Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কবিতায় আকিব শিকদার

maro news
কবিতায় আকিব শিকদার

১। নির্যাতনের মতো স্নেহ

মায়ের কিছু আচরণ মারাত্মক পীড়া দিতো আমায়। আমি এর নাম রেখেছিলাম নির্যাতনের মতো স্নেহ।
ধরা যাক, বন্ধুবান্ধবে আড্ডা। ফোনে যন্ত্রণার ঝড় তুলে মা জানতে চায়- শরীরটা ভালো কি না? খেয়েছি কি না সসময়ে? বাড়িতে নিজ হাতে খাওয়াতো; আমার মোটেই লাগতো না ভালো। অনার্স পড়ুয়া ছেলে মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছে- কী লজ্জা! গোসলখানার দরজায় ঠক-ঠক। তোয়ালেতে সাবান মেখে উপস্থিত মা। পিঠে কালি-ময়লার চর, ঘষেমেজে তুলবে যখন, আমি সুরসুরি পেয়ে দলাই-মলাই। হঠাৎ যদি অসুখ বাঁধতো, যেমন সামান্য জ্বর, মা রাতজেগে ছেলের মাথায় ঢালতেন জল। ভেজা কাপড়ে জুড়াতেন কপালের উত্তাপ। তার চোখভরা অশ্রু দেখে রাগে তো আমার দাঁত কটমট।
কোথাও যাবার বেলায় মা উঠোন পেরিয়ে রাস্তা অব্দি আসতো। ক্ষণে ক্ষণে বলতো- ‘সাবধানে থাকিস’। আঁচলের গিঁট খুলে হাতে দিতো তুলে খুচরো পয়সা কিছু- পথে পড়বে প্রয়োজন। রিক্সাতে উঠে মায়ের উদ্বেগী মুখটায় তাকাতেই খুব কষ্টে জমতো কান্না চোখের কোণায়। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে চলে আসতাম।
তার এক বদভ্যাস, যাত্রাকালে স্রষ্টার নামে আমার কপালে দেবে অন্তত তিনটি ফুঁ... এতে নাকি বিপদের ছায়া কাটে, কুগ্রহের কালগ্রাস থেকে বাঁচবো আমি। ওসবে বিন্দুমাত্র ছিলো না বিশ্বাস, তবু একদিন বেজেউঠা ফোন রিসিভ করতেই শশ্বব্যস্ত মায়ের গলা- ‘রিক্সাটা থামা বাবা, তোর মাথায় তো ফুঁ দেওয়া হয়নি’। আবদার রাখতে প্রথম বাসটা মিস, দ্বিতীয়টায় চড়ে বসলাম। বাস ছুটছিল বাতাস কাটা বেগে; আচমকা কড়া ব্রেকের ঝাঁকুনিতে যাত্রিরা থতোমতো। বাইরে ভীর, শহরগামী প্রথম গাড়িটা পড়ে আছে ব্রিজের নিচে, আর প্রায় সব কয় যাত্রীই নিহত। আহা... এতোক্ষণে হয়ে যেতাম ওপারের বাসিন্দা।
মায়ের মৃত্যুর পর আজই প্রথম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি। এতোবার পিছু তাকালাম, মায়ের মুখটা দেখতে পেলাম না; বড়ো উদ্বিগ্ন চিন্তাশঙ্কুল সেই মুখ কোনদিন দেখা হবে না এই পৃথিবীতে। মা... মা গো... তোমার সন্তানের ওপর থেকে সকল বিপদের ছায়া, কুচক্রির কুনজর কি কেটে গেছে...! একটি বার কেনো আসো না তবে দিতে মঙ্গল ফুঁ...! কেন পিছু ডেকে বলো না- ‘এই নে খুচরো কয়টা টাকা, পথে কিছু কিনে খাস’।
 

২। ব্যর্থ ডুবুরী

চেয়েছিলাম একটি বেগুনী ফুল, তুমি এনে দিলে ঝুলবারান্দায় ঝুলিয়ে রাখার মতো দুটো অর্কিড-চারা নারকেলের খয়েরী মালায়। সকাল বিকাল আমি জল ঢালি খুব যতনে- আর তুমি অফিসে যাবার আগে একবার পাতায় পাতায় বুলিয়ে যাও হাত, ফিরে এসে আবার ধরো। যেন পিতা তার চঞ্চল কন্যার ববকাট চুলে স্নেহের আঙুল চালায়। যেদিন ফুটলো প্রথম ফুল তুমিই খুশি হলে সবচেয়ে বেশি। আমাকে একেবারে কোলবালিশের মতো আড়কোলে তোলে কপালে খেলে খপাৎ খপাৎ চুমু, আর বার বার তাকালে হালকা হাওয়ায় কাঁপা প্রজাপতির পাখার মতো ছিটছিট অর্কিড পাপড়িগুলোর দিকে।
আমি তো জানি কতো যে ভালো তুমি বাসো আমায়। তাই আমার একাকীত্ব কাটিয়ে দিতে দিলে উপহার খরগোশ একজোড়া, একটি ধবধবে সাদা অন্যটি সাদায় কালোয় মিশ্রিত যাদের লালন করি আমি আপন শিশুর মতো গালে গাল মিশিয়ে- যেন আমিই তাদের মা। মুখে তুলে দেই কতো চাকচাক করে কাটা গাজরের ফালি, বাধাকপির কচি সবুজ পাতা।
আমার কোন আবদার রাখোনি অপূর্ণ তুমি। আমিই কেবল পারিনি... মনে কি পড়ে... চেয়েছিলাম পদ্মার ইলিশ-সর্ষে ভাজি? তুমি আমাকেই নিয়ে গেলে পদ্মায় জোয়ারের বেলা জেলেদের নৌকায় উঠে নিজের হাতে ধরলে ইলিশ। যে ইলিশ ভেজেছি পহেলা বৈশাখে উত্তপ্ত উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে আর আঁচলে মুছেছি গলার ভাঁজে জমা রূপালি মালার মতো ঘাম। তখন তুমি কোমর জড়িয়ে ধরে কামড়ে দিলে কান, আর হাতের আঙুলে এক চিমটি সর্ষে ইলিশ মুখে নিয়ে বললে- ‘বড়ো মধুর হয়েছে আমার রাধুনীর রান্না।’-মনে কি পড়ে? মনে কি পড়ে? অথচ আমি বারোটি বছর ধরে তোমাকে প্রতিদান কিছু দেবো বলে কতো যে চাই- যেমন একটি সন্তান, তবু পারি না দিতে। হাজার হাজার মাইল সাঁতরে এসে আমি যেন অতলান্তিক সমুদ্রপুরী থেকে শূন্য হাতে উঠে আসা ব্যর্থ ডুবুরী কোন।
তুমি যখন আমাকে খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসো... ব্যর্থতার গ্লানী আর অপারগ অপরাধের ভার বুকে নিয়ে গলায় কলস বেধে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে আমার।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register