শ্রিয়ার হাত ধরে খুব অন্যমনস্ক ভাবেই বাড়ির দিকে হাঁটছিলাম (মনে অশান্তি থাকলে যা হয় আর কি)...
তবে ঘোর অন্যমনস্কতার মধ্যেও একটা জিনিস খেয়াল করছিলাম....আজ কাকের উপস্থিতি বেজায় বেশি....
সন্ধের মুখে সব পাখি বাসায় ফিরবে,হইহল্লা করবে....এ তো খুবই স্বাভাবিক... কিন্তু আজ কাক গুলো খুব অদ্ভূত ভাবে নিঃশব্দে গোল হয়ে আমাদের মাথার উপর পাক খেতে খেতে উড়ে বেড়াচ্ছে....
শ্রিয়াও ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে আমাকে ডেকে দেখালো....
এইসব দেখতে দেখতেই দুপাশে ঘন হয়ে আসা ঝোপঝাড়ে ভরা সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটছিলাম....
হঠাৎ একটা অদ্ভুত একটানা করুন হুঁহুঁ আওয়াজ শুনে চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ভালো করে শোনার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলাম আওয়াজটা কান্নার এবং সেটা মহিলা কন্ঠের....
শ্রিয়ার হাত ধরে আওয়াজের উৎস খোঁজার চেষ্টায় এগিয়ে গেলাম....খুব বেশি চেষ্টা করতে হোলো না...কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেলাম....সরু , আগাছায় ভরা রাস্তাটার ডান ধারে বসে থাকা একটা সাদা পুঁটলির মতো বস্তু থেকেই এই অদ্ভুত কান্নার আওয়াজটা ভেসে আসছে....
কাছে এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম...সাদা থান পরা....দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকা কান্নার উৎসটা একটা মানুষ ই.....
"কি হয়েছে গো???কে তুমি?? এভাবে এই সময়...এখানে বসে বসে কাঁদছো কেন???"
আস্তে আস্তে তিননম্বর হাঁটু টা বাকি দুটো থেকে আলাদা হোলো....( হওয়ারই ছিল... কতক্ষন আর মাথা গুঁজে থাকা যায়...)
আর তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে অদ্ভুত কয়েকটা ছবি যেন মনের অতল থেকে বুড়বুড়ি কেটে ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল...
মামাবাড়ি ছেড়ে এসেছি বেশ কয়েকটা মাস... এরমধ্যে বাড়িটাকে সেভাবে মনেও পড়েনি.... সাম্প্রতিক কালের ঘটনার ঘনঘটার কারণেই হোক....অথবা সেই রকম মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি না থাকার কারনেই হোক.... কিন্তু এখন কেন যে হঠাৎ মামাবাড়ির সেই একফালি রঙচটা বসার ঘরটা.... সেখানে এককোনে রাখা আদ্যিকালের ভিডিওকন টেলিভিশন সেট টা....তার উপরে রাখা স্কুলে হাতের কাজে আমার তৈরী করা হরলিক্সের খালি বোতল দিয়ে বানানো ফুলদানি তে আমারই সাজানো কিছু নয়নতারা ফুল....আর টেলিভিশনের পিছনের দেওয়ালে ঝুলন্ত..... একপাশে লটকে থাকা শ্রীদুর্গা বস্ত্রালয়ের ক্যালেন্ডার টা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো..সেটা ভালো করে তলিয়ে বুঝে উঠবার আগেই আমার মন ঝাঁকুনি খেয়ে বর্তমানে ফিরে আসতে বাধ্য হোলো....কারণ তখন "হুঁহুঁ" কান্না টা " "হাউহাউ" কান্নাতে পরিণত হয়েছে...
ওর বয়েস ষাট থেকে আশির মধ্যে যেকোনো সংখ্যা হতে পারে....পরণের শাড়িটা কোনোকালে হয়তো সাদা রঙের ছিল....এত ময়লা যে সাদা না হলে বোধহয় দেখাও যেত না... কাঁচা পাকা শনের নুড়ি চুল.... এলোমেলো হয়ে.. অসংখ্য বলিরেখায় আচ্ছন্ন লোলচর্ম মুখের চারপাশে ঝুলছে....আর কালো অন্ধকারের মতো মুখ গহ্বর থেকে সেই তীব্র তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসছে....ওর দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন একটা ভয়....একটা কষ্ট মিশ্রিত অনুভূতি.....আর সব ছাপিয়ে একটা মায়া জন্ম নিল...আহা রে...
বাইরের রূপ দিয়ে কি হয়.... আমার বড়'জা কে তো সবাই অপূর্ব সুন্দরী, যৌবনবতী বলবে.... কিন্তু ভিতরে সে যে কি....সে যে কে....তা আমার থেকে বেশি আর কে জানে!!! .....
এই সন্ধের অন্ধকারে.... এই নির্জন পথের ধারে ....... এই বয়স্ক মানুষটি.. না জানি কত কষ্টেই এইরকম বুকফাটা কান্না কাঁদতে বাধ্য হচ্ছেন...সাময়িক ভাবে আমি আমার বিপদও ভূলে গেলাম...
"কি হয়েছে গো??? কান্না থামিয়ে বলো না...."
"আর কি বলবো রে মা.....যে মেয়েমানুষ নিজের বরকেই আস্ত গিলে খেয়ে বেধবা হয়....তার কি আর দুক্কের শেষ আছে রে....কেউ আমারে রাকে না.... আমি নাকি অপয়া...যেকানে যাই অশান্তি বাঁদাই...ওহুঁহুঁহুঁ....."
আমার খুব কষ্ট হোলো....আহা রে.... অসহায় বুড়োমানুষ টা.....
"আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে... এবার তুমি কান্না থামাও....আর একটু পরে রাত নামবে....তখন কোথায় থাকবে তুমি??? এই জঙ্গলের রাস্তা.... এখানে ভারী শিয়ালের উপদ্রব...ওঠো...আর বাড়ি যাও...."
উত্তরে তার কান্না দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল.....
" যাওয়ার জ্যাগা যেতি থাকতো রে মা...এখেনে কি বসে থাকতম....সোয়ামী পুত নিয়ে জ্বাজল্য সোমসার করিস... আমার মতন তো সব খোয়াসনি..."
বলতে বলতেই বৃদ্ধা সোজা এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো...
"হেই মা.....আমারে তোর সাথে নে চল মা... আমার কোতাও ঠাঁই নেই কো...সবাই তাড়ায়ে দেয় রে মা...নে চল্ মা...ভগমান তোর ভালো করবে..."
"আরে আরে করছো কি.... ছিঃ ছিঃ তুমি কতো বড়ো...পা ছাড়ো আমার.."
আমার খুব খারাপ লাগছিল...দুঃখও হচ্ছিল.... কিন্তু এটা কি করে সম্ভব... আমার নিজের অবস্থানই তো টালমাটাল.... শুধু তাই নয়....কখন এই বাড়ির কা'র উপর কি বিপদ ঘনিয়ে আসবে কেউ জানি না... সেখানে একে কেউ থাকতে দেবে কিনা তাই তো জানি না... আমার বাড়ি তো শুধুমাত্র নামেই... আমার কি কোনো অধিকার আছে সেখানে??.... কিন্তু এই ঘন সন্ধ্যার অন্ধকারে এই বয়স্ক অসহায় মানুষটাকে এভাবে ফেলে রেখে চলেই বা যাই কি করে...যদি একটা কিছু হয়ে যায়....হয়তো বাড়ি নিয়ে গিয়েও ওর খুব একটা উপকার করতে পারবো না... তবু কয়েকটা দিন যদি একটু ভালো করে খেতে দিতে পারি....
আমাকে চিন্তা করতে দেখেই সে আবার কেঁদে উঠলো
"নে চল মা...ঝ্যাতোটা পারবো কাজ করে দেবো...বসে বসে খাবুনি...."তোর বাড়ি তোর ঘর....
এক কোণে এই বেদ্ধ মানুষটারে এট্টু ঠাঁই দে মা..."
আমি কি করবো কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না....
এদিকে সন্ধের অন্ধকার রাতের দিকে ঢলতে শুরু করেছে..... আমাদের মাথার উপর একদল কাক অদ্ভুত নীরবে গোল গোল পাক্ খাচ্ছে...
সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়েই হঠাৎই কেমন যেন মনে একটা জোর.... একটা সাহস পেলাম... আচ্ছা..আমিই তো অর্কর আইনসিদ্ধ স্ত্রী.... আমি তো কখনোই কারো কাছে কিচ্ছু চাইনি...প্রাকৃত অতিপ্রাকৃত সব অত্যাচারই নীরবে সহ্য করে চলেছি আমার কি এটুকুও অধিকার নেই অত প্রাচুর্যে ভরা বাড়িতে....কয়েকটা দিনের জন্য এই অসহায় বৃদ্ধা কে ঠাঁই দিই...না হয় আমার খাবার থেকেই একটা অংশ দেবো....ও আর কতটুকুই বা খাবে.... তাছাড়া আরেকটা কথাও ভাবলাম.... এখনো পর্যন্ত আমার বাড়ির কান্ডকারখানা বাইরের কেউ বা স্থানীয় কেউ জানে না বা কল্পনাও করতে পারে না...যদি এ থাকে.. বলা তো যায়না...কে কিভাবে কখন সাহায্য করতে পারে...
এই সব ভাবতে ভাবতেই কেমন একটা জেদ চেপে গেল আর যেন মুখ ফস্কে বলে ফেললাম....
"ঠিক আছে..চলো তাহলে আমার সঙ্গে... কিন্তু জানিনা শেষ পর্যন্ত তোমাকে রাখতে পারবো কিনা..... আমার বাড়িতে অনেক ঝামেলা....তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে কিন্তু...."
বলার সাথে সাথেই যেন লাফিয়ে উঠলো সে
বাব্বাঃ!!! এত বয়স হলে কি হবে....ভালোই তো ফিট্..... আমি মনে মনে ভাবলাম....
" দাঁড়া রে মা... আমার ঝিনিস গুলান তাইলে নিয়ে নেই...."
এতক্ষণে খেয়াল হোলো....ওর পাশে একটা বেশ বড়ো পুঁটুলি রাখা আছে...আর তার ফাঁক দিয়ে একটা ঝাঁটার মতো কি যেন উঁকি মারছে.... আমি হেসে ফেললাম......
"এদিকে নাকি তোমার থাকার জায়গা নেই... এদিকে কতো বড়ো পোঁটলা...তার মধ্যে আবার ঝাঁটা না?? হ্যাঁ ঝাঁটাই তো মনে হচ্ছে..."
"কেনে রে বাপু?? গরীব বলে কি আমরা মনিষ্যি নই কো?? তোদের মতো আলমারি তে সোনাদানা না থাকতি পারে... থা বলি একটা পোঁটলা...এককানা ঝাঁটা...এট্টা কুলোও কি থাকতে পারবেনি??"
খ্যানখ্যানে কাংস্যনিন্দিত গলা বেজে উঠলো....
"বাব্বাঃ তুমি তো খুব ঝগড়া করতে পারো...তা তোমার নাম কি গো?".... শ্রিয়াকে আর তেনা কে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই আমি প্রশ্ন করলাম...."তা তোমার নাম টা কি গো??"
খ্যানখ্যানে আওয়াজ খানিক উদাস....
"আমাদের মত ছোটনোকদের কি আর নাম থাকে রে মা....এর মা...তার মা...তা আমার নাম 'এই বুড়ি'
নোকঝন তাই তো বলে দেকি..."
"বাবারেঃ.... তোমার যা মুখ...দেখছি.... আমি তোমার নাম দিলাম "মুখী"...." আমি হাসতে হাসতে বললাম....শ্রিয়াও হাত তালি দিয়ে হেসে উঠলো...মুখী মুখী বলে...." আর ততক্ষণে আমরা প্রায় বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে গেলাম....
আমি সাধারণ ঘরের সাধারণ পড়াশোনা শেখা মেয়ে....এত অলঙ্কার বা ভারী ভারী বর্ননা দেওয়া আমার সাধ্যে কুলোয়না... কিন্তু এটা বলা যেতে পারে...মুখীর সাথে দেখা হওয়া আর বাড়ি আসার এই সময় টুকুর মধ্যে আমি বিগত কয়েক দিন বা বলা যেতে পারে... কয়েকমাসের মধ্যে আমি দু'বার হাসলাম.... মাথায় ঝুলন্ত খাঁড়ার কথা মনে থাকা স্বত্ত্বেও....... কিন্তু অচিরেই আমার মুখের হাসি মুখীর দৌলতে গায়েব হয়ে যাবে....তা ভাবতে পারিনি
বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই....বিলেসীর বিদ্রূপ ভরা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম...."ওই এয়েচেন....রাত অবদি ঠাকুরের কাচে ন্যাকামি করে....."
পাশ থেকে বড়'জার গায়ে কাঁটা দেওয়া গলার খিলখিলিয়ে হাসি...."দ্যাক রে বিলেসী.... মন্দিরের নাম করে কোতায় যায়...কোন নাগরের থেকে কি খিদে মেটায়.....আরে!!!!! এই ছোট....তোর পিচনে সাদাপানা ওটা কি??? ওটা কে উঁকি মারচে রে??সর্ তো দেকি!!!"
ভয়ে ভয়ে বললাম...."ও মুখী....ওর কেউ নেই....তাই নিয়ে এলাম...ওকে একটু থাকতে দাও না...কাজ টাজ করবে...দুটো ভাত খাবে.."
আমার কথার শেষটুকু চাপা পড়ে গেল বিলেসীর লুটিয়ে পড়া হাসির তোড়ে..."
"ওমা লো.... আমি কোতায় যাবো লো....এই ঘাটের মড়া...সে নাকি আবার কাজ করবে...এ তো আজ মরে কি কাল মরে....."
বিলেসীর সাথে বড়'জাও সবে হাসি তে যোগ দিতে যাচ্ছিল... তার আগেই মুখীর সেই মুখীমার্কা খ্যানখ্যানে স্বর ওদের মিলিত হাসি কে ছাপিয়ে উঠলো....
"তবে রে কুটনি মাগী.... আমারে ঘাটের মড়া কওয়া....হতি পারি ঘাটের মড়া....তোর মতোন চোর নইকো...তোর যেতি এত হিম্মৎ থাকে...তবে তোর ঐ আঁচলার কোনে যে দুল দুটো ঝিলিক মারতেছে সেগুলো দেকা না... আম্মো দেকি...কে ঘাটের মড়া...আর কে চোরের মরণ..."
নিমেষে বড়'জার হাসি মুখ গম্ভীর হয়ে কুটিল আকার ধারণ করলো...."এই বুড়ি টা কি দুলের কতা কইচে রে বিলেসী...দেকি তো তোর আঁচলের কোন টা..."বলতে বলতেই বিলেসীর আঁচল টা হেঁচকা টান মেরে তার প্রান্তে বাঁধা দুল দুটো খুলে নিয়েছে বড়'জা....
"ওরে হারামজাদি....আজ দুকুরে আমার ঘরে পায়ে মালিশ করার নাম করে এই কম্মো করেছিস...তোর এত বড় সাহস... আমার জিনিস তুই চুরি করিস..."
বিলেসীও ধরা পড়ে গিয়ে ভয়েই হোক বা লজ্জায়ই হোক...বলে বসলো....
"আ আমি ভূল করে নিয়েচি...তাচাড়া তোমার সোনাদানা নিয়ে কি হবে.... তোমার তো অন্য জিনিসের নোভ...."
বড়'জা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বিলেসীর সাহস টা বোধহয় বিশ্বাস করতে পারলো না... তারপর এগিয়ে এসে বিলেসীর গালে এত জোরে এক চড় মারলো...যে বিলেসী ছিটকে পড়ে গিয়ে হাঁউমাঁউ করে চিৎকার করে উঠলো
আমি পুরো ঘটনাটার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেছিলাম..একটু সামলে নিয়ে মুখীর দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলাম....মুখী ওদের কান্ড দেখতে দেখতে নিঃশব্দ হাসিতে ভেঙে পড়েছে...ওর প্রায় দন্তবিহীন অন্ধকার মুখগহ্বরের মধ্যে দিয়ে সেই হাসি ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছে...
আমি তাকিয়ে আছি...বুঝেই মুখী নিমেষে...হাসি থামিয়ে বিষন্ন মুখ করে বললো....
"দেকেচিস মা... আমার কপালখান?? তোকে কইনি?? আমি যেকেনে যাই সেখেনে ঝগড়া বাঁদাই...
অশান্তি নাগাই....এদের একন চলবে রে মা...সওজে থামবেনে....চল মা বুড়ো মানুষটারে এট্টা ঘরের কোন দ্যাকায়ে দে.. মুক গুঁজে পড়ে থাকি..."
আমি কি করবো বুঝতে না পেরে... বড়'জা আর বিলেসীর তুমুল ঝগড়া দেখতে দেখতে মুখীকে আর শ্রিয়া কে নিয়ে আমার ঘরের দিকেই চললাম....
আর মনে মনে মামীর প্রায়ই বলা একটা কথা বললাম..."খাল কেটে কুমির আনা"......একে তো অশান্তির শেষ নেই....তার উপর আবার মুখী....
0 Comments.