দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯৭)

পর্ব – ১৯৭

শ‍্যামলী বলল, বাবা, তোমার নিজের রক্ত জল করা পয়সায় তৈরি এই বাড়ি আর তোমার একার মেহনতে তৈরি কারখানা তুমি যাকে ইচ্ছা দান করতেই পারো। কিন্তু নির্ব‍্যূঢ় স্বত্বে একবার দান করলে সেখানে তোমার আর কোনো রকম অধিকার থাকবে না। তুমি জানো কি না জানি না, আজ সারা দুনিয়ায় বয়স্ক মানুষের জীবন একটা সংকটের মধ‍্যে পড়েছে। বার্ধক‍্যে  অনেকেই নিজের গড়া বাড়িতে নানা রকম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। বাড়ি বাগানোর অপেক্ষায় থাকে পরের প্রজন্ম। বাগানো হয়ে গেলে দূর ছাই, আপদ বালাই বলা শুরু হয়ে যায়।  নিয়মিত স্বাস্থ্যের নজরদারি দূরস্থান, ঠিকমতো পরিমাণে খাবারটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয় না। টিভিতে দেখা সত‍্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি মনে পড়ে। ইন্দির ঠাক‍রুণ, হরিহর রায়ের সম্পর্কিত দিদি, গায়ের চাদরের ছেঁড়া অংশটা দেখাতে থাকেন।
 একটি অপরাধ বোধের গ্লানির ছায়াপাত শ‍্যামলী তার বাবার চোখে দেখতে পায়। জল চিকচিক করছে। শশাঙ্ক পাল বলেন, তোকে আমি একেবারেই বঞ্চিত করেছি ছোটমণি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস্ মা।
শ‍্যামলী বলে, কেন বাবা, তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছ, আমাদের দুই বোনকে নিজস্ব ঘর দিয়েছ নিচের ক্লাসে পড়ার সময় থেকে। আর ঘরের লাগোয়া একান্ত নিজেদের  বাথরুম। সেখানে বড়ো আয়না। নিজেদের আলমারি। জানো বাবা, নিজেদের আলাদা ঘর পেয়েছিলাম বলে পড়তে অনেক সুবিধা হয়েছে। একেবারে দু বোনকে নিজেদের বাথরুম করে দিয়ে তুমি আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন করে দিয়েছ। তুমি কারখানার দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে ব‍্যবসা চালাতে শিখবার সুযোগ করে দিয়েছ। এখন আমি পুলিশ, মস্তান, ইউনিয়ন লিডার কারো মুখোমুখি হতে ভয় পাই না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, নে নে, হয়েছে। আর এই ফেল মারা লোকটাকে মাথায় তুলিস না। অতটা স‌ইবে না।
বাবার কোল ঘেঁষে বসে শ‍্যামলী বলল, ফেল মারা কে বলে তোমায়?
শশাঙ্ক পাল বলেন, তোকে আমি কিছুই দিলাম না। তোর গয়নাগুলো, ফিক্সড ডিপোজিটগুলো, সব দিয়ে তুই কারখানার লোন শোধ করে দিয়ে বুড়ো বাপকে জেলের ঘানিটানা থেকে বাঁচালি। আর আমি তোকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করলাম।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, ব‍্যবসায়িক জগতে গুড‌উইল সবচেয়ে সেরা সম্পদ। তুমি মনে করে দ‍্যাখো বাবা, বড় কোম্পানির ব‍্যালান্সশীটের ডানদিকের কলামে অ্যাসেটগুলো দেখানো হয়, মনে করতে পারছ?
শশাঙ্ক পাল ঘাড় নাড়েন।
শ‍্যামলী বলে, মনে করে দ‍্যাখো, অ্যাসেট কলামে সবার উপরে থাকে গুড‌উইল। গুড‌উইল থাকলে কোম্পানির জিনিসের ব্রাণ্ডভ‍্যালু বেড়ে যায় বাবা!
শ‍্যামলী আরো বলে, জানো বাবা, আজ আমাকে রাস্তায় একজন বয়স্ক মানুষ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি পালেদের বাড়ির ছোটোখুকি না? বাবা, রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা মেয়েকে তুমি কতবড় একটা পরিচয় উপহার দিয়েছ, তুমি নিজেই জানো না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তুই এই কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিস কেন? আমি কি তোকে কখনো এ রকম বলেছি?
শ‍্যামলী মেরুদণ্ড টানটান করে বসে। বাবা, আমি বিশ্বাস করি না, তুমি নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় এই দলিল লিখেছ। তোমাকে চাপ দিয়ে স‌ই করানো হয়েছে। তুমি ঠিক ঠিক জানোই না, দলিলের কোন্ লাইনে কি কথা লেখা আছে আর তার মানেটা ঠিক কি! চাপের মুখে তোমাকে স‌ই করতে বাধ‍্য করা হয়েছে।
শশাঙ্ক পাল বলেন, না না, আমি সব জেনে বুঝে করেছি।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, তুমি আমার চোখকে ধুলো দিতে পারো, কিন্তু নিজের বুকের ভিতর যে মানুষটা বসে আছে, তার থেকে লুকোতে পারবে?
শশাঙ্ক পাল বিরক্ত হন। একটা খাঁকার দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে বলেন, না না, আমি যা বুঝেছি, তাই করেছি।
শ‍্যামলী এবার কেঁদে ফ‍্যালে। মিথ‍্যে কথা কেন বলছ বাবা? এই দলিলের আটঘাট কিছুই তুমি জান না। দলিলটা ঠিকমতো পড়ে দেখতেও তোমার ইচ্ছে হয় নি। লজ্জায় ঘেন্নায় তিতিবিরক্ত হয়ে তুমি দলিলে স‌ই দিতে বাধ‍্য হয়েছ। একটিবার সত‍্যি কথাটা স্বীকার করো না বাবা?
শ‍্যামলী শশাঙ্ক পালের পায়ের উপর মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
বাসন্তীবালা হঠাৎ করে ঘরে এসে অবাক হয়ে যান।
শ‍্যামলী বলে, ওই দলিলে লেখা আছে, আমার একমাত্র কন‍্যা আয়ুষ্মতী তনুশ্রীকে আমি উপযুক্ত ভাবে পাত্রস্থ করিয়াছি। প্রতিষ্ঠিত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর সাথে সে সুখে সংসার করিতেছে। …. বাবা, তুমি একথা লিখতে বাধ‍্য হয়েছ। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে এ তুমি কিছুতেই লিখতে পারতে না। তুমি আমাকে সম্পত্তি দাও নি বলে আমি কিচ্ছু মনে করি নি। সম্পত্তি বড় জিনিস নয়। সম্পত্তি চিরকাল থাকে না। সত‍্য উপলব্ধিটুকু থাকে। আমি তোমার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে হলেও, স্নেহে আদরে প্রশ্রয়ে তুমি কিচ্ছু ঘাটতি রাখো নি। সেই তুমি আমাকে সন্তানের তালিকা থেকে স্বেচ্ছায় বাদ দিয়েছ, এটা আমি বিশ্বাস করি না বাবা।
বাসন্তীবালা হাঁ করে চেয়ে থাকেন। কি লেখা আছে দলিলে? তুই কি করে জানলি?
শ‍্যামলী বলল, মা, তুমি চুপ করে বোসো। আমি কি বলি শোনো।
বাবা, যে মেয়েকে তুমি কোলে পিঠে সমান আদরে মানুষ করেছ, সাংঘাতিক চাপের মুখে না পড়লে তাকে অস্বীকার করার মানুষ তুমি ন‌ও বাবা।
শশাঙ্ক পাল আর পারেন না। দুহাতে মুখ লুকিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন।‌ ধরা গলায় বললেন, নিজের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হয়ে কেউ যদি বলে, এই দলিলে স‌ই না করতে চাইলে বুঝব, শ‍্যামলীর সাথে আপনার খারাপ সম্পর্ক আছে। সত‍্যি সত‍্যি মেয়ে তো আর নয়, বাপ মেয়ে সম্পর্ক এখানে বাধা হয় না।
বাসন্তীবালা বললেন, এই সব নোংরা কথা কে বলেছে তোমাকে? দলিলে কি লিখেছে?
শ‍্যামলী চোখ মুছে বলল, বাবা, নির্ব‍্যূঢ় স্বত্বে দলিল হয়ে গিয়েছে। এখন এখানে থাকা আমার মানায় না। সে অধিকার আমার নেই।
বাসন্তীবালা ককিয়ে উঠে বলেন, সে কি, বাপের সম্পত্তিতে মেয়ের যদ্দিন না বিয়ে হয়, থাকতে পারবে না? কোন্ আইনে একথা বলে রে?
অদ্ভুত শান্ত গলায় শ‍্যামলী বলে, বাবা, আইনতঃ এই সম্পত্তি আর তোমার নয়। তোমার কোনো অধিকার নেই এখানে কাউকে থাকতে বলার। আমি কাল বাড়ি ফিরি নি কেন জান বাবা? আমার ভয়ে এখানে ঘুম ভেঙে যায়। কেবল মনে হয় ওরা আমার ক্ষতি করে দেবে। আমি জানি, দেহ শেষ কথা নয়, আর ধর্ষণ করে একটা দেহকে নষ্ট করে দেওয়া যায় না, তবুও বিপদে কে পড়তে চায় বলো?
বাবা, মা, তোমরা সাবধানে থেকো। আমি তোমাদের খবর রাখব। বাসন্তীবালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, কি সর্বনেশে দলিল তুমি করলে, যে মেয়েটা বাড়িতে টিঁকতে পারে না?
শশাঙ্ক পাল মাথা নিচু করে বসে থাকেন। শ‍্যামলী পা রাখল বাড়ির বাইরে। আকাশে ফটফট করছে জ‍্যোছনা। মনে হচ্ছে না, কোথাও কিছু কম পড়েছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।