দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২১২)

পর্ব – ২১২

এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো
চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার
রাত্রির মায়ের মতো: মানুষের বিহ্বল দেহের
সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়— মানুষের বিহ্বল আত্মাকে
লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে
তাকে আর শুধায় না— অতীতের শুধানো প্রশ্নের
উত্তর চায় না আর— শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন
অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ
বীতকাম হয় যাতে— এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়,
স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে
কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন
বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে— মানুষের রক্তাক্ত আত্মায়
সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের— মানুষের জীবন নির্মল।
খানিকটা কেঁদে শ‍্যামলী যখন একটু হালকা আর শান্ত বোধ করছে, তখন কে একজন নারী পিঠে হাত রাখল।
সময় এখনো শাদা জলের বদলে বোনভায়ের
নিয়ত বিপন্ন রক্ত রোজ
মানুষকে দিয়ে যায়;
ফসলের পরিবর্তে মানুষের শরীরে মানুষ
গোলাবাড়ি উঁচু ক’রে রেখে নিয়তির
অন্ধকারে অমানব;
তবুও গ্লানির মতো মানুষের মনের ভিতরে
এই সব জেগে থাকে ব’লে
শতকের আয়ু— আধো আয়ু— আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতাব্দীকে তা’রা
কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচন ক’রে
আশায় উজ্জ্বল রাখে; না হ’লে এ ছাড়া
কোথাও অন্য কোনো প্রীতি নেই।
কে তুমি? এত নরম করে মায়ের মতো স্পর্শ দিলে?
ওরে শ‍্যামলিমা, আমি রে, আমি। ওঠ্ ওঠ্ ধূলোয় বসে আছিস যে মা! কি হয়েছে তোর?
শ‍্যামলী ম্লান হাসে। কিছু তো হয় নি পিসি।
হ‍্যাঁ। আমায় বোকাটা পেয়ে বলছিস, কিছু হয় নি। আয় উঠে আয় বলছি। আমার ঘরে চ।
কেন পিসি? এই তো আমি বেশ আছি।
হ‍্যাঁ। খুব হয়েছে। বেশ যে আছিস, ভাল‌ই বুঝতে পারছি। চ বলছি। শিগগির চ। ধুলোর মধ‍্যে বসে বসে বলছে ভাল আছি।
কোথায় যাব পিসি?
শ‍্যামলীকে আদর করে জড়িয়ে ধরেন সবিতা। আমার ঘরে যাবি। ধুলোর মধ‍্যে বসে থাকার চাইতে তো সে ভাল!
তোমার ঘরে আর কে থাকে পিসি?
কে আর থাকবে? আমি একাই থাকি। ছোট্ট একটা বিছানা আছে। তাতে তুই আমি জড়িয়ে মড়িয়ে ঘুমোবো। শীতের রাতে ভাল‌ই হবে।
পিসি, একটা কথা..
কি, কি হল আবার? দেখে পা ফ‍্যাল।
পিসি বলছি কি, বাথরুম!
তা সত‍্যি বলছি, বাথরুম টুম নেই। একটুখানি আড়াল করা আছে। ওইখানেই কাজ সারা।
ম্লান মুখে শ‍্যামলী তাকায়, বাথরুম নেই না?
সবিতা তাকায় শ‍্যামলীর দিকে। বলে, ফুটপাতে যারা থাকে, তারা দরজা দেওয়া বাথরুমের কথা ভাবতে পারে না রে। তাদের ওসব ভাবতে নেই। আজ রাতের আর কতটুকু বাকি আছে শ‍্যামলিমা! কাল সকালে তোকে আবার আমি বাড়ি অবদি এগিয়ে দিয়ে আসব। ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করে ফেলেছিস বৈ ত নয়!
শ‍্যামলী থরথর করে কেঁপে উঠে বলল, না পিসি, মরে গেলেও ও বাড়ি আমি আর যাব না। দাঁতে দাঁত চেপে এখানেই থেকে যাব।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।