Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ফার্স্ট স্টপ

maro news
ফার্স্ট স্টপ

ফার্স্ট স্টপ : গৌরীপতি বণিক

অভিনয় দিয়ে মন জয় করেছিলেন আপামর বাঙালির। রূপালি পর্দা ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির আইকন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার। আজ তার ৯৪তম জন্মদিন।
আজ আমি উত্তমকুমারের জীবনের সেই দিকটা নিয়ে আলোচনা করবো যেদিকে তাকালে সবারই ভ্রু কুচকাতে বাধ্য। আজও দিশেহারা ওখানে সবাই। মহানায়কের মনের গভীরে থাকা সত্যিকারের পাঠটা সত্যিই রহস্যের।
উত্তম কুমারকে ‘বণিক’ বলে ডাকতেন তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবী। বণিক কেন? মনে হয়, উত্তম কুমারের বাণিজ্য ভাবনা থেকেই এই নামের উৎপত্তি। সিনেমাটাকে ঘিরে ব্যবসা করার কথা ক্রমেই মাথায় চড়ছিল উত্তমের। গৌরী জানতেন, উত্তম কুমারের পক্ষে আর যা করাই সম্ভব হোক না কেন, জমিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। উত্তম কুমারের মানসিকতাতেই তা খাপ খাবে না। তাই মনে হয়, খানিকটা ঠাট্টার ছলেই ‘বণিক’ নামটি এসেছে। উত্তম কুমার আবার গৌরী দেবীকে আদর করে গজু বলে ডাকতেন। আসলে গৌরী দেবী ক্রমে মোটা হচ্ছিলেন। আর সেখান থেকেই গজু নামটা এসেছে বলে মনে হয়। তবে ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হয়ে যায় ১২ অক্টোবর ১৯৭১ সালে। ভারতের এলাহাবাদ থেকে গৌরী লিখে ব্রাকেট দিয়ে লিখেছেন ‘হাতি মেরে সাথী’। উত্তম কুমারের লেখা সেই চিঠিটাই একবার দেখে নেওয়া যাক।
গৌরী (হাতি মেরে সাথী)
পুজো কেমন কাটালে? গলা ধরেনি? গৌতম কেমন আছে? কাশী থেকে ফেরার সময় আর ফোন করে উঠতে পারলাম না। যাই হোক, ওপারের ঠিকানায় আছি। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। বাংলোটাও বেশ আধুনিক। কেবল টেলিফোন নেই। জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের আজ আসবার কথা। শুটিং আরম্ভ হওয়ার কথা ১৫ অক্টোবর। ২৫ তারিখের আগে যদি হয়ে যায়, তাহলে কলকাতায় ফিরে যাবো। আর বাইরে ঘুরতে ভালো লাগছে না। তোমার শরীর ভালো আছে তো? আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। মজুমদার হয়তো অক্টোবর মাসের দরুন তিন হাজার টাকা দেবে। ওটার সঙ্গে আলিপুর ও ভবানীপুর বাড়ির ভাড়া যোগ করলে ছয় হাজার টাকা হয়। চালিয়ে নিও। বাকি বকেয়া যা আছে, ফিরে গিয়ে হিসাব করবো। পাড়ায় কোনো গোলমাল নেই তো? তোমার মা আছেন, না চলে গেছেন? যদি থাকেন, আমার বিজয়ার প্রণাম জানিও। খোকা, ছুটকি ওরা কেমন আছে? জামাই আর তৃণা কি আসে? জামাইয়ের চাকরি কি হলো? ভালো থেকো। ফিরে গিয়ে আলাপ, প্রলাপ সব হবে। আসি? ভালোবাসা জেনো। গৌতমকে আমার শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানিও।
ইতি
উত্তম (বণিক)
গৌরী দেবীকে উত্তম কুমার অর্ধাঙ্গিনী স্বীকার করে গেছেন আজীবনই। অন্তত চিঠিপত্র সে কথাই বলছে। বোম্বে থেকে সেই সময়ে গৌরী দেবীকে লেখা উত্তমের অপর একটি চিঠি।
প্রিয় গৌরী (গজু)
মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ভেবেছিলাম যে বোম্বে, মাদ্রাজকে কেন্দ্র করে কলকাতার অর্ধকৃত ছবিগুলো শেষ করব। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ল, যখন জানতে পারলাম যে ওরা কেউই কলকাতা ছেড়ে আসতে রাজি নয়। আরো হতাশ হয়ে পড়লাম যখন দেবেশ খবর দিলেন যে, প্রোডিউসাররা এর পরের মাস থেকে আর টাকা দিতেও রাজি নয়, যদি আমি কলকাতায় ফিরে না যাই। দুটো ঘরওয়ালা একটা ফ্ল্যাটও দেখেছিলাম তোমাকে এনে রাখবো বলে। কিন্তু টাকাই যদি না আসে, কা ভরসায় আমি ফ্ল্যাট নেব? আর আমিই বা না খেয়ে কত দিন এখানে পড়ে থাকবো? নানা রকমের ভাবনা ছেঁকে ধরেছে। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এও ভেবেছিলাম যে, শক্ত সামন্ত হয়তো কিছু করলেও করতে পারে। সে বিষয়ে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। কিন্তু এমনটাই ভাগ্য দেখো যে শক্তি সামন্তও ঠিক সেই সময়ে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। কোনো দিক দিয়ে কোনো আশা-ভরসা পাচ্ছি না। দেবেশ দয়া করে ওর যে ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছে, সেটাও ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। কেননা, রঞ্জনা পুজোর ছুটিতে এখানে থাকবে। অগত্যা আপাতত আলোর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর খুঁজে পাচ্ছি না। অসীমকে পাঠিয়েছিলাম। অসম্ভব খরচা বাড়িয়ে লাভ কী? অসীমের কাছে আমার ফুরাবস্থার কথা সব জানতে পারবে। নীতাদিকে জিজ্ঞেস করে আমাকে যতো শীঘ্রি পারো জানাবে যে, ওখানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোন সময়টা প্রশস্ত। তাহলে যতো শীঘ্রি পারি আমি এখান থেকে ফিরে যাবো। এখানে আর একেবারে ভালো লাগছে না। তুমি চারতলা বাড়ির ভাড়াটা ও আলিপুরের বাড়ির ভাড়াটা নিয়ে কোনোরকমে যদি চালিয়ে দাও, আমার মনের এবং শরীরের ভীষণ উপকার হবে। মায়ের টাকা ও আমার এখানকার শুধু খাওয়ার টাকাটা অসীম ওখান থেকে যা হোক করে বলেছে পাঠিয়ে দেবে। তারপর জানি না কী হবে? সবাই চোখের সামনে এক রকম। আর চোখ ফেরালেই অন্য রকম। এর ওপর তুমি যদি এখানে আসার ও থাকার বায়না করো, তাহলে ভীষণ ক্ষতি। কেননা, এখানে ফ্ল্যাট নিতে গেলে কমপক্ষে ৬০০ টাকা জমা দিতে হবে। ছবির এখানে চেষ্টা করছি। কাজের চেষ্টা চলছে। যদি একখানা বাংলা ছবিও এখানে করতে পারি, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, নিশ্চয়ই এখানে নিয়ে আসবো। তবে কাজ কিছু না হলে বা পেলে আমাকে ফিরে যেতেই হবে। গৌতমের জন্মদিন বেশ ভালোই কেটেছে। ওরা এখানে খুব ঘুরে বেড়িয়েছে। তুমি একেবারে মন খারাপ করো না। সময় যখন খারাপ পড়ে, তখন মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে হয়। আমি জানি, এই চিঠি পড়ে তোমার খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু উপায় একটা কিছু না বের করলে কী করে কী হবে বলো? দু’একটা বাংলা ছবি এখান থেকে হওয়ার কথা যে হচ্ছে না, এমনও নয়, হচ্ছে। তবে যতোক্ষণ কাগজপত্রে সই-সাবুদ না হচ্ছে, বিশ্বাস কী বলো? তুমি একদম মন খারাপ করো না। এই সময় তুমি মন খারাপ করলে শরীরের দিক থেকে আমাদের দু’জনেরই ক্ষতি। আমার জন্য অনেক কষ্টই তো সহ্য করলে, আর এই কটা দিন একটু সহ্য করো। মায়ের খবরাখবর করো। আর বুড়ো আতঙ্কের বোঝা না বাড়িয়ে আমার যেন একটু খবরাখবর করে। সপ্তাহে যেন একখানা করেও চিঠি দিও।
ইতি
উত্তম (বণিক)
১৯৬৩ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের বাকি সতেরটি বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই অতিবাহিত করেন। কেমন ছিল তাদের জীবন? সুপ্রিয়া দেবী তার স্মৃতিকথা ‘আমার জীবন আমার উত্তম’-এ সেকথা অনেকভাবেই বলেছেন। তার ভাষ্যে জানা যায়, ১৯৬২ সালের ২রা ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়। বিয়েতে সুপ্রিয়ার বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উত্তম কুমারের কয়েকজন বন্ধুও ছিলেন। ৫ই ডিসেম্বর তারা বিবাহত্তোর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে চলচ্চিত্র জগতের প্রচুর অতিথির সমাগম হয়। তবে গৌরী দেবীর সঙ্গে আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না হওয়ায় তারা রেজিস্ট্রি করতে পারেননি। তবু তিনি কোথাও গিয়ে যেন গৌরীপতি, তাই না?
বাই দা ওয়ে, কথায় আছে Charity begins at home৷ তাই কেবল উত্তমবাবুর জন্মদিনে তাকে নিয়ে লিখে উত্তম সম্পাদকীয় লেখার চেষ্টা ততক্ষণ সফল হতে পারে না যতক্ষণ না আমি আমার সম্পাদনার অন্যতম সহযোগীর বার্থডে উইস করবো। সুতরাং —
শুভ জন্মেছিলে দিন সঙ্কর্ষণ

শাল্যদানী

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register