Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

রম‍্যকথায় মৃদুল শ্রীমানী

maro news
রম‍্যকথায় মৃদুল শ্রীমানী

লক্ষ্মণের দ্বিতীয় শক্তিশেল

হনুমানকে সকালবেলা রাজসভায় গম্ভীরভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া নরচন্দ্রমা রাম বলিলেন, 'কি রে ব্যাটা, অমন হাঁড়িমুখো হয়ে বসে আছিস কেন?' হনুমান কোনো জবাব দিল না। আরো গম্ভীরতা প্রকাশ করিয়া নিজের করতলের রেখাগুলি একমনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। লক্ষ্মণ বলিলেন, 'কি রে হনু, খুব তেল হয়েছে না, নরেন্দ্র রামচন্দ্রের কথার জবাব দিস না?' হনুমান নিজের গোঁফে চাড়া দিতে দিতে কহিল, 'সব সময় সব কথার জবাব দিতেই হবে, এমন বাধ্য বাধকতা তো গণতন্ত্রে নেই। কথা বন্ধ রাখাও এক প্রকার মত প্রকাশ।' লক্ষ্মণ বলিলেন, 'ও ব্যাটা, আবার বুলি ঝাড়ছিস? এসব শিখলি কোথায়?' হনুমান বলিল, 'অসাংবিধানিক কথার জবাব দেব না।' রামচন্দ্র বলিলেন, 'চাকর বাকরকে মাথায় তুলে খুব ভুল করেছি দেখছি। ব্যাটা সংবিধান আওড়াস!' হনুমান আর সহিতে না পারিয়া বলিলেন, 'দেশে সংবিধান চালু আছে শিক্ষিত লোকের পড়াশুনা করার জন্য।' লক্ষ্মণ হাসিয়া কহিলেন, 'আহা, বানরের আবার শিক্ষার গরমাই!' হনুমান চটিয়া কহিল, 'আমায় বানর বলিবেন না। আমি পবনপুত্র। পবন ছিলেন বৈদিক যুগের বিশিষ্ট দেবতা। আমি সেই সূত্রে দেবতার সন্তান।' বিভীষণ এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন। নিমীলিত নয়ন দেখিয়া বুঝার উপায় ছিল না যে তাঁহার মনের মধ্যে কী উথাল পাথাল চলিতেছে। তিনি বলিলেন, 'আজ্ঞে নরেন্দ্র নরচন্দ্রমা মহোদয়, দেখুন, জন্ম নিয়ে গাল পাড়া আজকের দিনে বৈধ নয়। আমাদের সংবিধান বলছেন জন্মের কারণে কাউকে তফাৎ করা চলে না।' রামচন্দ্র বলিলেন, 'তোরা যে অবাক করলি। ব্যাটা রাক্ষস, আমার পায়ের দিকে চেয়ে ছাড়া কথাটি বলতে পারতিস না, আর আজ আমায় সংবিধান দেখাস?' বিভীষণ কহিলেন 'হে নরেন্দ্র, কুবাক্য বলা উচিত নয়। রাজনীতির লোকেরা যদি কথায় কথায় কুৎসিত বাক্য বলেন, তাহলে বিশেষ নিন্দাজনক ব্যাপার হয়।' লক্ষ্মণ বলিলেন, 'হেই রাক্ষসের পো, তোর আবার সাত সকালে হল কি?' বিভীষণ বলিলেন, 'দেখুন, পিতৃ পরিচয়ে আমি ব্রাহ্মণ সন্তান। আমার পিতার নাম বিশ্ৰবা মুনি। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন তিনি সমগ্র বেদ অধিগত করেছিলেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন ব্রহ্মা। সেই হিসাবে আমি অতি উচ্চ স্তরের ব্রাহ্মণ।' হনুমানও বুক চাপড়াইয়া কহিল 'আমিও দেবতার সন্তান। রীতিমতো বৈদিক দেবতা।' লক্ষ্মণ বলিলেন 'জারজ সন্তান।' ব্যস, হনুমান রাগিয়া উঠিয়া দন্ত বিকশিত করিয়া প্রবল মুখভঙ্গি করিতে উদ্যত হইলেন। সভাস্থলে উপস্থিত নল, জাম্ববান, সুগ্রীব প্রমুখ গা ঝাড়া দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। তাহা দেখিয়া লক্ষ্মণ একটু ভীত হইলেন। হনুমানকে বলিলেন, 'তুই আজকাল ভারি বিদ্বান হয়েছিস। সব কথায় চটে যাস। সুগ্রীব বলিলেন 'হনুমান মহাশয় ইদানীং জে এন ইউ তে পড়াশুনা করিয়া ডক্টরেট হয়েছেন। ' জাম্ববান বলিলেন, 'সোসিওলজি ও অ্যানথ্রোপলজি দুই বিষয়েই ডক্টরেট। জাতপাত নিয়ে ওঁর সাথে কথা কয় সাধ্যি কার?' রামচন্দ্র হনুমানের প্রতি রাগিয়া কহিলেন, 'আমাকে যে বলেছিলি পর্বতে গিয়ে তপস্যা করবি। তাই তো ছুটি মঞ্জুর করেছিলাম। স্টাডি লিভ বললে অ্যালাও করতাম না।' হনুমান বলিল 'রাইট টু এডুকেশন' কথাটা শুনেছেন? পড়তে দেবেন না মানে?' নল বললেন, 'খুব মিথ্যে ও বলে নি নরচন্দ্রমা। আরাবল্লী পর্বতে মধ্যে মধ্যে গিয়ে লাফ ঝাঁপ মর্নিং ওয়াক করে আসত ও। সেটা তো দিল্লিতেই।' বিভীষণ কহিলেন, 'জমানা বদলে গিয়েছে। এখনকার দিন হলে আর সাধক শম্বুকের মুণ্ডু কাটতে পারতেন না। দলিত তাস খেলে দেব দেখবেন।' হনুমান বলিলেন, 'সীতা মাকেও আপনি বড় কষ্ট দিয়েছেন। বিয়ে করা বউকে কোন ভদ্রলোকের বাচ্চা হরিদ্বারে ফেলে রেখে আসে!' রামচন্দ্র প্রচণ্ড রাগিয়া গিয়া তোতলামি করিতে করিতে বলিলেন, 'সে আমাকে ছোটো বেলায় ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে দিয়েছিল, তো আমি তাকে নিয়ে করব কি?' বিভীষণ বলিলেন, 'গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণে আজকাল আইন এসেছে। চাইলেই বিয়ে করা বউকে তপোবনে পাঠাতে পারেন না। আর অন্য পুরুষের সাথে লিপ্ত, এমন সন্দেহ প্রকাশ করতেও পারেন না।' রামচন্দ্র আরো চটিয়া বলিলেন, 'তবে রে ব্যাটা, সব অনার্য চাঁড়ালের দল, আমায় ভদ্রতা শেখাস?' হনুমান ও বিভীষণ একযোগে ততোধিক গলা চড়াইয়া কহিল, 'সাবধান, আমরা বৈদিক দেবতার বংশধর। গায়ে ব্রহ্মরক্ত বইছে। আপনি সামান্য নর। সাবধান হোন। দিন বদলাচ্ছে।' হনুমান ও বিভীষণের সমবেত চিৎকার শুনিয়া লক্ষ্মণ অনেকদিন পর আবার মূর্ছা গেলেন। ভূমিতে পতনের বিকট শব্দ হইল।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register