জন্মদিনে আলেক্সেই ম‍্যাকসিমোভিচ পেশকভ (২৮ মার্চ, ১৮৬৮ – ১৮ জুন, ১৯৩৬) এর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য – মৃদুল শ্রীমানী

গোর্কি আর তাঁর ‘মা’:

যখন কেউ কাউকে ভালবাসে, তখন সবকিছু সহজ ও স্বচ্ছ হয়ে যায়। কোথায় যেতে হবে ও কি করতে হবে, সেসব খুব সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। কি করা প্রয়োজন সেটা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হয় না এবং কোনো গুরুঠাকুরের কাছেও বিধান নিতে যেতে হয় না।
অল্প বয়সে আলেক্সেই ম‍্যাকসিমোভিচ পেশকভের পিতৃবিয়োগ হয়েছিল।
 সেই সময় তার মা আরেকজনের ঘর করতে চলে গেলেন। মাতৃস্নেহবঞ্চিত শিশুর মাথা গোঁজার জায়গা জুটল অনিচ্ছুক মাতামহের পরিবারে। মা না থাকলে যা হয়। মাতামহেরও বয়স হয়েছিল। ব‍্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছিল। তিনি নাতিটাকে প্রাপ‍্য আদরটুকু দিয়ে উঠতে পারতেন না। এমনকি এই ছেলেটাকে পড়িয়ে কি হবে, এমন ভাবনাও তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বালকটি যৎসামান্য যা কিছু স্নেহ পেয়েছে, তা মাতামহীর কাছে। লেখাপড়া শেখার সুযোগ না করে দিয়ে দাদামশায় তাকে কাজে জুতে দিলেন। এই কাজের জগতে কতদিন মালিকের হাতে মারধর খেয়েছে বেচারা। যেমনটি সাধারণতঃ শিশুশ্রমিকদের ভাগ‍্যে জুটে থাকে। ভরপেট খাবার জোটাতে পারাটা ছিল  স্বপ্ন। দৈবাৎ কোনো কোনো দিন সেই স্বপ্ন পূরণ হয়ে থাকবে। তালি মারা, রিফু করা জামাকাপড়েই মানিয়ে নিতে হত তাকে। এভাবেই কখনো মুচির দোকানে খিদমত খেটে, কখনো রঙের মিস্ত্রীর কাছে ফাইফরমাশ খেটে, কখনো ভলগা নদীর বুকে ভেসে চলা স্টিমারের রান্নাশালে লোকের এঁটো বাসন ধুয়ে গড়ে উঠছিল সে। ওর মধ‍্যেই স্টিমারের পাচক ঠাকুরটি তাকে পড়তে শিখিয়েছিল, আর অল্পদিনের মধ‍্যেই পড়াশুনা করাটা হয়ে উঠল তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। শত পরিশ্রম ও নির্যাতনের প্রহর সহ‍্য করে দিনান্তে পড়াশুনাটুকু সে করতই। ওই ছিল তার জীবনে একটুখানি আলোর রাস্তা।
 কৈশোরের শেষের দিকে এবং প্রথম যৌবনে কত রকম কাজের চক্করেই না তিনি ঘুরেছেন। পাঁউরুটির কারখানায়, বন্দরের খালাসির কাজে, তারপরে রাতপাহারার কাজ নিয়ে তাঁর সময় কেটেছে। কাজ করতে করতে জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, কাজে যদি আনন্দ পাওয়া যায়, তাহলে জীবনটা সুখের হয়ে ওঠে, আর কাজকে যদি শুষ্ক দায়িত্বপালন  বলে মনে হয়, তখন জীবন হয়ে ওঠে ক্রীতদাসত্বের নামান্তর। কঠোর বাস্তবের মধ‍্যে, অভাব আর বঞ্চনার মধ‍্যে থাকতে থাকতে তিনি শিখেছেন, যখন সবকিছু সহজে হাতে পাওয়া যায়, তখন একটা মানুষ নির্বোধ হাঁদারাম হয়ে পড়ে। ভাল আর মন্দের তফাত বোঝাটাও তাঁর কাজের জগৎ থেকে অর্জন করা। তিনি বলেছেন, একজন ভাল লোক সাদামাটা সরল হয়েও ভাল থাকতে পারে। কিন্তু খারাপ লোক হতে গেলে মগজে যথেষ্ট ঘিলু থাকতে হবে।
১৮৬৮ সালের আধুনিক ক‍্যালেণ্ডারের ২৮ মার্চ তারিখে রাশিয়ার নিজনি নভগোরদ এলাকায় জন্মেছিলেন আলেক্সেই ম‍্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। যাঁর কলমের নাম গোর্কি। রাশিয়ান শব্দ ‘গোর্কি’ র অর্থ তেতো। আট বছরের শৈশব থেকে যে কঠিন বাস্তব জীবনযন্ত্রণার সঙ্গে তিনি বড় হয়েছেন, তা তাঁকে ওই গোর্কি ছদ্মনামেই লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বছর চব্বিশ বয়স থেকেই বই পড়তে ভাল লাগাটা বিকশিত হল লিখতে ভাল লাগায়। ছোট কাগজে একের পর এক গল্প লিখে হাত শাণিয়ে চললেন। কিন্তু ১৮৯৫ সালে চেলকাস নামে একটি গল্প সেন্ট পিটার্সবার্গ জার্নালে প্রকাশ পেল। তখনই রাশিয়ার সাহিত‍্যপিপাসু মহল টের পেয়ে গেলেন যে, একজন শক্তিশালী লেখক আবির্ভূত হয়েছেন। ১৮৯৯তে পাঁউরুটি কারখানার  ঘর্মাক্ত নোনতা জগতের উপাদান নিয়ে গল্প লিখলেন, ‘টোয়েন্টি সিক্স মেন অ্যাণ্ড এ গার্ল’। অনেকেই মনে করেন, এটি তাঁর সবসেরা ছোটগল্প।
 ‘গোর্কি’, নিজেকে এই নামে পরিচিত করলেন আলেক্সেই ম‍্যাকসিমোভিচ পেশকভ (২৮ মার্চ, ১৮৬৮ – ১৮ জুন, ১৯৩৬)। ১৯০৬ সালে লিখলেন ‘মাত’। এটি মাতা শব্দের রাশিয়ান প্রতিশব্দ। ইংরেজি ভাষায় মাদার। বইটি বিখ্যাত হয়েছিল। সারা পৃথিবীর সবচাইতে প্রভাবশালী বইগুলির নাম উল্লেখ করতে বললে, গোর্কির মা উপন্যাস অবশ্যই উপরের দিকে থাকবে।
গোর্কি তাঁর মা উপন্যাসে এক মহিলার কথা লিখে চলেন। সেই মা রাশিয়ার একটি কারখানায় কঠোর দৈহিক পরিশ্রম করে দারিদ্র্য আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে নিয়মিত যুঝে চলেন। পেলাগেয়া নিলভনা ভ্লাসোভা, এই মা এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় সংগ্রামী চরিত্র। তার স্বামী একটি দুর্বিষহ মদ‍্যপ, স্ত্রীর উপর শারীরিক অত‍্যাচারে অভ‍্যস্ত। মহিলার উপরেই সন্তানকে বড় করে তোলার দায়িত্ব। মাতাল স্বামীটি একদিন হঠাৎ করেই মারা পড়েন।  এবার ছেলের পালা। বড় হয়ে উঠতে থাকা ছেলে মাতাল বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেও মদ ধরে। অথবা মদ তাকে ধরে। মা পেলাগেয়া নিলভনার যেন জ্বালা যন্ত্রণার শেষ নেই। এমন সময় হঠাৎ করেই ছেলেটি রাশিয়ার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। আর মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বই এনে পড়াশুনার অভ‍্যাস গড়ে তোলে।
মা পেলাগেয়া নিলভনা কারখানায় গতরে খাটা শ্রমিক। তায় অশিক্ষিত। রাজনৈতিক কোনো বোধ তার মধ্যে কোনোদিন ছিল না। স্বামীর হাতে বেধড়ক মার খেতে খেতে যার যৌবন ক্ষয়ে গিয়েছে, সে মহিলা ছেলের এই আচমকা পরিবর্তন লক্ষ করে প্রথমটা বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। পরে নিজের মাতৃত্বের অনুভবশক্তি দিয়ে নিলভনা উপলব্ধি করলেন, বিপ্লব কত মহৎ, এবং সেই বিপ্লবের কাজে ছেলের সঙ্গে নিজেও যুক্ত হলেন।
মায়ের এই উত্তরণের গল্প সারা পৃথিবীতে যারাই হাতে কলমে সমাজ বদলের লড়াই লড়েছেন, তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছে। গরিব ঘরের মেয়ে অত‍্যাচারিত হওয়াটাকেই ভবিতব‍্য বলে শিরোধার্য না করে দিন বদলের লড়াইতে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন: এটাই দুনিয়ার বড় বড় বিপ্লবী সংগঠকেরা চেয়েছেন। এই ‘মা’ উপন্যাস গোর্কিকে রাশিয়ার বুকে অনন্য মহিমায় স্থাপিত করেছে। বারে বারে ভাষান্তরিত, নাট‍্যায়িত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়ে ‘মা’ আজ এক অনির্বাণ দীপশিখা। মা সম্বন্ধে গোর্কির উপলব্ধিটিও অসাধারণ। তিনি বলেন, একমাত্র মায়েরাই ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারেন। কেন না, মায়েরাই সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।