Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

'কফি পাহাড়ের রাজা' সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব - ৩ ।। খন্ড - ১১)

maro news
'কফি পাহাড়ের রাজা' সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব - ৩ ।। খন্ড - ১১)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

১১)
সেই রাতে অনেকটা পান করে ফেলেছিল মুরুগান। বিদ্যাকে তাড়াতে হবে মাথা থেকে। সে কেন আবার এসেছে! বিদ্যার কাছে আমি ফিরে যাব না আর…কিছুতেই ফিরে যাব না! এই মাতাল অবস্থায় বিদ্যাকে ভোলার বদলে আরও বেশি করে মাথায় চেপে বসল সে। তার ঘরের জানলার সামনে তখন যেন পাহাড়ের ঢাল নেমে এসেছে। পেকে ওঠা কফি বীনসের ভারে গাছগুলো নুইয়ে পড়েছে তারই পায়ের ওপর। আজ এতদিন, এতগুলো দিন মুরুগান কীকরে ভুলে আছে তার কফি বাগানকে? বিদ্যাকে? নাহয় বাগানে মন দেয়নি কিছুদিন, নাহয় তার ওখানে ভালো লাগছিল না। বিদ্যার নজরদারিতে অসহ্য লাগছিল জীবনটা। কিন্তু এতদিনের একটা চ্যাপ্টার এককথায় খারিজ করে দিতে পারল ও? এতটাই কি স্বার্থপর আর উদাসীন মুরুগান? যখন বিদ্যার কাছে ছিল, বাগানে ছিল, তখন সেখান থেকে পালাতে মন চাইত। আর এখন এই জীবনে এসে, নতুন এক বাঁধনে বাঁধা পড়ার আশঙ্কায় আবার সেই পুরনোর দিকেই মন ছুটে চলে যেতে চাইছে! এ কী ভীষণ দ্বিচারিতা তার! যখন যেখানে থাকে, সেখানে মন বসে না। অজানার দিকে মন ছুটে চলতে চায়। আর সেখানে পৌঁছলে মন আবার সেই পুরনোকে ফিরে পেতে চায়—এই কি মানুষের চিরকালীন ধর্ম? মানুষ কি তার মন সঙ্গে নিয়ে যায় না? ফিরে আসে না? এই কি সকল মানুষেরই ধর্ম নাকি কেবল মুরুগানেরই?
টলমল পায়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এলো মুরুগান। বাইকে স্টার্ট দিল। কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। ফাঁকা রাস্তাঘাট পেড়িয়ে বড় রাস্তায় উঠে চলে এলো ও। একবার ভেবেছিল ওই বাড়িতে চলে যাবে। এই অবস্থাতেও নিজেকে সংবরণ করল ও। বড় রাস্তায় এসে একঝাঁক গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল মুরুগানের। দাঁড়িয়ে পড়ল একধারে। পাশের একটা পানের দোকান থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল কিনে ঘাড়ে মুখে দিল, বাকিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তারপর একটা পান খেল চিবিয়ে চিবিয়ে অনেকক্ষণ ধরে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে এখন ও। ধীরে ধীরে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলো। তারপর কুগানকে ফোন করল ও। এই সময়ে সাধারণত কুগানকে ও ফোন করে না। বিদ্যা যদি শুনে কিছু আঁচ করে ফেলে, সেই ভয়ে। কুগানের সঙ্গে ওর কথাবার্তা হয় দুপুরের দিকে। যখন বিদ্যা বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকে। এমন অসময়ে মুরুগানের ফোন পেয়ে কুগান কিঞ্চিৎ ভড়কে গেছিল। খুব সাবধানে ফিসফিস করে সাড়া দিল ও। মুরুগান কিছুই বলল না তেমন। জড়ানো গলায় বলল শুধু, ‘তোরা ভালো আছিস তো?’ কুগান উত্তরে কী যে বলল…শোনা হল না মুরুগানের। আচমকা ঘুম এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর চোখের পাতায়। কোনরকমে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল ও।
পরদিন দুপুরে কুগান রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল মুরুগানকে। যদিও মুরুগান ওর উদ্বেগ বা কথায় কোনরকম পাত্তা দিল না। একথা সেকথা বলে ফোন কেটে দিল। কেন জানি, এখান থেকেও ওর পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ওই মেয়েটা আর তার ছেলে—ওদের কদ্দিন চেনে ও? ওদের সঙ্গে এমনকি আর ঘনিষ্ঠতা হয়েছে? গৌতম মুরুগানকে এক মাস না দেখলে ভুলে যাবে। গৌতমীও তারও আগে ভুলবে। তাহলে অকারণ কেন এই উটকো ঝামেলায় ও জড়াবে? আর পালাবেই বা কেন? এই জায়গাটা বেশ শান্ত। ওর ভাল লাগে এখানে থাকতে। আর রোজ বিকেলে সেই ছেলেদের স্কুলে যাওয়া একটা নেশার মতো হয়ে আছে ওর কাছে। ওখানেও কোন বাঁধন নেই তার। সবটাই নিজের মর্জিমতো, নিজের ইচ্ছের, নিজের ভালোলাগার। শুধু ওই পরিবারকে এড়িয়ে থাকলেই হল। ওর এতখানি জড়িয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজের ওপরই খুব বিরক্ত হয়ে উঠল মুরুগান।
ঠিক এই সময়টায় বিদ্যাকে একেবারেই ঘাঁটায় না কুগান। ও এতদিনে এটুকু বুঝেছে বিদ্যা যখন অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে থাকে, হুঁ, হাঁ ছাড়া কোন কথা ওর মুখে শোনা যায় না আর কারুর চোখের দিকে তাকিয়ে যখন ও কথা বলে না, সেই সময়টা অতিরিক্ত ভয়ের সময়। এই সময় কুগান বিদ্যার ধারেকাছে যায় না খুব একটা প্রয়োজন না হলে। কুগান পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একবার ভাবছে, সেদিন রাত মুরুগানের ফোন এসেছিল, সেই থেকে কিছু আঁচ করেনি তো বিদ্যা? নাকি ওর নিজেরই কিছু দোষ হল? আপাতত রামলাল কোম্পানির সঙ্গে রফা হয়েছে। ওরা প্রাথমিক কিছু মাল নিয়েও গেছে। সাতদিনের মধ্যে টাকা এসে গেছে আমাদের অ্যাকাউন্টে। এই নিয়ে তো বিদ্যার মেজাজ খুশ্‌ থাকা উচিত। তাহলে কিসে এমন যে বিগড়ল তার মেজাজ… ভেবে কূল কিনারা পায় না কুগান। এরকম সময়েই আবার বিদ্যার ডাক পড়ল। এখুনি দেখা করতে বলেছে আবার ওকে! রীতিমতো গলা শুকিয়ে গেল কুগানের। কী যে সে করে ফেলেছে…কী যে কপালে নাচছে……একগ্লাস জল খেল ঢকঢক করে। বাবা বিশ্বনাথকে একবার স্মরণ করল মনে মনে। হে প্রভু রক্ষা কর এযাত্রা।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register