|| উল্কি আঁকা দিনগুলি || সাহিত্যিক ভজন দত্তের বই আলোচনায় চন্দন চৌধুরী

পাঠ প্রতিক্রিয়া : লিখেছেন চন্দন চৌধুরী

‘উল্কি আঁকা দিনগুলি’ / ভজন দত্ত, টেকটাচটক, কোলকাতা, জানুয়ারি, ২০২৪, মুদ্রিত মূল্য -১৮০/

আলোচনায় -চন্দন চৌধুরী

 

পুরাতন বর্ণ (অক্ষর) গেঁথে নতুন বর্ণ নতুন ভাবনার নবীন বরণ। কবি ভজনের
উল্কিআঁকা দিনগুলির পাতায় পাতায় তারই সোনালী স্বাক্ষর। কবিতা কখন ভালো হয়ে ওঠে,কখন আলো হয়ে ওঠে কখন’ই বা অন্তরের উৎসব হয়ে ওঠে – বলতে পারি না, তবে কোনো কবির প্রিয় পঙতিগুলি যখন আলতো ভাবে অন্তরের কোথাও কোথাও ছোঁয়া দিয়ে যায়- ভালোলাগার একটা নরম তুলি পালকের মতো যখন আরাম দিয়ে ছুঁয়ে যায় আত্মাকে তখনই সার্থক হয়ে ওঠে কবি পাঠকের পারস্পরিক অন্তরঙ্গতার কেমিস্ট্রি। এই আপাত অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো বলার সঙ্গত কারণ একটাই যে, বর্তমান কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতার অনেক পঙতি পাঠক হিসেবে আমাকে বার বার শিহরিত করে তুলছে – কোথাও যেন এক রোমাঞ্চকর কাঁপন ধরিয়ে দেয় অন্তরাত্মার শেকড়ে শেকড়ে। মনে হয়- এসবই তো আমার অনুভব, আমারই একান্ত উচ্চারণ যা পাঠক হিসেবে ফিরে পাচ্ছি প্রিয়জন কোনো কবির ভাবনা প্রকাশে।

‘কবিতা কেন ভালো লাগে’-তার ব্যাকরণ আমার আয়ত্বে নেই।তাই কতখানি ছন্দ, কতখানি মুক্ত, কতখানি আলঙ্কারিক কতটুকু তার পরিমিতি বোধ – আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারবো না। আমি যেটা পারবো সেটা হলো – কবির অনুভবগুলিকে , তার ভালোলাগার জগৎটাকে নিজের অনুভবের দোসর করে নিয়ে আত্মতৃপ্ত হতে । মিলিবে মেলাবে -র আনন্দে অন্তরাত্মাকে এক্সপ্লোর করতে।

অতি আধুনিক কবিতা মানে দুর্বোধ্য বা অবোধ্য বোধে মেধায় ও শব্দ চারনাতে কবিতাকে পুনর্জন্ম দেওয়া — এমন ধারণা থেকে আজকাল আধুনিকোত্তর ফর্মাটে কবিতা লেখা হচ্ছে অহরহ যা পাঠক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে । কবি ভজন এই কাব্যগ্রন্থে সে পথে এগিয়ে যাননি, যেতে চাননি-ও। বরং অতি চেনা সহজ শব্দে মুখরিত করেছেন তার কাব্যভুবন। সামগ্রিক ভাবে সব ভালোলাগার
উচ্চারণগুলির উল্লেখ এখানে স্থান সংকুলান সাপেক্ষে সম্ভব নয়, কিছু পঙতি তাই তুলে ধরলাম —পাঠকদের যা মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

(১) কবিতা ‘চতুর্ভুজ’ –

‘সব যতিচিহ্ন ছুঁড়ে ফেলে একটি চতুর্ভুজ আঁকি/ তারই এককোণে তুলসীতলাসহ মাকে রাখি ‘

(২) কবিতা ‘সম্পর্কের কুঁড়ি ‘-

‘কিছু সম্পর্ক পরিতৃপ্ত বৃক্ষের আগায় সূর্যের চুম্বন/ কিছু সম্পর্ক চোখের সাগরে লুকানো ঢেউয়ের মতন/ কিছু সম্পর্ক জানি না কীভাবে রয়ে যায় আজীবন ‘

(৩) কবিতা ‘পাঞ্চ লাইন নেই’ –

‘পৃথিবীতে মায়ের থেকে ভালো কবিতা আর কেউ লিখতে পারে না – – -’

(৪) কবিতা ‘অক্ষর আত্মা ‘-

‘অক্ষরের আত্মা ধরে টানি জল উঠে আসে,
অন্তরের আগুন নেভে না।’

(৫) কবিতা ‘অক্ষরবাসা’-

‘একদিন নিজেকেই যিশুর জায়গায় ক্রুশবিদ্ধ হতে দেখি – – -’

(৬) কবিতা ‘শূন্যের কবিতা ‘–

‘শূন্যের ভেতর ভালোবাসা ভরে ভরে শূন্য ভরাট করি- – -’

(৭) কবিতা ‘দুয়ারে গামছা ‘–

‘বৃষ্টিমাথায় কতদিন বাড়ি ফিরিনি
কতদিন ভেজা মাথার জন্য
দুয়ারে গামছা হাতে কেউ অপেক্ষা করেনি- – -’

(৮) কবিতা ‘একটি দুটি আঁক কাটা হলে কাঁদি’-

‘ একেকদিন একটি- দুটি আঁক কাটা হলে কাঁদি
মরুভূমি জীবনের হৃদয়ে এত জল ছিল বুঝিনি!’—

না, এখানেই এবার থামবো যদিও আরো অসংখ্য এমন স্মরণীয় পঙতি বলুন পঙতি, উচ্চারণ বলুন উচ্চারণ – ঘন হয়ে ছেয়ে আছে অনেক কবিতাশরীরের আশ্চর্য চিহ্ন হয়ে।

কবিতার ভেতরে কবির কথা প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকট আকার নিয়ে বসবাস করে।
কবিভাবনার ভুবনডাঙ্গায় কবি কখনো নিঃসঙ্গ যাপনের জন্য, কখনো ব্যক্তি অনুভবী সত্ত্বায় হয়ে ওঠেন স্বয়ম্ভু, কখনো নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় অবলোকন করতে থাকেন পৃথিবীর চলমান সময়ের অন্যায়, নিপীড়নের উল্লাসধ্বনি মদমত্ততা- আবার কখনো অতি ব্যক্তিগত অনুভবের গভীরে তার নিজস্ব দুঃখ,ভালোলাগা, মন্দলাগা গুলির সাথে বিশ্বজনীনতাকে মিলিয়ে নিয়ে উত্তরিত হতে চান মহোত্তর মহোৎসবে। বর্তমান কবিতার মধ্যে এরকম অনুভব, উপলব্ধির প্রাঞ্জল উপাদান গুলি বিন্যস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কবির রাগে বীতরাগে,দ্রোহে দ্রোহহীনতায় আবার কখনো দ্রব হয়েছে তার সমাজসচেতন মানসিকতা, গাঢ় হয়ে উঠেছে কাব্যিক নিবেদন। আসুন, একটু পর্যালোচনাতে পর্যটন করা যাক —

(১) নিঃসঙ্গতা
——————
কবিতা -’তেমন পৃথিবী কই ‘

শব্দের ভোজবাড়ি থেকে দূরে কোথাও চলে যাই।
ভাবি, এই বেশ। শান্তি!
এই বেশ তুই-হীন, তুহিন সফেদ!’
*লক্ষণীয় কবি এখানে কি অপূর্ব ভাবে তার নিঃসঙ্গতাকে প্রকাশ করেছেন ‘তুই-হীন’ শব্দ ব্যঞ্জনায়।

(২)ব্যক্তি অনুভব
———————
কবিতা -’ট্যুরের ভেতরে ট্যুর

একটা ট্যুরের ভেতর তার ভেতরে ঘুরে আসি যদি
সুদূর নরম বুকের ভেতর পাহাড়ি এক নদী
বইছে যেমন হাওয়ার ভেতর হাওয়া, মা জীবনতরী

*মা জীবনতরী – উপলব্ধির বোধে অপূর্ব এক অনুভবের তীক্ষ্ণ ঋজু উচ্চারণ

(৩) নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা

কবিতা -’খোলা আকাশ ‘

খুলতে থাকো। খোলা বন্ধ করো না।ডিপ ডিপ্রেশনে জড়িয়ে ধরো। ছেড়ো না।
কানের কাছে ঠোঁট এনেও লতিতে চুমু না।

*এক নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নোত্তর যেন কবিকে আত্মদ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত করে রাখে যেখানে শারীরবৃত্তীয় প্রভাব লতিতে চুমুর দংশন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেয়।একে হতাশা বলা চলে না বরং কবির অন্যরকম ধ্রূপদী নির্বিকল্প ভাবটিকেই জোরালো করে।

(৪) সামাজিক দীর্ণতা, ভাঙচুর
——————————–

কবিতা -’মানুষ ভেবে জাগি’

হায়রে মানবজনম! ঘাতকের প্রবঞ্চনা না বুঝে
আস্তিনে লুকিয়ে রাখা সুখের অহংকারে ভাসে!
মানবতা আজ পদে পদে মায়াকুহকে মজে।’

*সরাসরি কবির আক্ষেপ – মানবতা আজ মায়াকুহকে ‘- এখানে সমাজের দীর্ণ ভাঙচুর সাংঘাতিক ভাবে আলোড়িত করে পাঠকদের। কবি ভাবনা সংক্রমিত হয় এভাবেই।

(৫)দ্রোহ
————

কবিতা-’বাস্তুতন্ত্র’

মাটিতে পা রাখলেই যদি মাটির মানুষ হওয়া যেত তবে পৃথিবীটাও যথাযথ
বাসযোগ্য বাস্তু হয়ে উঠত।
আগাছা নির্মূল না হোক, আগামী বর্ষাতক্ক ওদের বাড়বাড়ন্ত থামানোর পারিবারিক পরিকল্পনায়
দা, কাটারি উঠে আসুক হাতে।’

*কবির এই দ্রোহ কঠিন প্রতিবাদে হয়তো মুখর নয়, তবু ভেতরের সার্বিক ঘৃণা অদ্ভুত ভাবে মোচড় দেয় আমাদের বুকে –
গাছেদের ভিটেয় ঘুঘু চরানোর শত্রুদের প্রতি কবির দ্রোহের আগুন এভাবেই চারিয়ে যায় প্রথমে ধিকি ধিকি পরে ধূ ধূ।

কবিতার ফর্ম ফর্মাটে সে রকম কাটাছেঁড়া নেই। তবে শব্দ ব্যবহারের প্রায়োগিক প্রায়োরিটি বেস ব্যবহার আমাদের অভিনব কৌশলে নিয়ে যায় ভাবনা বিস্তারিত অকুস্থলে।দুটি বিষয় চোখে পড়ার মতো।
(১) সমাসবদ্ধ শব্দমিলনের উচ্ছ্বাসের মতো কবি পর পর দুই বা ততোধিক শব্দকে একেবারে এক রৈখিকভাবে অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট বেসিসে ব্যবহার করেছেন এখানে প্রকাশিত বহু কবিতায়।ব্যক্তিগত ভাবে এই শব্দমিলনের খেলাটি বেশ উপভোগ্য। কবিতা শরীরে যেন বাজারে আসা নতুন অলঙ্কার এগুলি। দেখা যাক – বিষয়টা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে —
(১) কবিতার নাম -’র’
শব্দসমষ্টি— রমনক্লান্তধরণী ( রমনক্লান্ত-ধরণী)
(২) কবিতার নাম -’দুয়ারে গোবিন্দগোঁজ’
শব্দসমষ্টি–কুটকুটুনিসিদ্ধ (কুটকুটুনি -সিদ্ধ)

(৩) কবিতার নাম -মনোগন্ধা

শব্দসমষ্টি- ধুধুগন্ধগুনগুননাম ( ধু- ধু -গন্ধগুন -গুননাম)

(৪) কবিতার নাম -পানকৌড়ি
শব্দসমষ্টি- সকালদুপুররাত ( সকাল -দুপুর-রাত)

(৫) কবিতার নাম -বৃষ্টিস্মৃতিনদী
শব্দসমষ্টি-বৃষ্টিস্মৃতিনদী (বৃষ্টি -স্মৃতি-নদী)

(৬) কবিতার নাম -মঞ্চসভ্যতা থেকে দূরে
শব্দসমষ্টি- উলঙ্গঅক্ষরদর্শন

খুঁজে দেখলে এরকম আরো ব্যবহার চোখে পড়ে যায়।ব্যবহারটি অভিনব।
না সমাসবদ্ধ, না সন্ধিবদ্ধ অথচ শব্দাবলীর পারস্পরিক সহাবস্থান কবিতার ভাবে এক অসাধারণ sound effect তৈরি করে।

দ্বিতীয় বিষয়টি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কবিতার মধ্যে অসংখ্য বিজাতীয়, দেশীয়, তৎসম,তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি অনায়াসে একেবারে দেশজ অন্ত্যজ গেঁয়ো আটপৌরে শব্দ মিশেল করে দেওয়া। অবশ্যই কবিতার ভাবকে সংরক্ষণ করে।
দু’একটা উদ্ধার করি, আসুন –

**কবিতা -অক্ষরের দুঃখ
শব্দ– দুক্ষু

**কবিতা -সব রবীন্দ্রনাথ
শব্দ – আছুলা

**কবিতা -আধার
শব্দ – বাইদ,শোল,কানালি

**কবিতা -কবিতার জন্য
শব্দ – ঠুসে ঠুসে।

**কবিতা – বিপত্তারিনি(নী)
শব্দ – উলুকঝুলুক

**কবিতা -প্রেক্ষাপট
শব্দ – লৈতন

**কবিতা -সময়-ময়
শব্দ – পেঁদাকথা

এরকম আটপৌরে তথাকথিত ব্রাত্য শব্দ গুলিকে কবি ভজন অনায়াসে ব্যবহার করেছেন সুভদ্র সুজন শীলিত জাতীয় বিজাতীয় শব্দ ব্যবহারের সাথে। কবিকে কুর্নিশ।

শব্দের কথা প্রসঙ্গে আরো দুটো কথা বলেনি, পরে আবার ভুলে যেতে পারি।
কবি ভজন প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করেছেন কবিতায়। সেটা দোষের নয়। কিন্তু অভিনবত্বের স্বাদ পাই যখন দেখি যে কবি নাউন অ্যাডজেকটিভ (এপিথেট) টানাপোড়েনে বিশুদ্ধ বঙ্গজ শব্দের সাথে বিশুদ্ধ ইংরেজি শব্দের পাশাপাশি ব্যবহারকে অসাধারণ ভাষ্য দান করে কবিতা পঙতির রহস্য বাড়িয়ে তুলেছেন।
এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। দেবো না। ভারি হয়ে যাবে। নমুনা দু’চারটে দেওয়া যেতেই পারে –

লাইক(Like)পূর্ব মধ্য দুপুর, স্মৃতিভল্টে(volt), প্লাস্টিক (plastic ) সভ্যতা, আনসোশ্যাল(unsocial ) শব, নোট (Note) বৃষ্টি, নেট (Net) জীবন, পবিত্র ড্যাশ (Dash) -এরকম।
আবার শুদ্ধ বাংলা শব্দকে সংস্কৃত শব্দের পাশাপাশি রেখেও এরকম experiment করার বিষয়টি আমাদের চোখ এড়াই নি -যেমন
বেহায়া অহম্ ।

এ তো গেল কবির অন্যরকম কীর্তির কথা।
এছাড়াও রয়েছে পঙতি পঙতি উচ্চারণ ঘিরে মায়াময় শব্দের অভিনব অনুভবী উপস্থিতি যা কবিতার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে রাখে অনির্বচনীয় ঘোরের আবেগে।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক —
চুমুকথা, অক্ষরব্যঞ্জন, কলঙ্কতিলক, দ্রোহনন্দিনী, নুননুনরাত, জল ছুঁইছুঁই রুখুডির ক্ষেত, অলৌকিক সুড়সুড়ি, অমোচনীয় স্বাক্ষর, শারীরিক স্বাক্ষরতার শংসাপত্র । না, এগুলোকে আমার কখনোই শুধুমাত্র অক্ষর বা শব্দ বলে মনে হয়নি,বরং বারবার একথাই বলবো যে শব্দের ব্যঞ্জনা মনের গভীরে আশ্রয় নিয়ে কবি-পাঠকের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কসেতু, সে সেতুর নীচে ভাসমান অনুভব নদীর স্রোতে ভাসছে কখনো wings of imagination, flight of fantasy, core of pensiveness, কখনো Designing of hard reality এভাবে শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ধ্বনিজাত অভিব্যক্তি দিয়ে শৈল্পিক ব্যবহার বৌদ্ধিক পাঠকমননে নানা অভিধা তৈরি করে – তখন কবিতা আর শুধু মাত্র কবিতা থাকে না, প্রসঙ্গসময়কে উপেক্ষা করে কালোত্তীর্ণ কাব্যের পান্ডুলিপিকে কালের ইতিহাস করে তোলে। এ’কটি কথা শুধু বলার জন্য বলা নয়- নিছক তারিফ করার জন্য নয়- পাঠক হিসেবে এ আমার গভীর বিশ্বাসের ভিত্তিমূল মাত্র।

কবিতা কালে কালে যুগে যুগে রচিত হয়েছে, হচ্ছে -হবেও। যে কোনো সৃষ্টির
মূলে Art for Art’s sake বা Art for reality — এ প্রতর্ক থেকে দূরে থেকে একথা বলা যায় –যে কোনো সৃষ্টি বা performing Art এর ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী রূপে আসবে দুঃখ যন্ত্রনা মানসিক টানাপোড়েন মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রতিবাদ প্রেম সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। কখনো খুব সরাসরি কখনো খুব সাংকেতিক রূপরেখার ওপর নির্মিত বিনির্মিত হবে কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি।সময় বলবে – সৃষ্টি কতোটা সময়কে অতিক্রম করে আধুনিক হয়ে সমকালীন যুগ মানুষ ও তার কৃষ্টিকে পুষ্ট করতে পেরেছে। কবি ভজন টুকরো টুকরো ছবি, কুড়িয়ে নেওয়া শব্দ ভাষা দিয়েই সাজিয়েছে তার সৃষ্টিসম্ভার। আরোপিত না হওয়ার ভাবনামাটিতে নির্মিত হয়েছে তার অটুট নির্মাণ। আলটিমেটলি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজের প্রতি ভালোবাসা,ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তার ব্যর্থতা, সার্থকতা, তার ভালোলাগার উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে প্রতিটি দিন যেন উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে যাপনের শরীরে এঁকে দিয়েছে সোহাগের উল্কি। উল্কিআঁকা দিন গুলো আসলে স্মৃতিনির্ভর ঘটনা অঘটনা, টুকরো টুকরো পাওয়া না-পাওয়াগুলোর এক বিরাটাকায় খোলামেলা ময়দান, যেখান থেকে আমরা পাঠক হিসেবে দেখতে পাই ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম এর বিশ্বদর্শনদৃশ্য।

##

কবি ভজনের -শব্দের প্রতি দুর্বলতা রেখে ও ‘পঙতি – কলসে’ অনুভব জল টলটল করেছে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। ‘চুম্বন’ বা চুমু বা চুমা সেভাবেই এক্সপ্রেস করি না কেন – চুম্বন এখানে বার বার ফিরে এসেছে ভিন্ন গরিমা ও ক্যারিস্মায়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো — কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ও এই চুম্বন শব্দের প্রতি বহু কবিতাতে তার দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন বারবার। তাঁর ‘চুম্বন’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এইভাবে –
‘অধরের কাছে যেন অধরের ভাষা
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে-’
কবি ভজন লিখলেন –
‘ঐ চঞ্চু ঐ চুমু জানে
হন্য-বন্য হওয়ার মানে –’ ( কবিতা – ড্যাস)

আবার অন্যত্র লিখলেন —
‘একটিও নির্মল ঠোঁট নেই
যেখানে একটি শুদ্ধ চুম্বন রাখা যায়’ ( কবিতা – নগ্ন নির্জনে)

তার ‘শান্তিছবি’ কবিতাতে চুম্বন এলো অন্য ব্যত্যয় নিয়ে -’এই নষ্ট পৃথিবীতে নিখাদ ফেলে দেওয়া চুমুগুলো/ জমিয়ে জমিয়ে পাহাড় করবে কেউ একদিন।’
কবি ভজন এরপর এই চুম্বন ও চুমুকে নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের প্রায় ঊনিশটি কবিতা লিখলেন যেখানে চুম্বন এক আশ্চর্য মহিমান্বিত ভাবনা নিয়ে উপস্থাপিত।ড্যাস, এক্স ফ্যাক্টর, প্রশ্নবোধক চিহ্ন, সম্পর্কের কুঁড়ি, পালকের লক খুলে, ভার্চুয়াল ভাইরাস, শান্তিছবি, গোপনচিঠি, পাঞ্চলাইন নেই, কবিতার জন্য, সঠিক, লেখা কীর্তন, ফেবুলাইভ, খোলা আকাশ, পানকৌড়ি, প্রতিটি অক্ষরে চুম্বন আঁকি, সমুদ্র ও হস্তশিল্প, অঙ্কন ও আস্বাদন – প্রায় উনিশটি কবিতাতে অনায়াসে কবি চুম্বন শব্দ প্রয়োগের এক অসাধারণ বহুমাত্রিক খেলায় মাতলেন। ঠিক একই ভাবে তার প্রিয় শব্দ- অক্ষর।এই অক্ষর শব্দের নানা ব্যঞ্জনায় অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায়। অক্ষর আত্মা, স্বপ্নাদ্য অক্ষর, অক্ষরের দুঃখ, সাদা পৃষ্ঠা ও অক্ষরফুল, প্রিয় গাছটিকে, সুবাস , অক্ষরবাসা, শান্তির অক্ষর, মঞ্চসভ্যতা থেকে দূরে, একটি গনতান্ত্রিক কবিতা, আয় পড়ে যা, খেলা, তেমন পৃথিবী কই, দগ্ধ তিলক -প্রায় ১৪ টি কবিতার পঙতি ঘিরে অক্ষর বিষয়ক কবির ভাবনার স্তরীভূত প্রভায় প্রভাবিত হই আমরা। এখানে অক্ষর শুধু কালো অক্ষরের প্রকাশ মাত্র মৃতলিপি নয়- জীবন্ত স্বাক্ষর। এছাড়া বার বার ব্যবহৃত হয়েছে ‘অন্ধকার’, ‘ইনবক্স’, ’ড্যাস’, ’সঙ্গম’ ও ‘চ্যাটমোড’– শব্দগুলি। হয়তো কবি পুরো ব্যাপারটা তার চেতনার অজান্তেই করেছেন কিংবা সজ্ঞানে। এতে কবিতার ভাব কোথাও দেউলিয়া হয়ে যায়নি বরং অন্যমাত্রায় বিরাজ করেছে

কবি নিজেই কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘খেলা’তে লিখেছেন – সাদা খাতার ভেতর এলোমেলো বর্ণ ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি’
বাস্তবিক, শব্দ তা দেশীয় সংস্কৃত পরিমার্জিত বা বিজাতীয় বা একেবারেই আমাদের অন্তজ মুখের কথ্য টানের যাই হোক- কবি আভিজাত্যের ধার না ধেরে বেপরোয়া এলোপাথাড়ি এদের ব্যবহার দিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রতি কবিতার মাটিগন্ধ আত্মানুসন্ধান।ফুসমন্ত্র,পুটুস,ব্রহ্মকমল,
অক্ষরব্যঞ্জন, চ্যাটমোড, উলুকঝুলুক, সেনসিটিভ সেনসেক্স, বাইদ-শোল- কানালি, মনখারাপের মেঘ, সেলফি আপলোডায় না কেউ, ডিংডং, ছাঁচতল, অক্ষরসন্ন্যাসী, কবিতামন্দির, হ্যাসট্যাগ, টগবগাবগ, ব্যোম ব্যোমব্যোম,অ্যান্ড্রয়েডমগ্ন, দিনদাহাড়ে, অমোচনীয় স্বাক্ষর, শারীরিক স্বাক্ষরতা, হাম্পটি ডাম্পটি মারকাটারি, হরিবোল হরিবোল জীবনকুয়াশা, ঝালমুড়ির সন্দেহ , আদরনীতি, কাঁচানংকা- এখানে এলিট নন-এলিট শব্দ ব্যবহারের কৌশল একাকার করে দিয়েছে কবিতার অন্তর্মুখি কাব্যিকতা।

দীর্ঘ আলোচনা এবার শেষ করার সময়। শুধু আরেকটি প্রসঙ্গে না আসলে আলোচনা অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত রয়ে যাবে।
কথা হলো ভালবাসা যা মূলতঃ মাধবীলতা এবং নিজের জন্মদাত্রী মাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থের অনেকখানি জুড়ে। ভালোবাসার দায়বদ্ধতা ব্যক্তি পরিসর থেকে ব্যাপ্ত হয়েছে সমষ্টিগত জগতের জন্য। সেখানে সম্পর্কের প্রিয় মানুষজন যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকৃতি – গাছগাছালি নিজ গ্রাম শহর জেলার বিভিন্ন পাহাড় নদ নদী জঙ্গলমহলের কথা। কয়েক বছর আগে কবির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ
‘মৃত্যুকথা ও মাধবীলতা’র একেবারে শেষ কবিতা ‘মৃত্যুকথা ও মাধবীলতা ‘র শেষ স্তবকে উচ্চারিত হয়েছিল –’পুটুস ফুলের এত এত রঙ
কি করে আঁকলো,উন্মাদ এই মাঠ!
এবার যখন বর্ষা আসবে
আমি তোর নামে বুকের ভেতর
ঠিক পুঁতবো একটি মাধবীলতার গাছ!’
এই অঙ্গীকার জুড়ে আছে শপথ – আছে দায়বদ্ধতা, আছে মৃত্যু উত্তীর্ণ আবার নব জীবনের গান নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন- ভালোবাসার উজ্জ্বল উজ্জীবন। কবি ছাড়া এমন স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা কে’ইবা রাখতে পারে!
আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতায় লগ্ন আছে এই ভালোবাসা— কখনো তা মাধবীলতা , মধুমালতী, পুটুস, হাসনুহেনা , শিউলিকে আশ্রয় করে -কখনো জন্মদাত্রী মাকে ঘিরে। ফিরে ফিরে আসে আরো অনেক নাম- গন্ধেশ্বরী,কাঁসাই, শিলাবতী, দ্বারকেশ্বর,শুশুনিয়া, বিহারীনাথ – এমনকি টেরাকোটার নকশা,বালুচরি জমিন, থানে থানে জোড়া জোড়া হাতি ঘোড়া —কাঁচালঙ্কা থেকে সানকিতে রাখা পান্তাভাত পর্যন্ত।
‘পৃথিবীর নিরাময়ে ভালোবাসাবাসি’ র এমন ‘ছাঁচতলে জমে আছে কান্নার রং’ ,সেই কান্নাজল মোছাতে কবির চোখে স্বপ্ন -’ দুয়ারে দাঁড়িয়ে মা স্বয়ং–’ এই মায়ের স্মৃতিচিহ্নিত স্নেহের সঙ্গীতসুর কবির কবিতার পাতায় লেখা হয়ে যায় অপরূপ পোয়েটিক মূর্ছনায়–
‘পৃথিবীতে মায়ের থেকে ভালো কবিতা আর কেউ লিখতে পারে না –’
এমন বোধের লিরিক্যাল স্ফুরণ আমাদের মথিত করে দারুণ প্রতিক্রিয়ায়।

কবি তার মাএর মমত্ববোধের প্রতি নিষ্পাপ নস্টালজিক মনখারাপের চিত্রগুলি অনন্য অকৃপন প্রকাশের কাব্যিক ভাষায় নিয়ে এসেছেন এই কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতায়। একটু দেখেনি—

(১) কবিতা: শুভদিন

‘ মায়ের সংসারে শুভদিন এলে
রান্নাঘর থেকে উঠোন
পায়েসের সুগন্ধে ভরে যেত

——————————-
মা-হীন পৃথিবী কেক কেনো
আমরা সংসারের আদা-রসুন -পেঁয়াজ কিনতে কিনতে
লুকিয়ে মুছে রাখি চোখের জল–’

(২) কবিতা: রান্না

‘প্রতিটি দিন নিজেকেই কেটে পিস পিস করে রান্না করছি!
——————————————-
অথচ, এখনো মা পেঁয়াজ কাটলে
চোখ থেকে গলগল করে নুন নেমে আসার
সেই সব দৃশ্য এখনো জীবনের কথা বলে!
মা, তুমি কি দেখছো, আমাদের রান্না —’

(৩) কবিতা: স্বপ্নকথা

তোকে ভেবে, মনখারাপের মেঘের ভেতর ঢুকে
কাঁথায় ফোঁড় দিতে দিতে বলা
মায়ের সেই কথাগুলি খুব মনে পড়ে,

জানিস খোকা,জবাফুলের কোনো কথাই তুলসীগাছ জানলো না –’

‘স্পর্শজ সুখকথা’র মতো মায়ের স্মৃতিচারন—-এ হলো কবির বড় আপন আরাম যা শুধু রংধনুর মতো কবিকে আশাবাদী করে তোলে ‘ভালোবাসাহীন পৃথিবীর ক্যানভাসে নতুন করে ভালোবাসার ছবি আঁকতে। বইটির শেষ কবিতা ‘অক্ষরবাসা’য় সেই ছবি আঁকে অসামান্য কোলাজে — যেখানে অক্ষর-কে ‘মাটিতে পুঁতলে গাছ হয়ে যায়।তার পাশ দিয়ে বয়ে যায় নদী।’

এভাবেই ‘উল্কি আঁকা দিনগুলি’র সমস্ত আঁধার ঘুচিয়ে একদিন নবোদয় ঘটে নতুন সূর্যের।

‘পৃথিবীর বুকের ভিতর কোথাও শান্তি আছে;’– লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ।
উল্কিআঁকা দিনগুলির নির্য্যাসে সেই শান্তির সন্ধান পাঠক হিসেবে উপলব্ধি করতে পারলাম – এটুকু পাঠশেষে নির্দ্বিধায় বলা চলে।

অবশেষে বলি-অক্ষরবিন্যাস ও প্রচ্ছদে সুবীর মন্ডল ভালো। ছাপাই ভালো। বানান ভুল চোখে পড়ে নি। প্রকাশক টেক টাচ টক-কেও ধন্যবাদ। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম সংস্করণটি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা,২০২৪– এ’ও আমাদের কাছে আনন্দসন্দেশ।
অলমিতি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।