Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ৩৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ৩৩)

স্রোতের কথা

পর্ব - ৩৩

[ জল…মাটি…আগুন আর রুল ]

এক মনে মিট্টির দিকে তাকিয়ে ছিলাম… দেখছিলাম, কি ভাবে মিট্টি সাদা সার্কেলটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দুটো ইন্ডিয়ান স্টাইলে গ্রিট করার মতো মুড়ে রেখে দাঁড়িয়েছে... আমি জানি,একে বলে হাতজোড় করে প্রণাম বা নমস্কার করা...দিম্মা আমাকেও শিখিয়েছিল... আর এক রকম প্রণামও ও হয়...সেটা বয়সে বড়'দের করতে হয়... সেটা পা ছুঁয়ে হয়... এখন অবশ্য মিট্টি দুটো হাত একসাথে জড়ো করে যে প্রনামটা করতে হয়,সেটাই করছে...ওর চোখদুটো বন্ধ...আর মুখটা নীরবে কিছু বলার ভঙ্গিতে অল্প অল্প নড়ছে...তার সাথে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে,ওর শরীরটা সামনে পিছনে অল্প অল্প দুলছে... "স্রোতস্বিনী... স্রোতস্বিনী... একটু এদিকে শোনো তো..." এত মগ্ন হয়ে মিট্টির দিকে তাকিয়ে ছিলাম...যে প্রিস্টেস রোশনাই জাহানের ডাক আমি শুনতেই পাইনি... চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলাম ...রোশনাই জাহান কখন যেন ওনার নিজের বসার জায়গা...যেখানে ডায়াসের উপর রাখা চেয়ারগুলোতে আর সব প্রফেসরদের সঙ্গে উনি বসে ছিলেন...সেই উঁচু ডায়াসটার একদম কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন "ওহ্ স্যরি...ইয়েস ম্যাম... বলুন ম্যাম..." আমি একটু ওনার দিকে সরে এলাম... "তোমার সাথে আমার জরুরি দরকার আছে...হাই প্রিস্টেসের দেওয়া পানিশমেন্ট অনুযায়ী কাল থেকে তোমাকে আমার সাথে এ্যানিম্যাল হাসব্যান্ড্রীতে আমার কথা মতন ওদের সার্ভিস দিতে হবে...সেই নিয়েই তোমাকে কয়েকটা জরুরী ইন্সট্রাকশন দেওয়ার ছিল..." "ম্যাম এক্ষুণি যাবো??...না মানে ইয়ে মিট্টির...মানে মৃত্তিকার এলিমেন্টের এফিনিটি টা একটু দেখে নিয়ে... মানে এই রিচ্যুয়াল টা শেষ হলে যদি যাই..." "আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে"... প্রিস্টেস রোশনাই প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন... "মৃত্তিকার টা দেখে নিয়েই এসো কিন্তু... আবার তোমাকেও তো যেতে হবে ওখানে... তার আগেই তোমায় বিষয়টা বুঝিয়ে দিই...আমি আবার পুরোটা শেষ হওয়া অবধি থাকতেও পারবো না...আমার রুপশ্রী আর ম্যাডেলিন... দুজনেই প্রেগন্যান্ট... একেবারে এ্যাডভান্স স্টেজ...এখন আমি ওদের কাছে না থাকলে,ওরা খুব অভিমান করবে... তুমি মৃত্তিকার রিচ্যুয়ালটা শেষ হলেই চলে এসো..." প্রিস্টেস রোশনাই জাহান খুব তাড়াহুড়ো করে গিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন...কি জানি রুপশ্রী আর ম্যাডেলিন আবার কে...হয়তো ওনার রিলেটিভ হবে "হে আমার মা...এসো এসো আমার কাছে..." মিট্টির গলা শুনে চমকে তাকালাম...মা আবার কাকে বলছে ও!! ভাবতে ভাবতেই তাকিয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম...! আশ্চর্য ভাবে কখন যেন‌ আমাদের চারপাশের প্রকৃতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে... চারপাশের গাছ গুলো কখন যেন সবুজ পাতা...ফুলে একেবারে ভরে উঠেছে... আমার পাশের আমগাছটা পাকা পাকা ফলে একেবারে পরিপূর্ণ...ফলগুলো এত পাকা যে টুপটাপ করে সবুজ ঘাসের উপর ঝরে ঝরে পরছে...অথচ এই শীতে কখনোই আম হওয়া সম্ভব নয়... এমনিতেই ইসপ্যামার চারিপাশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ...কিন্তু হঠাৎ করে তা যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে...এছাড়াও...এই রাতেরবেলাতেও গাছে গাছে পাখিগুলো আনন্দে যেন কিচিরমিচির করে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে বেড়ানো থামাতেই পারছেনা...বয়ে চলা মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলের গন্ধ ছাড়াও ভেসে আসছে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ...পরে বুঝেছিলাম...সেটা আসলে পাকা শস্যের ঘ্রাণ...আমরা যেন প্রকৃতির কোলে এসে দাঁড়িয়েছি...আমি অনুভব করলাম... আমার পায়ের তলার মাটিও মৃদু মৃদু কাঁপছে... কিন্তু এ কম্পন মোটেই আর্থকোয়েকের মতো নয়...এ কাঁপুনি যেন খুশির...আনন্দের... ভালোবাসার চারপাশের সবাই আনন্দে খুশিতে হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠলো... সবচেয়ে জোরে হাততালি দিচ্ছেন উইলি আঙ্কল...আমি ওনার খুশি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আমার জ্যাকেটের পকেটে থাকা লকেট সমেত হার টা একবার অনুভব করে নিলাম...যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ওনার সাথে এটার ব্যাপারে কথা বলতে হবে। " মৃত্তিকা মাহাতোর এলিমেন্ট আর্থ...প্রথম পাঁচটার মধ্যে অন্যতম প্রধান... উফ্...গডেস মহাকালী প্রনাম..." প্রিস্টেস অহনার খুশীতে উচ্ছ্বল গলা বলে দিল উনি মিট্টির আ্যাচিভমেন্টে কতটা আনন্দিত... মিট্টি ওর এলিমেন্টকে রিলিজ করে হাসি মুখে আমাদের মধ্যে ফিরে আসতেই আমরা যে যেমন পারলাম ওকে জড়িয়ে ধরলাম... "এই তোরা দ্যাখ তো...এখানে কি হলো!! কিরকম একটা সেনসেশন হচ্ছে!" বলতে বলতেই মিট্টি ওর কোঁকড়া চুলের ঢল টা ডান কাঁধ থেকে বাঁ দিকে সরিয়ে দিল...আর আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম মিট্টির ঘাড় আর কাঁধের সংযোগস্থলে একটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের ফুলে ভরা গাছের ট্যাটু ফুটে উঠেছে... " ওঃ মিট্টি!!কি অপূর্ব...আমার চোখে জল চলে আসছে রে..." "জল ভিতরে পাঠা প্যাম...ওই দ্যাখ...ডাক পড়েছে...তোর পালা এবার.." প্যাম ওর পুতুলের মত চুল ঝাঁকিয়ে...সাদা বেদীটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে... আমাদের দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে ঘোষনা করলো..."আমার আর ভয় করছে না...মজা লাগছে বেশ..." প্যাম, বেদীর উপর সাদা সার্কলটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই .... আমাদের কানে সমুদ্রের গর্জন ভেসে এল...তার সাথে যেন সমুদ্রের গন্ধওয়ালা জলকনা ভরা বাতাসের ঝাপটা আমাদের মুখ মাথা ভিজিয়ে দিয়ে গেল... প্যাম সার্কেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে এক দুষ্টুমির হাসি হাসলো আর তারপরেই আলোহার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাত টা ঘোরালো... আর... মুহূর্তের মধ্যে... আলোহার উপর ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো বৃষ্টি... নিমেষের মধ্যে বৃষ্টির জলের তোড়ে আলোহার ডিজাইনার ড্রেস চুপসে একশা আর মেক-আপ গলে আইলাইনার গলে মুখ কালি মাখা বেড়ালের মত কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করলো... সুজি,মিট্টি সমীর হা হা করে হাসতে লাগলো...রিজ্‌ দেখলাম বিব্রত মুখে একবার সমীরদের দিকে আর একবার আলোহার দিকে তাকাচ্ছে...ডাইকোও কি করবে বুঝতে না বুঝতেই হেসে ফেললো... আমি না হাসার বৃথা চেষ্টা করতে করতেই প্রফেসরদের দিকে তাকাতেই, প্রথমেই দেখতে পেলাম প্যামের মেন্টর প্রিস্টেস ডায়নাও মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন... ‌"তবে রে শয়তান...এত বাড় বেড়েছিস...আলোহা মুখার্জীর সাথে মেস্!!ইউ...বি* !জাস্ট ওয়েট এ্যান্ড ওয়চ..." মূহুর্তের মধ্যে আলোহা ঘুরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত নাড়াতে লাগলো...আর আমরা দেখলাম...ইসপ্যামার চারদিকে নানারকম ডিজাইনের ল্যাম্পপোস্টে যত লাইট জ্বলছিল...ঝপ করে সব নিভে গেল!! নাঃ...নিভে তো গেলো না...সব আলোগুলো পোস্ট থেকে বেরিয়ে... এক জায়গায় এসে মিলে মিশে এক বিরাট আলোর বল তৈরী হলো আর সেই চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বল আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে আলোহার সামনে এসে প্রভুভক্ত ভৃত্যের মত...যেন আলোহার নির্দেশের অপেক্ষায়...স্থির হয়ে ভেসে রইলো... "ওঃ শিট!! আলোহা মুখার্জীর এফিনিটি লাইটে..." ডাইকো চিৎকার করে উঠলো। "আলোহা... তোমার এলিমেন্ট কে রিলিজ করো এক্ষুণি...এটা নতুন ফ্লেজলিংদের রিচ্যুয়াল... তুমি সিনিয়র... তুমি ইনভলভ্ হয়ো না " প্রিস্টেস ডায়না চিৎকার করে উঠলেন। "নো ডায়না "...প্রিস্টেস ডায়নার থেকেও একটা গম্ভীর গলা প্রিস্টেস ডায়নাকে চুপ করিয়ে দিল... হাই-প্রিস্টেস মিরান্ডা প্রিস্টলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন... "ঝামেলার শুরুটা কিন্তু তোমার এ্যাকোলাইট প্যামেলাই করেছে...এখন‌‌ আলোহাকে না বললে তো হবে না ডায়না ডিয়ার...ও ও বা ছাড়বে কেন? পাওয়ার তো ওর ও আছে, তাই না?... নতুন ফ্লেজলিংদের বুঝতে হবে...এ্যান আই ফর এ্যান আই...আর এটাই ইসপ্যামার রুল...এখানে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না " আলোহার হাত নাড়ার ভঙ্গিকে অনুসরণ করে...আলোর বলটা সোজা প্যামের দিকে এগিয়ে গেল আর ওর মুখে গিয়ে আঘাত করলো...প্যাম চিৎকার করে চোখ চেপে বসে পড়লো... আর যে বৃষ্টি টা আলোহা কে ঘিরে পড়ছিল শুধু... সেটা গোটা ইসপ্যামা জুড়ে... আমাদের সবাইকে কাকভেজা করে দিয়ে পড়তেই থাকলো...আর ক্রমশঃ জলের ধার আর তীব্রতা বেড়ে যেতে থাকলো... "ব্যস আলোহা এনাফ! অনেক সহ্য করেছি... প্যামের যদি কিছু হয় না... আমি তোকে..." আমরা এতক্ষণ প্যামের দিকে তাকিয়ে আর বৃষ্টি সামলাতেই ব্যস্ত ছিলাম... সুজির চিৎকারে তাকিয়ে দেখলাম... সুজি কখন যেন আমাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে, সাদা বেদিটার উপরে‌ প্যামের কাছে , সাদা সার্কেলটার মধ্যে পৌঁছে গেছে...আর...আর ‌ সুজির প্রসারিত দুটো হাতের উপরে দাউদাউ করে জ্বলছে দুটো আগুনের গোলা... মূহুর্তের মধ্যে আগুনের গোলা দুটো আলোহার দিকে ছুঁড়ে মারলো সুজি... আর আগুনের গোলা দুটো আলোহার চারদিকে ঘিরে একটা বলয় তৈরী করে লেলিহান শিখায় জ্বলতে লাগলো... আলোহা আর্তনাদ করে উঠলো আর সাথে সাথেই দেখলাম...যে আলোর পিন্ড টা প্যাম কে আবৃত করে রেখেছিল...সেটা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন দিকে ছিটকে গেল আর ইসপ্যামার আলো গুলো সব যে জায়গায় যেমন ভাবে জ্বলছিল...তেমনি আবার আগের মত চতুর্দিক আলোকিত করে জ্বলে রইলো...প্যাম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসা অবস্থাতেই কাঁপা কাঁপা হাতটা নাড়াতেই বৃষ্টি পড়া ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। "প্লিজ প্লিজ হেল্প..." আলোহার ভীত সন্ত্রস্ত গলার আওয়াজ আগুনের বেড়াজালের ওপার থেকে ক্ষীন ভাবে ভেসে আসছিল... "স্রোত...স্রোত...স্রোত রে... প্যামের এফিনিটি ওয়াটার...আর সুজির ফায়ার...কি অদ্ভুত... ওঃ গডেস...অশেষ তোমার লীলা..." ডাইকোর গলায় কান্না সম্ভ্রম আর বিস্ময় মাখামাখি... " সুজান মেটা... আমি হাই প্রিস্টেস... আমি তোমাকে অর্ডার করছি...তোমার এলিমেন্ট কে কন্ট্রোল করে রিলিজ করো এক্ষুণি...আলোহা ভয় পেয়ে গেছে ভীষণ... সুজি ধীরে সুস্থে প্যামের কাছে এগিয়ে গেল...প্যামের হাত ধরে তুলে প্যামকে দাঁড় করালো...তারপর হাসিমুখে হাই প্রিস্টেস মিরান্ডা প্রিস্টলির দিকে ফিরলো... "সো স্যরি হাই প্রিস্টেস... কিন্তু...ওই যে... এক্ষুণি শিখলাম...ইসপ্যামার রুল...আপনিই তো শেখালেন...এখানে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না... এ্যান আই ফর এ্যান‌ আই...রাইট হাই প্রিস্টেস??" সবার বিস্মিত বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে প্যামের হাত ধরে, বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো না করে, আমাদের কাছে নেমে এল সুজি। তারপর পিছন দিকে না তাকিয়েই পোকা মাকড় তাড়ানোর মত অদ্ভুত এক হাতের ভঙ্গি করলো...
আমরা দেখলাম...ভয়ে মুখ ঢেকে কুঁকড়ে বসে থাকা আলোহা মুখার্জীর চারপাশে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা লেলিহান অগ্নিশিখার বলয় ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নিভে গেল... নিজের চিহ্নস্বরূপ...চারপাশে একটা কালো গোল দাগ রেখে শুধু।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register