- 31
- 0
গাড়ি
যশোর রোডের পাশে একটা বড় ধাবা, তার গায়েই শো-রুমটা। পুরনো চার চাকার শো রুম। এক বন্ধু ঠিকানাটা দিয়েছিল সাগরকে। সে বন্ধু নিজেও এখান থেকেই ক মাস আগে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টয়োটা কিনেছে। দাম যা..তার তুলনায় গাড়ির হালহকিকত একেবারে নতুনের মতো, এতটাই তরতাজা সে গাড়ি। নিজের চোখে বন্ধু তন্ময়ের বাড়ি গিয়ে গাড়িটা দেখে আসার পর সাগরের মনে হলো ওর ভেতরকার অনেকদিনের ইচ্ছেটা যেন বলতে শুরু করেছে, ' এবার একটা গাড়ি তাকে কিনতেই হয়...এতবছর চাকরি করার পর আজ সঙ্গতি যেটুকু রয়েছে তাই দিয়েই ফার্স্ট হ্যান্ড না হোক এরকম একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি যদি কিনে ফেলা যায় ক্ষতি কি। বয়স তো থেমে থাকে না। সময়ও। এরপর একদিন হয়তো দেখা যাবে....।'
আর সেই ইচ্ছের ফলস্বরূপ ঠিকানাটা জেনে পরেরদিনই অফিস ফেরতা পাড়ার এক পরিচিত ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে শোরুমে এসে উপস্থিত হলো সাগর। এসে দেখলো, তন্ময়ের বর্ণনায় সত্যিই কোথাও ভুল নেই। শোরুম জুড়ে সাজানো অসংখ্য গাড়ির মেলা। দেখে বোঝার উপায় নেই ওগুলো সব ব্যবহার করা গাড়ি।
চোখদুটো হঠাৎই আটকে যায় সাগরের। অনেকগুলো ফোর হুইলারের মাঝে বেশ চকচকে নীল রঙের একটা বড়সড় গাড়ি যেন তার জন্যই সাজগোছ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে একেবারে সামনের সারিতে। এ যেন ঠিক তার মনের মতো সেই রঙ! প্রায় সেই একই রকম পছন্দের, কি তার চাইতেও কিছু বেশি! পেছনে কোম্পানির যে নামটা লেখা আছে, সেটা যে যেই সেই ব্র্যান্ড নয়, একটা নামি বিদেশি গাড়ি কোম্পানির ব্র্যান্ড নেম...' ভক্সওয়াগন ভেন্টো' এই নামটা কিছুদিন আগেই একবার ইন্টারনেট সার্চ করতে গিয়ে চোখে পড়েছিল সাগরের। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা এক্সাক্ট এই একই রঙের গাড়ি ছিল সেটা। কিন্তু এক ঝলক গাড়ির অন রোড প্রাইসটা দেখার পর সুপ্ত আগ্রহটুকু প্রদীপের শিখার মতো দপ করে নিভে যেতেও এক মুহূর্ত সময় লাগে নি তার।
ভেসে আসা সেদিনের নাম এবং ছবিটা যেন বিদ্যুতের ঝলকের মতো মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেল সাগরের। হঠাৎ করে কুড়িয়ে পাওয়া অমূল্য ধন মানুষ যেমন হারাতে চায় না কিছুতেই...ঠিক তেমনই ওটা দেখার পর দ্বিতীয় বার আর অন্য কোনো গাড়ির দিকে চোখই গেল না তার। পাশে দাঁড়ানো পরিচিত ড্রাইভার ছেলেটাও একবাক্যে বললো, 'এ গাড়ি অন্য গাড়িগুলোর মতো নয়। দু চারবছর চালিয়ে বিক্রি করে দিলেও দাম কমবে না একপয়সা। সবদিক যদি ঠিকঠাক থাকে, নিলে ভালো লাভ করবেন। আর একান্তই যদি না নিতে পারেন, আমার সন্ধানে আরও গাড়ি আছে, ঐ যে তখন বললাম...’
’অ্যাদ্দুর এলাম কেন তাহলে?’
সাগরের কথার ঝাঁঝে ছেলেটি থেমে গেল।
চার লাখ পঁয়ষট্টি রিসেল ভ্যালু। অনেক বলে কয়ে শেষমেশ সাড়ে চার লাখ...এর চেয়ে কম কিছুতেই করতে রাজি নয় দোকানদার। তার যুক্তি, দু হাজার পনেরো সালের গাড়ি...আগামী পাঁচ বছর ট্যাক্স ফ্রী, সাথে ইনশিওরেন্সও ফ্রী...শুধু ' নাম ট্রান্সফার বাবদ হাজার ষোলো সতেরো দিয়ে দিলেই ব্যাস...নিশ্চিন্ত মনে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুন.. পয়সাকড়ির দিক দিয়ে পাঁচ বছরের দায়ে আর কোনো টেনশন নেই...এত সুবিধা পাচ্ছেন, ভাবুন একবার!'
'সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমার চারের বেশি ওঠার ক্ষমতা নেই দাদা... তেমন হলে তো আর এক দুলাখ দিলে নতুন গাড়িই কিনতে পারতাম। দেখুন যদি কম করে হয়...আমার পক্ষে যা সম্ভব তা ই আপনাকে বললাম।'
'পারবো না দাদা। ইমপসিবল। একটা টেস্ট ড্রাইভ নিয়ে দেখুন,তাহলেই বুঝবেন অন্য গাড়ির সঙ্গে তফাৎটা কোথায়। এ যেই সেই ব্র্যান্ড নয়, জার্মান কোম্পানির প্রথম সারির ইমপোর্টেড ব্র্যান্ড...অডি গাড়ি এরাই তৈরি করে। পাঁচটা লোক দেখলে তাকিয়ে থাকবে আপনার গাড়ির দিকে। সচরাচর রাস্তাঘাটে কমই খুঁজে পাবেন এ জিনিস। যখন দু হাজার দশের ডিসেম্বরে ভারতে লঞ্চ করলো তখন তেরো লাখ নব্বই দাম ছিল। সেটা হিসেব করে এবার ভাবুন! আজ বাদে কালই হয়তো বেরিয়ে যাবে শোরুম থেকে...অনেক বছর পর পর এরকম একটা দুটো আসে। একবার বিক্রি হয়ে গেলে আর পাওয়া...কোনো গ্যারান্টি নেই। একটা বিয়ারিং শুধু ডিসটার্ব করছে...সে যদি নেন,আমি বদলে দেবো...এছাড়া গাড়ির কন্ডিশন...ঐ যে বললাম, একবার উঠলেই বুঝতে পারবেন...লুকিয়ে তো কোনো লাভ নেই।'
বেশ খানিকটা রাস্তা টেস্ট ড্রাইভ নেবার পর গাড়িটার মোহ কিছুতেই আর ছাড়তে পারলো না সাগর। ভেতরকার ডেকোরেশনটাও ভারি সুন্দর। কতখানি প্রশস্ত জায়গা! একই সিটে চারজনে ভালো ভাবেই চড়ে যাওয়া যায়।
'দেখে নিয়েছি দাদা। একদম গুড কন্ডিশনে আছে গাড়ি। শুধু ঐ বিয়ারিংটা চেঞ্জ করে নিলে আর এসি মেশিনে কিছুটা গ্যাস পুরে নিলেই আর কেউ বলবে না সেকেন্ড হ্যান্ড কার। আগে জানলে আমিই কিনে নিতাম ভাড়ার জন্য। এ গাড়ি সহজে কেউ ছাড়ে! ইশ!’
ড্রাইভার ছেলেটি শুধু যে ক্লিনচিট দিলো তাই নয়, একই সাথে বলা’ ইশ’ কথাটা একটা খটকাও যেন ধরিয়ে দিয়ে গেল সাগরের মনে। আজ যদি সে গাড়িটা না নিয়ে ফিরে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আর চারচাকা কেনার আশা করে লাভ নেই। কারন মনের সাথে সবদিক দিয়ে মিলে যাওয়া এমন একটা গাড়ি পয়সা দিয়ে ফাস্ট হ্যান্ড হিসেবে কেনার সাধ্য যেমন তার ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেকেন্ড হ্যান্ড শোরুমেও আদৌ আবার পাওয়া যাবে কিনা, তারও কোনো ঠিক নেই। মাঝখান থেকে কে বলতে পারে, পাড়ার ছেলে শানুই কোনদিন এসে ভাড়া খাটানোর নাম করে, চুপিচুপি গাড়িটা কিনে নেপোয় দই মেরে দিয়ে চলে যাবে। এতদিন তো ভাগ্য এইভাবেই পরিহাস করে এসেছে সাগরকে।
অনেক অনুরোধ উপরোধের পর চার লাখ পঁয়তাল্লিশে রফা করে, লাখ দুই ক্যাশ ডাউন দিয়ে, পাঁচ বছর মেয়াদে মাস প্রতি প্রায় সাত হাজার টাকা ই এম আই দেবার শর্তে রাজী হয়ে,ঘাড়ের ওপর এসে পড়া আরো কিছুটা বাড়তি অঙ্কের চাপের বোঝা মেনে নিয়ে, একই সাথে পরবর্তী কালে রিসেল ভ্যালুর কথা চিন্তা করে গাড়িটা কিনেই ফেললো সাগর।
'ঘন্টা দুই সময় দিন স্যার। তার মধ্যে বিয়ারিংটা চেঞ্জ হয়ে যাবে। এসি মেশিনটাও চেক করে নিচ্ছি। গাড়িটা ওয়াশ করে ডেলিভারি দিয়ে দেবো। লাস্ট ফিনিশিংটা একবার দেখবেন শুধু... এখন যা আছে, এর থেকেও এমন চকচকে করে দেবো, দেখে কেউ বলবে না... চালাতে পারেন তো? আমাদের এখানে ড্রাইভিং শেখানোরও ব্যাবস্থা আছে... চাইলে...।'
'না না, রিসেন্টলি আমি ড্রাইভিং শিখেছি। যদিও কলকাতার রাস্তায় এতখানি পথ ভরসা পাবো না বলে সাথে ওনাকে নিয়ে এসেছি...উনিই...।'
'ও আচ্ছা। এই কাগজগুলোতে একটু সই করতে হবে স্যার। আপনার বাড়ি কোথায়?'
'শ্যামনগর।'
'তাহলে তো অনেকটা দূর।'
'হ্যাঁ। সেটাই ভাবছি, যদি কখনো স্পেয়ার পার্টস কিছু খারাপ হয়...।'
'শুধু আমাকে একবার ফোন করে দেবেন ব্যাস। ঘন্টা কয়েকের মধ্যে সার্ভিস ম্যান পাঠিয়ে দেবো। পাবলিক গাড়ি কেনে। পরিষেবাটাও তো তাকে ঠিকঠাক দিতে হবে। পার্টিকে ভোগানোর মতো ব্যবসা আমরা করি না।’
গাড়িটাকে এরই মাঝে পাশের সার্ভিস রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে এক ঝলক শানুর দিকেও নজর চলে গেল সাগরের। বেচারি শানু। হয়তো ভেবেছিল...ভাবনাটা যদিও অমূলক নয়...বরং খুবই স্বাভাবিক। শানুর নিজের গাড়ির ব্যবসা আছে। ওর বাবা নেদো মল্লিক কনটাক্টরী করে এককালে বেশ কিছু টাকাপয়সা করেছিল। শেষের দিকে অবশ্য অনেক লস খেয়ে ব্যবসা পড়ে যায়। চিন্তায় হার্ট ফেল করে নেদো। একটা অ্যাম্বাস্যাডার ছিল ওর। যখন বাজার ছিল, তখন খুব গাড়িটা চড়ে ঘুরে বেড়াতো আর লোককে দেখাতো। নেদো মরে গেলে বাবার শখের কেনা অ্যাম্বাস্যাডারটা সাত তাড়াতাড়ি ভাড়ার কাজে লাগিয়ে দেয় ওর ছেলে । সেখান থেকেই শুরু। ব্যবসা বাড়তে বাড়তে মল্লিক বাড়ির সামনে এখন দুটো তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হামেশা। আরো গোটা দুয়েক গাড়ি আছে শানুর নিজের। সেগুলোকে দেখা যায় না। দূরে দূরে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া খাটে। ভাগ্য পাশে এসে না দাঁড়ালে গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে এত বড় ব্যবসা তৈরি করতে বড় একটা কাউকে দেখা যায় না।
...’দুটো গাড়ি আছে দাদা, আমার সন্ধানে... একজন বলছিল... এই বছর দুই আগের... ছোট গাড়ি, ফ্যামিলি কার হিসেবে আপনাদের পক্ষে ভালো... চালাবেন, একটু বেড়াবেন, এই তো... একবার দেখতে পারেন...’
আজকেই আসার পথে বলছিল শানু কথাগুলো।
’ঠিক আছে, দেখবো না হয়...তা হ্যাঁরে, আজকাল গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেছিস নাকি? ভালো, ভালো...’
’সেরকম কিছু না দাদা...পার্টি এসেছিল, যোগাযোগ হয়ে গেল, এই আর কি।’
যেতে যেতে শানুর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা বাঁকা হাসিটুকু চোখ এড়ায় নি সাগরের। পাড়ার অবিনাশ বসাক সেদিন বলছিলেন, ’ও ছেলে তলে তলে গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায় নেমেছে...মল্লিকদের বাড়ির সামনে এই সেদিনও একটা হুন্ডাই দাঁড়াতো, এখন আর দেখেন? কদিনের গাড়ি ওটা? চুপিচুপি হাওয়া করে দিয়েছে। শুনেছি নাকি বেচে দিয়েছে.... এসব খবর হাওয়ায় ওড়ে, বুঝলেন না? আরে না দাদা, পয়সার অভাব টভাব কিছু নয়... ওর আবার অভাব কিসের? অতগুলো গাড়ি, অত বড় বাড়ি, জমিজমা...দোতলার কনস্ট্রাকশনটা একবার দেখেছেন কি বানিয়েছে? একটু একটু করে মিস্তিরি লাগিয়ে কোথায় নিয়ে গেল! এত চালাক! পাছে লোকের চোখে পড়ে যায়! বড় রাস্তার মোড়ে নেদো মল্লিকের ঐ যে বিল্ডার্সের দোকানটা ছিল, ওখানে বিকেল, সন্ধে হলে শানুকে দেখতে পাবেন বসে থাকতে। গদিওয়ালা চেয়ার। কাঁচের দরজা। টিভি, এসি। নেদো মড়ার পর বন্ধই পড়েছিল দোকানটা। এখন কিরকম ভোল পালটে ফেলেছে দেখেছেন? নেদো মল্লিকের জমানা পেরিয়ে মল্লিক বিল্ডার্স এখন জমিব্যবসার অফিস। ভাবুন একবার, জমি নয়, জমিব্যবসা। গত কয়েক বছরে এলাকায় যেকটা জমি কেনাবেচা হয়েছে সব ঐ শানুর হাত ঘুরে।
’দালালি করে সে তো জানতাম। রমেন দত্তের ছোট নাতি, সে তো এখন পাড়ার আরএক মাতব্বর। বোলচাল পালটে গেছে। সানগ্লাস পরে বাইক চালিয়ে যেন উড়ে যায়! শানুর ল্যাঙ্গোট হয়ে পড়ে থাকতো। ওর ঐ অফিসের কাজ করে দিত বোধহয়। এখন দেখি নাড়া বেধেছে উড়ে আসা বাংলাদেশি, লোকটার নাম জানি না...বাড়ির সামনে বড় বড় তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়... দুর্গাপূজো, কালিপুজোয় পাড়া ঝেঁটিয়ে লোক খাওয়ালো, ফ্ল্যাট কিনে নীচে সব সারি সারি দোকানপাট রাতারাতি ভাড়া দিয়ে দিল...সাম্রাজ্য খুলে বসেছে আর কি! এখন তো ঐ দোকানগুলোর সামনে হামেশাই ঘুরঘুর করতে দেখি... ঠিকানা বদলেছে বোধহয়... নিশ্চই শানুর সঙ্গে কিছু হয়েছে! সেদিনও দেখি বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে লোকটার বাড়িতে ঢুকছে...’
’মাঝিবাবু বলেই সবাই ডাকে। টাইটেল। দুনম্বরি ব্যবসা আছে ঐ লোকের। জানি না কিসের ব্যবসা। অত খোঁজ রাখি না। তবে গাড়ির ব্যবসা নয়। নইলে শানুর কম্পিটিটার হয়ে কুনজরে পড়ে যেত। পার্টি লাগিয়ে দিত পেছনে। কারবার সব বাইরের...’
’তাই হবে। খোঁজ রাখো দেখছি কতকিছুর!’
’রাখতে হয় দাদা, না রাখলে...’
অবিনাশ বসাকের নীচু গলাটা আরও খানিকটা নীচু হয়ে আসে...’ বাজারের গমকলের মাধব দাস, সে তো দুবছর আগে মারা গেল, আর তারপর থেকেই ওর বৌটার সঙ্গে শানু বাবাজীর যত লটরপটর। রমেন দত্তের নাতি, সেও এক জম্মের খচ্চর। চুপিচুপি বাড়ি গিয়ে শানুর বৌয়ের কানে শোয়াবসার সব খবর পাচার করতো। সে কি আর চাপা থাকে? ঠিক গেল শানুর কানে। সেই যে গলাধাক্কা খেল রমেনের নাতি, তারপর থেকে আর ওমুখো...! দোলের দিন মদ্যপ অবস্থায় শানুর পকেট থেকে চল্লিশ হাজার টাকা হাতসাফাই করেছিল বাছাধন। আরও কত কি সরিয়েছে ঠিক আছে! চল্লিশ হাজারের ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছিল তাই...। ভাবুন একবার, পকেট ভরে তাড়া তাড়া বান্ডিল নিয়ে মদ খেতে ঢুকছে নেদো মল্লিকের ছেলে! যেই সেই না, চল্লিশ হাজার! এর পরেও বলবেন অভাব? টাকার কেসটা শোনেননি?’
’না এটা তো শুনিনি! তোমরা কত খোঁজ রাখো তাই দেখছি!’
’এই সব করে গাড়ি কিনে ফেললো রমেনের নাতি। একটা ছেলে কাজ করে না, কর্ম করে না...স্রেফ ল্যাজে ল্যাজে ঘুরে...! নিজের বাড়ির অর্ধেক জমিটা কেমন বিক্রিও করে দিল শানুর কাছে! সে খুব পিরিতের দিন ছিল কিনা! ভেবেছিলাম ঐ জমি আদৌ কখনো বেচতে পারবে? কাগজপত্র কিছুই তো ছিল না। স্রেফ একটা বায়নানামা করে রাতারাতি হাতবদল হয়ে গেল। শানুদের মতো লোকের কাছে এসব নস্যি। ও কি আর বাড়ি করতে বসে আছে? কদিন পর শুনবেন ঐ জমি আবার হাতবদল হয়ে গেছে। এখনো কিছু করে নি। বোধহয় দাম ওঠার ধান্দায় আছে। রমেন দত্তের নাতি আখেরটা সময়মতো গুছিয়ে নিল যা হোক। যেরকমভাবে শানু ডিভোর্স হয়ে যাওয়া ঐ কালো হাতির মতো বৌটাকে স্রেফ পয়সার লোভে বিয়ে করে এনে তার সাতদিন পর একটা আলিশান গাড়ি নিয়ে এলো বাড়িতে। তখন ওর নিজের কি ছিল? ব্যবসার সবে শুরু। বাপের অ্যাম্বাস্যাডার ভাড়া খাটাতো। খবর রটালো যৌতুক পেয়েছি। যৌতুক? শালা! গাড়ি হলেই সবাই বুঝি জাতে উঠে যায়! কে, কিভাবে উঠেছে সব জানি...’
পাড়ায় অবিনাশ বসাকের মতো আরও একদুজন আছে স্কূপ নিউজ সংগ্রহ করে বেড়ানো যাদের অন্যতম কাজ।
...’গাড়ি হলেই সবাই বুঝি ...’
কথাগুলো মিথ্যে নয় যদিও। তবু অবিনাশ দার সেদিনের একপেশে হাসির মধ্যে কোথাও একটা আজকের শানুর ছায়া যেন ভেসে উঠলো সাগরের চোখের সামনে। যে কিনা শুধু গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে আসে নি। আরও অনেক কিছুই খুঁজতে এসেছে। হয়তো অবিনাশ বসাকের মতোই সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেও এসেছে।
চতুর ব্যবসাদারেরা অনেকটা খবরের কাগজের মতো। অর্ধসত্যতা একসময় এদের রক্তে মিশে যায়। ঘুরপথে ছলনা করে হয়তো নিজেই গাড়ির মালিক সেজে টোপটা ফেলেছিল সাগরের দিকে। এখন এই নতুন ব্যবসার কথাটা ইচ্ছে করেই হয়তো খুলছে না, ’পাছে লোকের চোখে পড়ে যায়!’
নেদো মল্লিকের শখের অ্যাম্বাস্যাডার শানু মল্লিক যেদিন টেনে নিয়ে এলো ভাড়ার জগতে, সেদিন একটা সত্যতা লোকের চোখের ধরা পড়ে গিয়েছিল। পাশের বাড়ির রঞ্জন দা বলেছিলেন, ’ নেদোর ছেলে শানু...এ দেখি আর এক ব্যবসাদার।’
আর এক ব্যবসাদার থেকে চতুর ব্যবসাদার...রাস্তাটা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই ঘোরেল।
সার্ভিস রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাড়িটাকে। ফিটিংসের কাজ চলছে। লোহালক্কড়ের টুংটাং শব্দ। সামনে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছে শানু। নাকি গাড়িটাকে দেখছে? দেখতে দেখতে যদি শেষ মুহূর্তে কোথাও কোনো আনএক্সপেক্টেড খুঁত মিলে যায়? এখনো তো মেলে নি। বরং এখন যেটা চোখে ভাসছে, তাতে কে বলবে এ গাড়ি সেকেন্ড হ্যান্ড কার? একটা টুকরো দাগের চিহ্নমাত্র কোথাও...! যা দেখার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে সাগর। তার অনভিজ্ঞ দৃষ্টি যতদূর অবধি পৌঁছোয় না, সেগুলো সব শানু দেখে নিয়েছে। দেখতে দেখতে জ্বলজ্বল করে উঠেছে চোখদুটো ওর। সেই জ্বলজ্বলে চোখে যেন একটু আগের সেই বাঁকা হাসিরই আর এক প্রতিচ্ছবি, মনে হয়েছিল সাগরের।
...’...’আগে জানলে আমিই কিনে নিতাম...’
এই মুহূর্তে আরও একটা জিনিস মনে হলো ওর... গাড়ি কেনার আনন্দটুকু এতক্ষণে সে যেন পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারছে! এই উপলব্ধি ঠিক কতদূর বিস্তৃত, তা সে নিজেও জানে না। শুধু জানে, ’সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি সেকেন্ড হ্যান্ডের মতোই হয়’...একথা যারা বলে, সাগর নিশ্চিত, শানুর চোখের এক্সপ্রেশন সেই সব নিন্দুকদের অচিরেই ভুল প্রমাণ করতে সাহায্য করবে। কবে কে যেন বলেছিল,’ অভিজ্ঞ ডাক্তার আর অভিজ্ঞ ড্রাইভার...ওদের চোখ ছাড়া আমরা অন্ধ...’
সাধে কি আর বেছে বেছে শানুকে নিয়ে এসেছে সাগর? সে তুখোড় হোক আর চতুর হোক কিংবা ধুরন্ধর...বাকচাতুর্যে ভরা পৃথিবীতে আসল সত্যিটুকু ও ছাড়া এই মুহূর্তে আর বোধহয় কেউই বলার অপেক্ষা রাখে না!
সই করা হয়ে গিয়েছিল কাগজে। আর কিছুসময় পরেই চাবি সমেত গাড়িটা তার হাতে চলে আসবে। ভাবতেই কিরকম একটা রোমাঞ্চ খেলে গেল সাগরের। অপেক্ষা করে আর থেকে থেকে ঘড়ির দিকে তাকায় অধীর হয়ে। বিকেল গড়াচ্ছে। যশোর রোডের কানেক্টার রাস্তায় যানবাহনের ভীড় বাড়ছে ক্রমশ। সকাল থেকে আকাশে বেশ মেঘ ছিল। থেকে থেকে বৃষ্টিও হয়েছে কয়েক পশলা করে। চিন্তা বাড়ছিল। এখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। আগামীকাল নিম্নচাপের আগাম সঙ্কেত আছে একটা। সুতরাং ভরসা নেই তেমন। নিজে ভিজলে ক্ষতি নেই। গাড়ি ভিজলে সে বড় গায়ে লাগে! ভীড় হোক, তবু নিশ্চিন্ত। শানু অচেনা ড্রাইভার নয়।
'এলাচ দেওয়া স্পেশাল চা নিয়ে এসেছি স্যার আপনাদের জন্য। যশোর রোডের ঐ একটাই দোকান এরকম চা বানায়।'
'আর কতক্ষণ, মানে...।'
'ধরুন ঐ মেরেকেটে চল্লিশ মিনিট। একেবারে চাঙ্গা করে দেবো গাড়ি। আমাদের দোকানের রেপুটেশন অনেক দূর অবধি। আশা করি স্টক দেখে বুঝতেই পারছেন?’
শোরুমের মালিক হেসে বললো।
হাসলো সাগরও।
'আমার এক বন্ধু আপনার শোরুম থেকেই ক মাস আগে গাড়ি কিনে নিয়ে গেছে। নৈহাটিতে বাড়ি। টয়োটা কোয়ালিস। বলতে পারেন ওর কাছ থেকেই আমি সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার ব্যাপারে বাড়তি ইন্সপিরেশন পাই। ওরটাও বেশ ঝকঝকে গাড়ি। না দেখলে কেউ বুঝবে না সেকেন্ড হ্যান্ড...। ও ই আমায় এ দোকানের ঠিকানা দেয়..।'
বেশ সুন্দর চা। বড়সড় চুমুক দিয়ে কথাগুলো যেন বাড়তি উৎসাহের সঙ্গে বেরিয়ে এলো সাগরের।
'হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে...মাসখানেক আগে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। ওটাও গুড কন্ডিশনের টয়োটা ছিল। আমার এখানে খুব পুরনো ভার্সানের গাড়ি আপনি সচরাচর পাবেন না। তবে ও গাড়ি আর আপনার এ গাড়ি...হ্যাভক ডিফারেন্স! কলকাতার কটা সেকেন্ড হ্যান্ড শোরুম এমন গাড়ি রাখতে পারে কেউ যদি দেখাতে চায় আমায়, অনায়াসে বাজি ধরতে পারি।'
দামের অঙ্কটা যতই খানিকটা বড় হয়ে যাক, এই মূহুর্তে সেকথা ভেবে গাড়ি কেনার টাটকা উৎসাহটাকে নষ্ট করতে চায় না সাগর। মনেও আনতে চায় না। তাছাড়া সে তো চাইলেই অন্য গাড়ি পেতে পারতো আরো কত কম দামে। কিন্তু এই চাওয়াটাই তো জীবনের সবকিছু নয়। এর বাইরেও আর একটা জীবন আছে...যে চায় আরাম, পরিতৃপ্তি, শান্তি...সে কি শুধুই নিজের জন্য? না একেবারেই না....জীবনে এইটুকু না কে যদি সে মেনে নিতে না ই পারে টাকার হিসেব করতে গিয়ে ,তাহলে আর কিসের বেঁচে থাকা! ফাইনাল পেমেন্ট করার আগে স্ত্রী মাধবীকে হোয়াটস অ্যাপে গাড়িটার একটা ছবিও পাঠিয়ে দিয়েছে সাগর। ওর তো খুবই পছন্দ। সাথে সাথে ফোন। এটাই নিতে হবে।
'জানো, মায়েরও ছবিটা দেখে মনে মনে খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারছিলাম। আমায় জিগ্যেস করছিলেন, " কত দাম গাড়িটার৷ ওর যদি আয়ত্বের ভেতরে থাকে...দ্যাখো তবে বিবেচনা করে"
হ্যাঁগো, তোমার আয়ত্বের মধ্যে আছে তো?'
'চিন্তা কোরো না। আমি মনে মনে একটা হিসেব কষে নিয়েছি...।'
'বাবুন কী বলে?' পরক্ষনেই সাগরের মনে হয়েছিল, গাড়ি সম্পর্কে বা তার ভালো মন্দ বোঝার মতো বয়সে এখনো যে সত্যিই পৌঁছয় নি বাবুন। নিজের মনেই হেসে ওঠে সে।
'ছেলে তো এখনো কোচিং থেকে ফেরে নি। পরীক্ষা চলছে।'
ছেলেকে আন্টির কাছে পড়াতে নিয়ে যাওয়ায় বেচারি মাধবী আজ আসতে পারলো না। ওকে ফেলে এমন একটা সুন্দর জিনিস এভাবে একা কিনতে আসতে রাজী ছিল না সাগরও। মাধবীই জোর করে পাঠালো।
'দেখলেই যে কিনতে হবে তার কি মানে। তবে টাকাটা সাথে নিয়ে যাও। পছন্দ হলে জানিও।'
এখন সাগরের সত্যিই মনে হচ্ছে যদি সে আজকে না আসতো এখানে, হয়তো ঠকেই যেতে হত।
'তাহলে এটাই বুকিং করলাম...।'
সবারই যখন পছন্দ হয়ে গিয়েছে, তখন এবার আর কিছুতেই পিছিয়ে আসতে চায় না সাগর। জীবনে সময় যে বড় দামী! একবার চলে গেলে আর কি সে ফিরে আসে কখনো?
কমলা আকাশটার দিকে নির্নিমেশ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সাগর। কি যেন খুঁজে বেড়ায়। মনটাকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো, 'যে গাড়িটা পছন্দ করলাম...কলকাতারই বুঝি? নাকি অন্য কোনো জায়গা থেকে আনা?'
ভদ্রলোক কাগজপত্র লিখতে লিখতেই একটু হেসে বললেন,'না না, গাড়িটা কলকাতারই এক ভদ্রলোক আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন। বেহালা পশ্চিমের বাসিন্দা। নিজে একটা কলেজের প্রফেসার ছিলেন। কথায় কথায় আলাপ বেশ জমে উঠেছিল। বললেন, " দু হাজার পনেরো সালে গাড়িটা কিনেছিলাম, নিজেই পছন্দ করে। এখনো একেবারে নতুন বলতে গেলে। ছেলে বৌমার আবার শখ হয়েছে বাড়ির জন্য এবার একটা লেটেস্ট মডেলের সেভেন সিটার কিনবে। যাতে সবাই মিলে একসাথে বেরোনো যায়। ছেলের শখকে তো আর নিজের থেকে আলাদা করতে পারি না। তাই বিক্রি করে দেওয়াই স্থির করলাম..."
আমিও গাড়িটা পেয়ে লুফে নিলাম। এরকম ব্যবহার করা গুড কন্ডিশনের ইমপোর্টেড ব্র্যান্ড মার্কেটে খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব দুষ্কর...বুঝলেন না? পরে আরেকদিন এসেছিলেন ভদ্রলোক আমার দোকানে.. নাম পরিবর্তনের জন্য কিছু সইসাবুূূদ দরকার ছিল তাই...। গাড়িটা রাখা ছিল। বারবার দেখছিলেন।বললাম, "একবার চালিয়ে দেখবেন নাকি?"
গাড়িটার গায়ে একবার হাত রেখে কি বললেন জানেন? বললেন,"বাবা মায়ের জন্য কিনেছিলাম। শেষবয়সে ওঁদেরকে চড়িয়ে যে শান্তিটুকু পেয়েছি এরপর আর কি চাওয়ার থাকে। স্মৃতি একদিন ঝাপসা হয়ে আসে। মায়া বাড়িয়ে লাভ কি"
কথাগুলো বলতে বলতে কিরকম যেন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শোরুমের ভদ্রলোক।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন,' আজ বিশ বছর হতে চললো গাড়ির ব্যাবসা করে খাই। কত কাস্টমার এসেছে, গেছে...টাকা পয়সা থাকলেও ফেলে আসা পুরনো গাড়ির প্রতি এতটা আবেগ বোধহয় সবার থাকে না। তাই হয়তো সবার সঙ্গে এমনভাবে পরিচয়ও গড়ে ওঠে না।আপনাকেও কিন্তু আসতে হবে স্যার একবার....ঐ নাম চেঞ্জের জন্য পেপার্সে সই করতে...ওরা কাগজপত্র পাঠালেই আমি ফোন করে নেবো...।'
......'বাবা, বাবা...আমাকে একটা গাড়ি কিনে দেবে?'
'চোখদুটো ছলছল করছে এরকম...কি হয়েছে খোকা? কি রে বল কি হয়েছে?'
'সমীর মামারা ঐ যে নতুন গাড়িটা কিনেছে...আমি একটু উঠে বসেছিলাম তখন। শিখা মাসি আর মিলি মাসি এসে বললো," এখন নাম। আমরা গাড়ি করে বেড়াতে যাবো। বাবাকে বলতে পারিস না গাড়ি কিনে দিতে?'
'দুঃখ করিস না খোকা। আমরাও ঠিক একদিন একটা গাড়ি কিনবো। তুই একটু বড় হ।'
গাড়ি কেনার মতো সঙ্গতি সুশীল বাবুর ছিল না। তবু নিজের ছেলের মুখে ঐ কথাগুলো শুনে আর তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে সেদিন বুকটা ফেটে গিয়েছিল তাঁর।
সুশীল বাবু আজ আর ইহজগতে নেই। তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা দেবী ছেলেকে বলেন,, 'দুঃখ করিস না খোকা, কে বলেছে বাবা তোর পাশে পাশে নেই? ওঁর দুটো চোখই তো তুই।'
আজ এতবছর পর বাবার চোখ দিয়েই যেন দেখছিল সাগর। দেখছিল নিজের গাড়িটাকে। দেখতে দেখতে খুঁজছিল কিছু একটা। প্রায় শব্দহীন চলমানতার আড়ালে অন্তর্জগতে লুকোনো কোনো হৃৎপিণ্ড।
যশোর রোডের ক্রশিং ছাড়িয়ে হুস করে অন্য রাস্তায় মোড় নিল ভক্সওয়াগন ভেন্টো। অভিজ্ঞ ড্রাইভার শানু আড়চোখে পরখ করছিল গাড়ির মালিকের মুখটা...
লোকটা খুঁজতে এসেছিল, নাকি আসলে কিনতেই এসেছিল?
0 Comments.