন সেই নিকষ অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে এক আলোর উদ্ভাস দেখতে পেলাম......আর অনুভব করলাম সেই ভয়ঙ্কর টান আমাকে এইখান অবদি নিয়ে আসার জন্যই ছিল বোধহয়... উফ্ কি তীব্র আলো.....আলো?? নাকি আলোয় মোড়া এক রথের মত কিছু.... হ্যাঁ... চালকবিহীন রথের মতোই তো লাগছে....সেই রথে কে ওটা??? নোংরা মলিন শাড়ি পড়া.... আমাদের সেই রাস্তা থেকে তুলে আনা মুখী না???এ কি ভীষণ রূপ ওর!!!!মলিন উন্মুক্ত চুল হাওয়ায় উড়ছে...দুটো চোখে এক নির্মম নিষ্ঠুর চাহনি...লোলচর্ম কুৎসিত মুখাবয়ব থেকে ক্ষিদে আর নিষ্ঠুরতা যেন উপচে পড়ছে....মুখীর পায়ের কাছে... মাথায়... কাঁধে কাক ঠুকরে চলেছে ক্রমাগত...আমার দিকে ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত দৃষ্টি মেলে... প্রায় দন্তবিহীন বিভৎস মুখে নিঃশব্দে হাসলো মুখী...হাসলো!! না কি হাঁ করলো???আর আমি দেখলাম...সেই হাঁ করা মুখগহ্বরের মধ্যে আমার দুপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আমার স্বামী...শ্রিয়া, শাশুড়ি ...খুড়শ্বশুর... বড়'জা.... আমার মামা মামী... আমার জানা যতেক জীবিত মানুষ....এমন কি আমিও......
"ও মাগী....বলি ভির্মি খেলো নাকি গা....এরে নিয়ে আমি একন কি করি....হে ভগমান...."
চোখ খুলতেই সন্ধ্যের আবছায়া তে আমার সামনে দাঁড়ানো...রাস্তা থেকে তুলে আনা অশক্ত বৃদ্ধ অথচ সীমাহীন ক্ষিদের অধিকারীনি সবার ঘৃণার পাত্রী মানুষ মুখীকে দেখতে পেলাম... আর বুঝলাম..... আমি সেই সীমাহীন অন্ধকারের অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে....(নাকি আলোর?) ফিরে এসেছি....নাকি যাইইনি?? যা ঘটেছে...সবই আমার মাথার মধ্যেই!!!
আমি উঠে দাঁড়ালাম....মুখীর দিকে তাকিয়ে হাসলাম.... আমার আর কোনো দ্বিধা....কোনো ভয় নেই.....
"চলো মুখী.... তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে.... তোমার হাত ধরে আমি সব জায়গায় যেতে পারি...."
0 Comments.