Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্পিতা বোস (পর্ব - ৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্পিতা বোস (পর্ব - ৭)

বৃত্ত

আজ সাত মাস কেটে গেছে রূপসার বাবা নিরুদ্দেশ। রূপসার দাদা-বৌদি সন্ধান পাওয়ার আশা ছেড়েছেন। মা অদ্ভুতরকম শান্ত। তবে রূপসা বোঝে মা তার অনুপস্থিতিতে কান্নাকাটিও করেন। কিন্তু রূপসার বারবার মনে হয় বাবা ঠিক ফিরবেন। সাত‍্যকীও রূপসাকে এই আশাতে ভরসা রাখতে বলে। হ্যাঁ, দুজনে মনের কথা না প্রকাশ করলেও মনের কাছাকাছিতেই বাস করে।

১৪ আজ কতদিন এখানে আছে জানে না রাহুল। বোধহয় জন্ম থেকেই এখানে থাকে। নাকি অন্য কোথাও কিছু মনে পড়ে না। মনে করতে গেলেই মাথায় খুব তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। তবে এখানে ভালো লাগে না কিছুই। শুধু ঐ একটা মেয়েকে ছাড়া। ঐ মেয়েটাকে সবাই 'রূপসা' বলে ডাকে। রাহুলের একমাত্র ওকেই খুব চেনা চেনা লাগে। কিন্তু ওকে ঠিক করে চিনে উঠতে পারে না। মেয়েটা অদ্ভুত! ওকে দেখে কখনও হাসে না। কাছে এসে বসে, ব্যায়াম করায়, ওষুধ খাওয়ায়। এমনকি যে কাজগুলোই রাহুল একা করতে পারে না, সবটাই করতে সাহায্য করে। এখানে সবার সাথেই রূপসা হাসে, কথা বলে শুধু রাহুলের দিকে তাকিয়ে হাসে না। কেমন কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু ওর হাত ধরলেই সব লুকনো ভয়, আতঙ্ক কেটে যায় রাহুলের। মেয়েটাকে বড় চেনা লাগে অথচ মনে করতে পারে না কিছুই। আরেকজন লোক আর মহিলা আসেন মাঝে মাঝে। চেনা চেনা লাগলেও ঠিক চিনতে পারে না। ওকে দেখে কান্নাকাটি করে। 'রাহুল' বলে ডাকে। নিজের নামটা যে 'রাহুল' সেটা বুঝতে পারে এখন। কিন্তু এখানে একজনকে রাহুলের একদম ভালো লাগে না। ঐ রূপসা নামের মেয়েটা যাকে 'স‍্যার' বলে ডাকে। রূপসা লোকটাকে দেখে হাসে, কথা বলে। কখনও বাইরের বারান্দায় বসে দুজনে একসাথে চা নিয়ে অনেকটা সময় কাটায়। রাহুলের খুব রাগ হয়। উফ্ তীব্র মাথার যন্ত্রণা করে ওঠে রাহুলের।

১৫ বিকেলে রিহ‍্যাবের বারান্দায় বসে আছে সাত‍্যকী। বাগানে পেশেন্টদের দেখছে। দেখছে নয়, বলা যায় স্টাডি করছে। মানুষের মস্তিষ্ক বড় জটিল। আজও মস্তিষ্কের বিভিন্ন জটিল কার্যকলাপ বিজ্ঞানের অজানা। তাই কিছু মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকারণ সাধারণের চোখে অস্বাভাবিক। এই জটিলতার সমাধান চিকিৎসাজগতের কাছে আজও অজানা। তাই এমন রোগীদের নিরাময় সবসময় সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। শরীরের মতো মনও অসুস্থ হয়। এটাও রোগ। কিন্তু সমাজ তা বোঝে কই? মানসিকভাবে অসুস্থদের তাই সহজেই 'পাগল' আখ‍্যা দিয়ে দেয় সমাজ। যেমন সাত‍্যকীর পিসিকে পাগল ভাবা হয়েছিল। ঠিক তেমন থানায় রূপসার বাবা সম্পর্কে অফিসার ইন-চার্জ বলেছিলেন, -আরে মশাই এসব পাগলকে কেন বাড়িতে রাখেন? কথাটা শুনেই দপ করে জ্বলে উঠেছিল রূপসা, -- আমার বাবা পাগল নন। -- ঐ হলো। ভুলে গেলে তো পাগলের মতোই ঘুরবে রাস্তায় রাস্তায়। রূপসাকে ইশারায় থামতে বলে সাত‍্যকী বলেছিল -- দেখুন অ‍্যালজাইমার একটা রোগ। স্মৃতিভ্রংশ বলতে পারেন। এখন এসব নিয়ে আলোচনা না করে বরং মিসিং ডাইরিটা নিয়ে নিলে ভালো হয়। সিগারেটের ধোঁয়াটা আকাশে উড়াতে উড়াতে ভাবে সত্যিই কতজনকে এভাবে বোঝানো যায়! 'পাগল' শব্দটা আসলে খুব সহজভাবে গ্রহণযোগ্য সমাজের কাছে। আর ততটাই যন্ত্রণার রোগী ও তার কাছের মানুষের কাছে। এই রিহ‍্যাবের অধিকাংশ পেশেন্টই ডিমেনশিয়ার। এদের নব্বই শতাংশ কখনও সুস্থ হবেন না। স্মৃতি-বিস্মৃতির জটিল গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে এভাবেই শেষ হয়ে যাবেন। একটা সময়ের পরে সাত‍্যকীও বড় অসহায় এই রোগের কাছে। কিছুই আর করার থাকে না। প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছেন চারজন। এদের আর কখনও আলোর পথে ফেরানো যাবে না। তবুও সাত‍্যকী এদের ঘরে রোজ নিজে যায়। হালকা গান চালিয়ে রাখে। কথা বলে। আসলে প্রতিটা পেশেন্ট সাত‍্যকীকে নতুন নতুন করে বিস্মৃতির সন্ধান দেয়। বই, জার্নালের বাইরেও এইভাবে নতুন অভিজ্ঞতায় নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ভাবায়। প্রতিটা পেশেন্ট নতুন নতুন এককেকটা শিক্ষা যেন সাত্যকির কাছে। চলতেই থাকে তার এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া। সামনের বাগানে এই যে এতগুলো রোগী, প্রত‍্যেকেই একটা সময় সাত‍্যকীর কাছে নতুন অধ‍্যায়।

ক্রমশ

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register