- 39
- 0

এবার আর কোন পুলিশ,দড়ি,গাড়ির টহল কিছু মানছেনা অস্থির মানুষ।মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে একটু ফাঁক তৈরি হলে কিন্তু কি আরামের বাতাস ভেসে আসছে সমুদ্রের থেকে। আবার ঘর্মাক্ত মানুশের ভিড়ে অসহ্য হয়ে উঠছে চারপাশ।
সামনের হাজার লোক রথ আসলেই দু হাত ওপরে তুলে গর্জন করে উঠছে। আমি লম্বায় খাটো মানুষ। কিছু দেখতে না পেয়ে, সিল্কের সাড়ির আঁচল ঘামে ভিজিয়ে , পায়ের ব্যথায় অস্থির তিতিবিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।
শেষে সামনে দাঁড়ানো একটা খাবার জলের বিশাল গাড়ির ওপরে উঠে পড়বার চেষ্টা করলাম। তার পাদানির কাছে অব্ধি উঠতে উঠতেই মানুষের একটা বিরাট ঢেউ দিকভ্রান্ত হয়ে আছড়ে পড়ল এদিকে।পিছনে গাড়ির লোহার ধারালো অংশ আর সামনে এই পিশে দেওয়া নিঃশ্বাসরোধকারী মানুষের প্রবাহ! পিছন থেকে শুনতে পাচ্ছি আমার মেয়ের আতঙ্কিত ডাক, সে আমার থেকে বেশ খানিক লম্বা, আরও লম্বা চওড়া তার বাবা আর ভাইয়ের মাঝখানে রেখেছি তাকে।দমবন্ধ হয়ে যাবে ভয়ে চোখ বুজেই অনুভব করলাম, “কই আমার গায়ে কোন ধাক্কা লাগছে না তো?”
চোখ খুলে দেখলাম নীল আর কাল চেক চেক ফুল হাতা শার্ট পড়া রোগা একটা হাত আমার চারপাশে বেড়া হয়ে আছে। আস্তে হাত রাখলাম। মনে হল বাঁকানো লোহার রড।চমকে পিছন ফিরে তাকালাম।গরিব চোখ মুখের অতি সাধারন ময়লা একটা ছোট ছেলে,বছর কুড়ি বাইশের মনে হয়।কিন্তু আশ্চর্য সম্ভ্রান্ত তার দৃষ্টি। বলল, “ঠিক আছেন তো ,মা?”
আমি,“হ্যাঁ বাবা,” বলে ঘাড় নাড়তেই,এগিয়ে ভিড়ে মিশে গেলো।
কর্তা , ছেলে মেয়ে তত ক্ষনে এসে পড়তে পেরেছে কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলছে, “ঠিক আছো ?ঠিক আছো ?”
বললাম, “ হ্যাঁ , জগন্নাথ সামলে দিয়েছেন ।”
এবারে সবাই পাশের ফুটপাথে উঠে পড়তে বলল আমায়। না হলে এত বেঁটে মানুষকে লোকে সামলায় কি করে ?
যারা আগে থেকে ফুটপাথ দখল করে আছে, তারা ছাড়বে কেন? তবু একটু একটু করে পা রাখবার চেষ্টা করলাম ভিড়ের ভিতর। মনে হচ্ছে ঘামে ভেজা মানুষের তালগোল পাকানো একটা পিণ্ড ভেদ করে ঢুকবার চেষ্টা করছি।নিজেও স্নান করে যাচ্ছি ঘামে।
এমন সময় সমুদ্রের চেয়েও বড় গর্জন সুরু হল মানুষের মধ্যে।এত কষ্টে পল অনুপল পেরিয়ে যার জন্যে বসে থাকা,ওই যে এসে পড়ল !
এগোতে সুরু করেছে কাঁচা হলুদ আর টুকটুকে লালের সাজে, মাথায় জোড়া শুক পাখি,শ্বেত অশ্বের সারিতে টানা , নন্দীঘোষ।
চার পাশের মানুষ উন্মাদ হয়ে গেছে।পাশে গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধ বেশ কিছু অতি দরিদ্র মহিলারা ছিলেন। সঙ্গে মাদুর বিছানার পুঁটলি। তারা নিজস্ব ভাষায় কি অদ্ভুত গান ধরেছেন, বুঝতে পারছিলাম , জগন্নাথ, সুভদ্রা এদেরকে ভারি আদর করছেন সেই গানের মধ্যে। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে পরম আত্মীয়কে দেখতে পেলেন অনেক দিন পর।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম , “এই তবে আমার ভারত বর্ষ?
এদের পয়সা নেই, সাজ নেই, ভাঙ্গা এনামেলের বাটি ঘটি, নোংরা কল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে রাস্তার জল হাতে, তবু কোন অভিযোগ নেই তো?
কি আদর করছে, কি আনন্দ করছে , শুধু একবার চোখের দেখায় এক ঝলক দেখতে পেয়ে নীলমাধবকে।”
ওপরে তাকালাম। অদ্ভুত আকাশ। পেঁজা তুলোর মত মেঘে ঢাকঅ,লালচে আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু কোন রোদের তাপ নেই, না হলে এই লক্ষ মানুষের মধ্যে বহু প্রান যেত।কিন্তু না, হাল্কা মেঘের ছাতা ধরে রেখেছে সূর্য নবকলেবরে নারায়ণকে দেখবে বলে।
জগন্নাথ, এরাই তোমার সত্যকার ভক্ত। এরা কিছু চায় না। শুধু তোমায় ভাল বেসে এক বার দেখতে চায়। এদের টানেই তুমি নেমে এসেছ এই রাস্তার ওপরে ।
পাশ থেকে ছেলে মেয়ে জিগেস করছে , “দেখতে পাচ্ছো তো , সামনের লোকের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছ তো?”
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ও মা, রথ তো আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে , নাকে বেসর, কত বাহারের সাজ, ওই তো পুরুষোত্তম।
আস্তে আস্তে ধোঁয়া হয়ে এলো চোখের সামনে ।ডাক্তারি মস্তিষ্ক বলল, ভেসোভেগাল অ্যাটাক হচ্ছে। দুপুরে ভাত খেয়েই সঙ্গে সঙ্গে একটার সময় বেরিয়ে এসেছি, এখন সাড়ে ছটা বাজে।এই সাঙ্ঘাতিক শারীরিক পরিশ্রম আর অনভ্যস্ত শ্রান্তিতে রক্তচাপ কমে গেছে। মস্তিষ্কে রক্ত কম হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে যাবার সম্ভাবনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাথা নিছু করে বসে পড়তে হবে যাতে মাথায় রক্ত চলাচল হতে পারে।
ছেলেকে ডেকে বললাম, আমার শরীর খারাপ লাগছে।চারপাশের ভিড়কে বললাম, “একটু ভিতর দিকে যেতে দিন শরীর খারাপ লাগছে।”
যারা এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ছিল না, দু মিনিট আগে, তারাই কি যত্নে বসার জায়গা করে দিল।আমি “জয় জগন্নাথ” উল্লাসের মধ্যে লুটীয়ে পড়লাম পুরীর রাজপথের ধুলোয়।
চারপাশের মানুষ কেউ দু হাত তুলে হরে কৃষ্ণ ধ্বনি দিচ্ছেন, কেউ হাসছে, কারো বা দু চোখে জলের ধারা, এমন কি আমার কর্তা, যিনি আমার মত ঠাকুর দেবতার হুজুগে মাতেন না, তাঁর ও দু চোখে জলের ধারা।
কেন?তা তিনি নিজে ও জানেন না।
এরি মধ্যে মানুষ টের পেয়েছেন, আমি লুটীয়ে পড়েছি।কি মায়া, কি সহমর্মিতায় এগিয়ে এল চারপাশের অজস্র হাত, নোংরা কিন্তু মমতায় ভর্তি প্লাস্টিকের দুই লিটার জলের বোতল চারপাশ থেকে ঢালা হচ্ছে মাথায়, তিন চার লিটার হবার পর হাত তুলে থামালাম। মাথায় এত জলে ভিজে চুলে সর্দিগর্মি হবার সম্ভাবনা। একটু উঠে বসে বললাম, “ঠিক আছি”।
সবাই বলল, “তবে জলঅ খাউ”।
খেলাম সেই জল। সবাই আশ্বস্ত হয়ে রথের দিকে মুখ ফেরাল। আমি ও উঠে দাঁড়ালাম তোমায় দেখবো বলে।
হে রাজাধিরাজ, আমার দু হাতের মধ্যে, ঠিক সামনেটিতে এসে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। সে যে কেমন অনুভূতি , বুকের মাঝে কি অকারন তোলপাড় , কেউ কি বলে বোঝাতে পারে?
টলমল করা হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, খানিক পরে এগিয়ে গেল রথ, মাসির বাড়ির দিকে।
উন্মাদ হয়ে জুতো খুলে ফেলে দৌড়েছিল মানুষ, রথের রশি খালি পায়ে টানতে হয় বলে। রাস্তা ফাঁকা হতে দেখি দু পাশে হাজার হাজার জুতোর স্তুপ। কত বাহারের, কত রকম দামের। যিনি সকল কাজের কাজি, তিনি জলদমন্দ্র রবে ডাক দিতেই পথের কাঁটা পায়ে দলে , সাগর গিরি লঙ্ঘি ছুটে এসেছে সব প্রান আকুল হয়ে।
রাস্তার মাঝখানে অজস্র মানুষ তখন বুকের ছেঁচড়ে দণ্ডি কেটে চলেছে,গড়াগড়ি দিছহে রথচক্রের দাগের অপর। তাতে দীন,দরিদ্র,মহাধনী, মুসল্মান, খ্রিস্টান,বিদেশি, নারী,পুরুষ,শিশু, সবাই আছে, সব্বাই।
আমি চুপ করে বসে আছি ফুটপাথের মাটিতে,নোংরা নর্দমার ধারটিতে।
ভাবছি, এই রকম জায়গায় বসতে পারি, তাই কি জানতাম?
কিন্তু, এ হবে না তাই বা কি করে হয়? এই যে রেশমের শাড়ির সারা আঁচলে বুকে পথের ধুলোকাদা,
“...উপুড় হয়ে পড়েছিলাম খোলা পথের উপর দিনদুপুরে করুণ কৌতুক
তোমরা সবাই হেসেছিলে ।এক মুহূর্ত তবু বুকের কাছে পেয়েছিলাম বুক।”
তুমি আসবে আর আমি বাইরের লোকের মত তোমায় হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা পেন্নাম ঠুকে চলে যাব, তাই হতে পারে?
আমার সমস্ত অন্তরাত্মা লুটিয়ে পড়বে না সাষ্টাঙ্গে তোমার আগমনপথের ধুলোয়?
সব উপাধি পদবি,অভিমান ছেড়ে জনগণেশের সঙ্গে ধুলোয় আসন পাতবো না ?
এই যে এখনও সমস্ত সত্তা জুড়ে আলোড়নে বুঝলাম, তুমি আমার পাশটিতে, চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে।আমার জন্যে। হ্যাঁ, আমার কাছে,আমার জন্যে ও---
“ আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে, তোমার সেথায় চরণ পড়ে ...”
0 Comments.