- 9
- 0
❝রাজদীপের সঙ্গে আড্ডা❞ - তৃতীয় আড্ডা
জন্ম তারিখ ও সাল: ১৯৪২ সালের ২০ জ্যৈষ্ঠ, রাজপুর-সোনারপুর সংলগ্ন একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম হরিনাভিতে।
বাবা ও মায়ের নাম:
শ্রী ললিত মোহন মিত্র এবং শ্রীমতি কাত্যায়নী মিত্র।
পড়াশোনা: ছাত্র জীবন শুরু হয় আমাদের গ্রামেই। তখন গ্রামে মেয়েদের স্কুল ছিল একটাই। সেই স্কুলটির পিছনে আমার বাবা এবং তৎকালীন কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষের চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল "সুভাষিনী বালিকা বিদ্যালয়" নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে অবশ্য এটি সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। বরাবরই আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। এই সুহাসিনী বালিকা বিদ্যালয় আমার প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হলেও পাশের গ্রাম রাজপুর পদ্মমণি বালিকা বিদ্যালয় থেকে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হই। তখন উচ্চমাধ্যমিক ছিল না। আমি আই.এ. পরীক্ষা দিই মুরলীধর গার্লস কলেজ থেকে। এই কলেজেই পরবর্তীকালে বাংলা অনার্স নিয়ে উত্তীর্ণ হই। ওখানে ত্রিপুরারী সেন শাস্ত্রী, অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ, সুসাহিত্যিক সুশীল জানার সংস্পর্শে আসি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ.। এখানে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম সুকুমার সেন, ডক্টর শশীভূষণ দাশগুপ্ত, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শংকরী প্রসাদ বসু, ডক্টর প্রমথনাথ বিশী ও সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বড় বড় বিদ্যোৎজনের সান্নিধ্য। এমএ পাস করার পর বোড়ালে ঋষি রাজনারায়ণ বিদ্যামন্দিরে বছরখানেক শিক্ষকতা করি। ইতিমধ্যেই ডাক এল আমার প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র সুভাষিনী বালিকা বিদ্যালযের সহ-শিক্ষিকা হওয়ার। এরপর যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছে পিএইচডি করি।
প্রকাশিত গ্রন্থ : বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প চর্চা (প্রবন্ধ)। কাব্যগ্রন্থ - শুদ্ধ সমর্পনে, বুকের নির্মাণ জুড়ে, শব্দের সিঁড়ি ভেঙে, করতল শূন্য এ জীবন এবং প্রতি পদের চাঁদ।
★ রাজদীপ : শৈশবের কথা কিছু বলুন। কীভাবে বেড়ে উঠলেন। আজ ফিরে তাকালে কি মনে পড়ে?
# শিখা দত্ত : দেশ জুড়ে তখন বামপন্থী আন্দোলনের জোয়ার। বাড়িতে, পথেঘাটে শুধুই বিপ্লবের কথা। আমরা কিছু না জেনেই সেই শৈশব থেকেই ঢুকে পড়ি বামপন্থী চিন্তা চেতনার জগতে। খুব ছোট বয়স তখন ৩/৪ হবে আমার মাতৃ বিয়োগ ঘটে। মা যে কি বস্তু কিছুই জানতাম না। জানতাম শুধু আমার বাবাকে। চিন্তা চেতনায় তিনি ছিলেন এক প্রগতিশীল মানুষ। ইউথ কোয়ার এর অনুষ্ঠানে আমি সেই ছোট্ট বয়সে দাদাদের সাইকেলের পেছনে বসে অনুষ্ঠান করতে যেতাম। প্রাণ ঢেলে আবৃত্তি করতাম। ওই দাদারাই আমার সাইকেলে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন রাত বারোটায়। পুরোপুরি বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা, জ্যোতি বসু এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে জনসভায় যোগ দিতে আমার দাদা ছিলেন কট্টর বামপন্থী। সলিলদা-কে দেখেছি তখন আমার বয়স ৭/৮ হবে। আজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে ভাবি রাজনৈতিক সেই নিষ্ঠা আমরা কীভাবে হারিয়ে ফেলেছি দুঃখ ও রাগ হয় আমরা একটা ভালো রাষ্ট্র গড়তে পারলাম না।
★ রাজদীপ : ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময় আপনার বয়স পাঁচ বছর। সেই দিনটির কোন স্মৃতি আপনার আছে?
# শিখা দত্ত : ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময় আমার বয়স তখন পাঁচ। সেই শিশু বয়সেই দাদা দিদিদের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। সেই সব দিনের স্মৃতি এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সেসময়ে স্বাধীনতার অর্থ জানতাম না শুধু আবছা মনে পড়ে স্বাধীনতার দিন খুব ভোর থেকে ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি বেজে চলেছে। রাস্তায় পতাকা হাতে অনেক মানুষ হেটে চলেছে। কেউবা লরির মাথায় চেপে গান গেয়ে পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।
★ রাজদীপ : কবিতার দিকে প্রাথমিক ভালো লাগা গড়ে উঠলো কিভাবে?
# শিখা দত্ত : কবিতা আবৃত্তি করতে করতেই কবিতার প্রতি ভালোলাগা। আমার আদর্শ কবি ছিলেন বামপন্থী কবি শ্রীবিষ্ণু চক্রবর্তী। আমাকে ওই অল্প বয়সেই তিনি লিখতে উৎসাহ দিতেন। যা কিছু কবিতা লিখতাম উনি খুব প্রশংসা করতেন আসলে কবিতা লিখি এটাই উনি চাইতেন।
★ রাজদীপ : কাদের কবিতা পছন্দ হয় আপনার? অর্থাৎ আপনার ভালো লাগার কবি কারা? কেন?
# শিখা দত্ত : বাংলা সাহিত্যে পছন্দের কবি অনেকেই। যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুধীন দত্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার এবং শঙ্খ ঘোষ। একালের অনেক কবিই আমার প্রিয় তবে শঙ্খ ঘোষ কে আমি সবার উপরে রাখি। কেননা সমগ্র সমাজের অন্যায় শোষণ এবং অশুভ আঁতাতের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতায় সীমাহীন প্রতিবাদ আমাকে মুগ্ধ করে, নূতন করে জীবনকে ভাবায়। চলমান ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার মুখচ্ছদটি দক্ষ হাতে তুলে দিয়েছেন নির্মম শব্দ প্রহারে।
★ রাজদীপ : নিজে সিরিয়াসলি কবিতা চর্চা শুরু করলেন কোন সময় থেকে?
# শিখা দত্ত : খুব ছোট বয়স থেকেই কবিতা চর্চা শুরু। তবে সিরিয়াসলি কবিতার চর্চা শুরু হয় এমএ পড়তে পড়তে। তখন ইউনিভার্সিটিতে পত্রিকা চালাচ্ছি নিজের কবিতাও সেখানে যুক্ত করছি, কবি সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ। যাঁদের উৎসাহ এবং ভালোবাসায় কবিতা লেখায় পাকাপাকি যাত্রা শুরু।
★ রাজদীপ : লেখালেখির জগতে বন্ধুবান্ধব, সংঘযাপন ইত্যাদি আপনাকে প্রভাবিত করে বা করেছিল?
# শিখা দত্ত : লেখালেখির জগতে আমার বন্ধু কবি উত্তম দাসের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা করার দরুন সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওর একাধিক কবিতা আমাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। সেই সময় করুণাসিন্ধুদের অসম থেকে এসেছিল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "কন্ঠে পারিপার্শ্বিকের মালা"। প্রকাশ হতেই হু হু করে বইটি বিক্রি হলো। অসম থেকে এসেছিল এমএ পড়তে। আমার ভালো বন্ধু ছিল নবেন্দু সেন, অমিয় দত্ত। এইসব বন্ধুরা আমার কবিতার মুগ্ধ পাঠক ছিল।
★ রাজদীপ : আপনি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছে কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন?
# শিখা দত্ত : আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ওঁর অধীনে "আধুনিক বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প চর্চা"এই শিরোনামে গবেষণা করি। আলোচনাটি তুলনামূলক ছিল।
★ রাজদীপ : বাংলা কবিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার সেই দেখার কথা আমাদের কিছু জানান।
# শিখা দত্ত : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত পালিত। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা। এবং বেড়ে ওঠা। তাঁর মা শ্রীমতি নীহারিকা দাশগুপ্ত কবি নজরুল ইসলামের কাছে গান শিখেছিলেন। নজরুল গীতিতে তাঁর পারদর্শিতা সমকালীনদের চোখ এড়ায়নি। স্বভাবতই তার পুত্র-কন্যার রক্তে ছিল সংগীত প্রতিভার দীক্ষা। অনেক সময়ই আলোকরঞ্জন বাবু, গলায় তুলে নিতেন রবি ঠাকুরের গান। নিখুঁত উচ্চারণ, অননুকরণীয় সংগীত সুধায় অনেকবারই ধন্য করেছেন আমাকে। ওঁর মেজ ভাই অশোকরঞ্জন-এর গলায় রবি ঠাকুরের গান খেলতো চমৎকার। বসন্ত ঋতুর গানে তাঁর দরাজ কণ্ঠস্বরে বসন্ত প্রাণদ হয়ে উঠতো । অত রাশভারী স্যারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল হিন্দি সিনেমায়। বোম্বের গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী হেলেন ছিল তাঁর প্রিয় তারকা। তাঁর বৈদগ্ধের সঙ্গে এই ছেলেমানুষীটাও কেমন মানিয়ে যেত। একবার উনি আমাকে একটি ইংরেজী বইয়ের অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। আমি সেটি নিজে না করে অন্যকে দিয়ে অনুবাদ করে যথারীতি ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। উনি সেটি পড়েই বুঝলেন যে অনুবাদটি আমার করা নয়। লেখাটি ফেলে দিয়ে সামনে বসিয়ে নতুনভাবে অনুবাদটি করিয়ে ছাড়লেন। দুই একদিন ওঁর কাছে না গেলে উনি ছুটে আসতেন আমার বাড়ি। আমার দাদার সঙ্গে রীতিমতো রাজনীতি নিয়ে তর্ক জুড়ে দিতেন। এই হলো আমার শিক্ষক ও অভিভাবক অলোকরঞ্জন। কবিতায় তাঁর ছিল অমোঘ মুদ্রাগুণ, শব্দ নির্মাণের ভাস্কর্য, পাঠকের অভ্যস্ত কাব্যাচরণকেই ধ্বস্ত করে দিত। শব্দ নির্মাণে মুদ্রা ছাড়াও আরো একটি মুদ্রা-কে, অলোকরঞ্জন তাঁর নিজ কাব্যভাষায় অঙ্গ করে নিয়েছিলেন, তা হলো কবিতার দ্যোতনা। তিনি লিখলেন "কবিতাকে আজ আর একচোরা ভাবের ঘরে চুরি করা মানায় না। তাকে আজ চিত্রকলা সংগীত বা ফিল্ম-এর কাছ থেকে আঁচলা ভরে রসদ নিতে হবে।" দেশে দেশে অন্তহীন যুদ্ধের বীভৎসতায় তাড়িত কবি কবিতাকে প্রসারিত করেছেন যুদ্ধের ছায়ায়। বারবার কবিতায় নিজেকে ভেঙেছেন, নতুন নতুন পথের দিশায়। জার্মানি বসবাস করলেও তাঁর বিশ্বনাগরিক চেতনার সঙ্গে সমসাময়িক জীবনবোধ তাঁকে আরও প্রসারিত করেছিল। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় তিনি একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ও বিদ্রোহী। আমাকে লেখা প্রচুর চিঠিপত্র ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলি সযত্নে রাখা সম্ভব হয়নি। আমার বিবাহে ওনারা সপরিবারে নিমন্ত্রণে এসেছিলেন। অন্যান্য উপহারের সঙ্গে তাঁরই লেখা ‘শিল্পিত স্বভাব’ গ্রন্থটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।
★ রাজদীপ : আপনার কথায় বুঝতে পারছি কবি উত্তম দাশ আপনার বন্ধু স্থানীয় ছিলেন।মহাদিগন্ত পত্রিকা নিয়ে তাঁর ব্যস্ততা আপনি সামনে থেকে দেখেছেন। কবি উত্তম দাস এবং তাঁর পত্রিকা বিষয়ে যদি কিছু স্মৃতিচারণ করেন ভালো হয়।
# শিখা দত্ত : কবি উত্তম দাসের অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও সদাহাস্যময় বন্ধু বাৎসল্য তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। তার সুমিষ্ট ব্যবহার এবং সাংগঠনিক প্রতিভায় তৎকালীন জনপ্রিয় প্রথম শ্রেণির কবিদের একত্রিত করার দুর্লভ ক্ষমতা ছিল। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬২ সালে তার অনুপ্রেরণা ও সম্পাদনায় প্রথম "বহ্নিশিখা" পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় থেকেই তৎকালীন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, জগদীশ ভট্টাচার্য, মলয় রায়চৌধুরী, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর থেকে শুরু করে আমাদের মতো সদ্য নবীন কবিরাও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। কবি উত্তম স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত। তার স্বপ্ন ছিল বাংলা সাহিত্যে একটা স্থায়ী আসন রেখে যাওয়ার। তাই এমএ পাস করার পর নতুন উদ্যোগে মহাসমারোহে প্রকাশিত হলো ‘মহাদিগন্ত’ নামে পত্রিকাটি। নানান বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণা, হ্যাঙরি আন্দোলন বিষয়ক লেখা, দুর্লভ সাক্ষাৎকার পত্রিকাটিকে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিল। পাশাপাশি তার নিজের চেষ্টায় নিজের বাড়িতেই গড়ে উঠলো প্রেস। এবং সেই প্রেসে তরুণ কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করাই ছিল তার চ্যালেঞ্জ। বাংলা কবিতায় সনেট ছিল তার গবেষণার বিষয়। একাধিক কবিতার বই সেই সঙ্গে মননশীল সৃষ্টিতে তার ভাণ্ডার অফুরন্ত ছিল। আমৃত্যু তিনি সাহিত্যসাধনা করে গেছেন এবং অতি পরিতাপের বিষয় মহাদিগন্ত পত্রিকাটি তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়।
★ রাজদীপ : আপনার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন আছে সে নিয়ে কিছু বলুন।
# শিখা দত্ত : আমার শিক্ষকতার শুরু আমারই স্কুল সুভাষিনী বালিকা বিদ্যালয়ে। বিবাহ সূত্রে এসে পড়লাম ব্যারাকপুরে । ব্যারাকপুর থেকে হরিনাভি যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল বলে দু’বছরের লিভ নিয়ে কল্যাণীতে বি.এডে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমি যখন পিএইচডি করি তখন যাতে স্কুল থেকে প্রয়োজন মতো ছুটি নিয়ে রিসার্চ চালাতে পারি, সেজন্য স্কুল থেকে বিশেষ সহযোগিতা পাই। এরপর শুরু হয় কাঁচরাপাড়া কলেজে শিক্ষকতা। বহু ওঠাপড়া টানাপোড়েনের মাঝখানে লেখার জগত খানিকটা স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে আমার স্বামীর আগ্রহে এবং সহযোগিতায় আবার কবিতায় ফিরি।
★ রাজদীপ : নিজের কবিতায় কী বলতে চান?
# শিখা দত্ত : যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বার্তাটি ও পৃথক হতে বাধ্য। ক্ষয়িষ্ণু এই সময়ের যন্ত্রণা বেদনা এবং তদ্সঞ্জাত ক্ষোভ – সেটাই আমার কবিতার ভাবনা। আসলে কবির অনুভূতি একরকম থাকে না। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কবিতার অবয়ব এবং চিন্তা চেতনা ভিন্ন হতে বাধ্য।
★ রাজদীপ: আপনার কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থগুলির কোন প্রেক্ষিত আছে? কোন পশ্চাদপট? প্রেরণা?
# শিখা দত্ত : প্রথম জীবনে লেখা শুরু হয়েছিল বামপন্থী চিন্তাধারা নিয়ে। তারপর সময়ের সাথে সাথে ভাবনার পরিধি অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে শুরু করে আধুনিক কবিদের কবিতা পাঠ করে নিজের ভাব মণ্ডলে একটি বিপুল পরিবর্তন আসে। তখন আর কবিতা নিছক কোন কবির প্রেরণা থাকে না সে হয়ে ওঠে স্বয়ং সম্পূর্ণ।
★ রাজদীপ : মূলত কোন্ পত্রিকাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখেছেন এতকাল?
# শিখা দত্ত : সব পত্রপত্রিকার নাম আজ আর মনে পড়ে না। স্মৃতি অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। তবে বারুইপুর থেকে প্রকাশিত বহ্নিশিখা ও মহাদিগন্ত পত্রিকায় লিখেছি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দ্বারা পরিচালিত সংকলন পত্রিকায় লিখে শংসাপত্র ও পদক প্রাপ্তিও আমার কাছে বেশ সম্মানজনক ব্যাপার ছিল। এছাড়া যুগসাগ্নিক, কবিতাপত্র, রূপশালী, তৃণমঞ্জরী, ডহর, মান্দাস, বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা, নগর পেরিয়ে, অক্ষর প্রয়াস, উন্মুখ পত্রিকা, অবগুণ্ঠন এবং দিল্লি থেকে প্রকাশিত অজন্তা পত্রিকা ইত্যাদির নাম করতে পারি।
★ রাজদীপ : কবিতা কিভাবে লেখেন? স্বতৎসারিত হয় শব্দ? পংক্তি? তারপর কাটাকুটি করেন যথেষ্ট?
# শিখা দত্ত : স্বতৎসরিত ভাবেই শব্দ চলে আসে। পংক্তি তৈরি হয়। যতক্ষণ না মনোমত হচ্ছে কাটাকুটি চলতেই থাকে। এই কাটাকুটির মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠে আমার প্রার্থিত কবিতা।
★ রাজদীপ: নিজের কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা কিছু আছে?
# শিখা দত্ত : আমি তো অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। সেগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। সেগুলিকে জড়ো করে একটি প্রবন্ধের বই করতে পারি। কবিতা তো নিত্যদিনের সঙ্গী। আরো লেখার উৎকর্ষতার দিকে নজর দিতে হবে।
★ রাজদীপ : কবিতা লেখার সঙ্গে জনপ্রিয়তা, বই বিক্রি, পুরস্কার এইসব শব্দের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই।
# শিখা দত্ত : আমরা কবিতা লিখি নিজের মনের তাগিদে। জনপ্রিয়তা তো পাঠকের দরবারে তাদের ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে কবিতার জনপ্রিয়তা বাড়ে। বই বিক্রি করতে গেলে পেশাদার হতে হবে। যার পেশাদারিত্ব নেই তার বই খুব একটা বিক্রি হয় না। পুরস্কারে আমি খুব একটা বিশ্বাসী নই। এই নিয়ে আমার আর কোন বক্তব্য নেই।
★ রাজদীপ : আপনি হরিনাভিতে জন্মেছেন। আমার যেটুকু জানা তা অনুযায়ী বিধান রায়ের সঙ্গে ওই এলাকার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তাঁকে নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা আছে?
# শিখা দত্ত : বিধান রায়ের অবদান সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। শুধু মনে আছে হরিনাভি প্রগতি সংঘ ভবনের উন্নতি কল্পে ১৯৫১/৫২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের গ্র্যান্ড স্যাংশান হয়েছিল ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। সংঘ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটনের সময় তিনি এসেছিলেন। তৎকালীন প্রগতি সংঘের সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী মোল্লা ডঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করে এই গ্রান্টের ব্যবস্থা করেছিল। মজার কথা সংঘ ভবনের দ্বারোদঘাটনের দিন সব সদস্যরা মিলে রান্নাবান্না করে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিল। স্বয়ং ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ও সবার সঙ্গে বসে পাঁঠার মাংস-ভাত খেয়েছিলেন। একটা আফসোস এই যে এই অনুষ্ঠানের কোন ছবি তোলা যায়নি। কারণ তখন তো এত ছবি তোলার চলছিল না। আরেকবার, আমি যখন পিএইচডি করছি। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটে এসে শুনলাম স্বয়ং নেহেরু এবং বিধান রায় আসছেন এই ইনস্টিটিউটে। আমরা ভিড় করেছিলাম তাঁদের দেখার জন্য। নেহেরু এলেন, ছোট খাটো চেহারা, নিজস্ব সিগনেচার। তাঁর পাশে ঋজু ও দীর্ঘদেহী ডা. বিধান চন্দ্র রায়, দেখেই মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।
★ রাজদীপ : স্বাধীনতার পরে আপনার চোখের সামনে ভারতবর্ষের বিকাশ আপনি দেখেছেন। চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কতটা কি মিলল বলে আপনার মনে হচ্ছে আজ?
# শিখা দত্ত : দীর্ঘ লড়াই আর আত্মদানের বিনিময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো অথচ তারপর ভারতবর্ষের যে বিকাশ হলো সেটি একটা বাহ্যিক পরিবর্তন। পঁচাত্তর বছর পার করার পরেও নিরক্ষরতা এখনো দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যায়নি। দারিদ্র্যসীমার বাইরেও ভারতবর্ষ যেতে পারেনি। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে একদিন ভারতবাসী লড়াই করেছিল, আজকে কি আমরা মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারব যে আমরা সর্বাঙ্গে স্বাধীন? এখনো দারিদ্র্য শেষ হয়নি, জাতপাতের লড়াই শেষ হয়নি। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও শোষণমুক্ত ভারতবর্ষ আমরা দেখতে চাই।
★ রাজদীপ : এই পৃথিবী এবং সেখানে নিজের বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, অস্তিত্বহীনতা সময় প্রবাহ– এইসব বিষয়ে আপনাকে কীভাবে ভাবায়?
# শিখা দত্ত : আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পৃথিবী ছিল স্বপ্নের মত দিনে দিনে কত পরিবর্তন এলো। এলো ডিজিটাল যুগ। প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয় কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্তিত্বের সংকট তীব্রতর হয়ে উঠছে। এই সংকট নিয়ে গর্জে উঠেছে কবি শিল্পীরা, এই ভয়ংকর সময় থেকে রক্ষা পাবে কিভাবে পৃথিবী এটা আমার ভাবনা নয় সারা বিশ্ব এখন ভাঙ্গনের মুখে ,চতুর্দিকে যুদ্ধবাজদের রক্ত চক্ষু। এইসব ভাবনা আমাদের কুরে কুরে খায়।
★ রাজদীপ : পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ও জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে ইচ্ছে করে।
# শিখা দত্ত : পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ও জীবজগত আজ সংকটে। যুদ্ধবাজ পৃথিবীর ভয়ংকর মুখোশ আজ খুলে পড়েছে। সভ্যতার সংকটের সঙ্গে জীবজগতের ভবিষ্যৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই পৃথিবী আমাদের চিনতে অসুবিধে, সুকান্তের ভাষায় আগামী সন্তানের জন্য বাসযোগ্য নয় এই পৃথিবী। অস্ত্র বলে বলী য়ান এই সভ্যতার মদমত্ত দর্পে পৃথিবী ধ্বংসের পথে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয়। জোটবদ্ধ হতে হবে। শেষে বলি, "দাও ফিরে সে অরণ্য"।
★ রাজদীপ : আরেকটা সুযোগ পেলে নিজের জীবন বা কবিতাকে নতুন কোনো রূপে দেখতে চাইতেন?
# শিখা দত্ত : প্রশ্নটা যথেষ্ট কঠিন। আরেকটা সুযোগ পেলে জীবনের যে ভুলগুলো করেছি সেগুলো শুধরে নিতাম। কবিতাও নিশ্চয়ই নতুন ভাবনার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতো।
কবি শিখা দত্ত-র দুটি কবিতা —
চৌকাঠ
আগুনে পুড়েছো কখনো? চুপচাপ ক্রমাগত,
শুনেছো কি অস্তিত্ব জুড়ে নিঃশব্দ হাহাকার–
সেই কবে থেকে ভাসিয়ে রেখেছি
কচুরিপানার এই অলীক জীবন।
যতবার ভেবেছি ফিরে যাব হলুদ পাখির কাছে;
যতবার ভেবেছি দু-হাতে সব সরিয়ে ফিরে যাব
লাবণ্যময় নদীটির কাছে,
ততোবার এক অদৃশ্য চোরাবালি
ভয় দেখায় অজানা সংকেতে।
তখনই ঢাল হয়ে দাঁড়ায় কার যেন মন্ত্রপূত জল
ঘরের চৌকাঠে।
উঠোন
আমার সমস্ত উঠোন জুড়ে রাত্রি এঁকেছি
তুমি চেয়ে আছ অপলক,
গোধূলি চেয়ে আছে অপলক,
রাগ ভেসে যাচ্ছে নদী জলে ধুয়ে।
তুমি শুধু চেয়ে আছো হৃদয় জুড়ে;
আমি গিয়ে বসি ঝুল বারান্দায়
যেন এক কিশোরী মেয়েটি;
তুমি বন্ধু হয়ে পাশে বসো।
তুমি হাত,
তুমি নিঃশব্দ ভালবাসা,
আমার দু-চোখে তাই রাত্রির অমল জোৎস্না
তুমি অনর্গল বিভা,
আমি নতজানু,
ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়াই উত্তাপ।
এসো এই নদী জলে
ভাসাবো চীবর অনন্ত স্রোতে,
চেয়ে থাক তোমার প্রতিমা
আমার উঠোন জুড়ে
তুমি অনির্বাণ।
[এই সাক্ষাৎকার বা তার অংশবিশেষ কোনোপ্রকারে পুনর্ব্যবহারের জন্য রাজদীপ ভট্টাচার্যের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক]
0 Comments.