Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোট গল্পে অমিতাভ মৈত্রের

maro news
ছোট গল্পে অমিতাভ মৈত্রের

আলুর পুতুল

ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি তখন। কুড়ি পঁচিশ ঘরের ছোটো ছোটো পাড়ায় ছড়ানো বড় বড় মাঠ—যেখানে আমরা ফুটবল, ক্রিকেট, ডাংগুলি, পিট্টু খেলতাম। এক্কা দোক্কা আর রুমাল চোর খেলত মেয়েরা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। শুধু দোলের দিন একটু তাড়া টাড়া করা হত। সেই কৌম আদিম জনজাতির মধ্যে কোনো সাপ বা আপেলের প্রবেশ ঘটেনি তখনও। আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত পাশের বাড়ির একটা রোগাটে চেহারার মেয়ে—পুসি। একদিন আমার পোশাক বদলানোর সময়ে না জেনে ও ঘরে ঢুকে বিস্ফারিত চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে অবরুদ্ধ হাসিতে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে পালালো। শরীর থেকে যেন সব রক্ত সরে গেল আমার। মনে হলো, আর কী লাভ এই অপমান সহ্য করে বেঁচে থেকে! তারপর ছুটে বেরিয়ে গিয়ে ধরলাম পুসিকে। দিলাম দু চার কোঁৎকা। সরল, মহৎ হৃদয় বড়োরা খোঁজ নিলেন। মাথায় আলু নিয়ে চুপ করে থাকল পুসি। কিছু ভাঙল না। আমাকে নতুন করে বেইজ্জুতিও হতে হল না। পরদিন পুসিকে ওর প্রাণাধিক প্রিয় তেঁতুলের আচার খাওয়ার নিমন্ত্রণ করার মধ্যে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর চেষ্টা ছিল। পুসি এলো তেঁতুল খেতে। বিকেলে ছাদে বসে আচার খেতে খেতে বলছিল, ওর দিদির মতো বড়ো হলে ওরও নিশ্চয় বাচ্চা হবে। আর তখন ও শুধু আচার খাবে, আর কিচ্ছু খাবে না। স্কুলে যাবে, তবে দুপুরের পর প্রাচীরের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। প্রজাপতি, কাঠবেড়ালি, ফড়িং—এইসব দেখবে আর শিউলি ফুল কুড়োবে। একদিন বলছিল ওরও ওর মায়ের মতো অসুখ হয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। ওর বাবা থাকে অন্য কারো কাছে। ওকে কখনও দেখতে আসে না, জামা কিনে দেয় না, ভাল বাসে না। বাবা তো ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু নেয় না। পিসি বলেছে, একটা রাক্ষুসীর কাছে চলে গেছে বাবা। একটু থেকে খুব অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ বলেছিল, তোকে মাঝে মাঝে যদি বাবা বলে ডাকি, তুই রাগ করবি? লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকবো। রোজ না, মাঝে মাঝে। তুই রাগ করিস না, কেমন? তুই যদি আমার বাবা হতিস, বেশ হতো। পরদিন দুপুরে আমি ছাদে একা একা বোলিং প্র্যাকটিস করছি, একটা হাততালির শব্দ শুনলাম। ওদের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে হাসছে পুসি। আমাকে তাকাতে দেখে নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে কয়েকবার লম্বা করে বলল—বা...বা! বা...বা! এক বিকেলে পুসি এলো। বিষণ্ণ মুখে, দুটো বিলিতি আমড়া নিয়ে। জানতে চাইলাম ওর আমরা কোথায়। মুখ নিচু করে মাথা নাড়ল। ‘নেই’। বলল ও আর টক আচার খাবে না কোনোদিন। একদম ছেড়ে দেবে। ওর মামা বা অন্য কেউ ওকে অনেক দূরের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছে। সেই স্কুলে ওকে হয়তো একাই থাকতে হবে এখন থেকে। সেখানে হয়তো কোনো ভাঙা প্রাচীর নেই যেখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। বোধহয় সেখানে পুতুল খেলতেও দেয় না। একটা আলুর পুতুল দিল আমার হাতে। পরে কখনও ফিরে আসলে নেবে। বিকেলের বিষণ্ণ ছায়ায় আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল পুসি। চোখে জল। আমি পুতুলটার দিকে তাকিয়ে ‘বা...বা!’ ডাকটা শুনতে চাইছিলাম?
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register