ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১০)

রূপকথা পৃথিবীর

যেখানেই থাকি আমার সঙ্গে থাকে
সবুজে সবুজ অপরূপ ভালোবাসা,
যেখানেই যাই় সঙ্গে সঙ্গে যায়–
তালবনে দেখা বাবুই পাখির বাসা !
ভাইফোঁটার দিন সকাল থেকেই বাড়িতে সাজ সাজ রব ! কী কী কী ? ওমা ,তাও জানোনা ! বাড়ির কর্তা আজকে পোলাও রাঁধবে যে! আমার বাবা যেদিন হাতা খুন্তি ধরে , সেদিন মনে হয় বাড়িতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে ।
তার ওপর , এটা তো প্রতিদিনের মাছের ঝোল ভাত রান্না করা নয় ! যাকে বলে পো-লা-ও ! নিউমার্কেট থেকে মশলা এসেছে । বাবা বলে — জৈত্রী, জায়ফল,জাফরান, শাজিরে, শামরিচ আর উৎকৃষ্ট ঘি , সঙ্গে বাসমতী আতপ ; এসব না হলে নাকি পোলাও জমে না। সঙ্গে বড় বড় কিসমিস আর বাদাম। না,না — কাজুবাদাম নয় । এই দিদি , কী নাম রে বাদামটার ? দিদি তখন বাগানে খুরপি দিয়ে মাটি খু়ঁড়ে কি যেন বার করছে।
আমার উত্তর দিতে তার বয়েই গেছে ! ওমা, ভুলেই গিয়েছিলাম , ভাদ্র মাসে যে দুটো তাল এ বাড়িতে এসেছিল , সে তালের আঁটিগুলো দিদি কোন ফাঁকে বাগানে পুঁতে দিয়েছিল । আর , আজকে সেখান থেকে ছ’ছটা কল বেরোনো আঁটি মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। বাবা তুমুল কাজের মধ্যেও কাটারি দিয়ে সেগুলো দুফালি করতেই ভেতর থেকে নরম সুস্বাদু ফোঁপল বেরিয়ে যেন দুটো সাদা ফুলের মতো ফুটে উঠলো ! কিন্তু না, এখন খাওয়া চলবে না। এখন আমাদের উপোস। ঠিক ন’টার মধ্যে, বড়োজোর সাড়ে ন’টার মধ্যে মামার বাড়ির পাঁচ মামা পাড়া আলো করে , হাহা হিহি করতে করতে , বড়দি বড়দি বলতে বলতে ঢুকবে আমাদের বাড়িতে । হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার। ভাইফোঁটার দিন বারাসাতে মাসির বাড়িতে যাওয়ার জন্য লোক পাওয়া যায় না , মামারা গাঁইগুঁই করে অতদূর যেতে , আর আমাদের বাড়িতে সবাই মিলে এসে উপস্থিত হয় ‌। সেজো মামা দুই হাতে বড় বড় দুটো প্যাকেটে দশ বারোটা বিশাল বিশাল তুবড়ি নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বাবাকে আওয়াজ দিয়ে বললো — এই যে দাদাবাবু , গুড মর্নিং। আপনার থেকে অনেক ভালো তুবড়ি আমি বানাই । আজকে সন্ধেবেলায় দেখে নেবেন। বাবা বললো , আমারও তিন-চারটে তুবড়ি রয়ে গেছে। ভুলে যাস না–তুই কলকাতা হলে আমিও কিন্তু যশোরের…
মা তাড়া লাগায় — চল চল, সবাই স্নান করে এসেছিস তো ? এবার বসে পড় । বিলু শিখা ঝন্টু আর তোদের দাদাবাবুও না খেয়ে রয়েছে । ভাড়া বাড়ির আলিশান বারান্দায় সবাই আসন পেতে বসে পড়লাম । প্রথমে দিদি আমাকে আর দাদাকে ফোঁটা দিলো , মা শা়ঁখ বাজালো । দিদি দু-একটা মিষ্টি দিয়ে একটা ছোট্ট রেকাবি উপহার দিলো। এবার মায়ের পালা। পরপর পাঁচ ভাইকে ধান দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করছে ,আর বেশ জোরে জোরে সুরেলা গলায় বলছে —
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা ,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা,
চন্দ্র সূর্য যতদিন ,
ভাই থাক আমার ততদিন।
বাবা খাটে বসে চোখ ছলছল করে শুনছে , কেননা বাবার দুই দিদি –বনগাঁয় আমাদের ভীষণ প্রিয় ছানাপিসি আর খড়্গপুরের দিগন্তে যশোরের প্রাক্তন চাম্পিয়ন মহিলা অ্যাথেলেট বীণা বোস, বাবার মেজদিদি,আমাদের বীণাপিসি , ঠিক এই সময় হয়তো দেওয়ালে বাঁ হাতের অনামিকা দিয়ে ঘি চন্দনের ফোঁটা দিচ্ছে , প্রিয় ভাইকে মনে করে। বাবা প্রতিবারই বলে– পরেরবার আমি যাব, হয় বনগাঁয় নয় খড়্গপুরে।
পাঁচ মামাকে মা একা সামলাতে পারবে না বলে বাবার যাওয়া হয়না। আমি আর দিদি এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করি , দাদাও যোগ দেয় । আমরা সবাই জানি, আমাদের মা একটু আলটুসি গোছের। বাবা তাকে খুব– ওগো শুনছো, ও গো শুনছো করে আগলে রাখে।
ও মা ,দেখো ,ভাইফোঁটার খাবার কথাটাই বলি নি ! এবার চিনেমাটির প্লেটে প্লেটে থরেথরে লুচি ,লম্বা লম্বা বেগুন ভাজা আর নতুন ওঠা ফুলকপি আলুর চচ্চড়ি । তার সাথে বেশ কয়েক রকম মিষ্টি , নাড়ু , আর এক টুকরো করে সেই বাগানের মাটি খুঁড়ে তোলা, তালের ফোঁপল । লুচি খাওয়ার যেন কোন শেষ নেই রে ভাই । অগুনতি লুচি । বাবা ভেজে যাচ্ছে , মা দিদি সাপ্লাই দিচ্ছে। একসময় বাবাকে সরিয়ে মা নিজেই বসে পড়ে । আচ্ছা দিদি, আজ মা, মণিমামা আর সেজমামার গান হবে না ।
দিদি হাইট পাকা গিন্নির মতো জবাব দিলো–আচ্ছা ঝন্টু, মায়ের আজ গান নিয়ে বসবার মতো সময় আছে ?
শোন হাঁদা, আজ দুপুরে ভোজের পরে , আমরা জমিয়ে মেমারি গেম খেলবো।
বড়োমামা আর মেজমামা শেখাবে আমাকে আর দাদাকে । ককিয়ে উঠে বললাম– আমি ?
দিদি খাতা আর ডটপেন আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো– একটাও বানান ভুল না করে লিখিত আবেদন কর,
তারপরে আমি আর দাদা ভেবে দেখবো । আমি চিলের মতো চেঁচিয়ে, জিভ ভেংচিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধাতে গিয়েই শুনলাম, মায়ের চকলেট
পালিশ হারমোনিয়ামে প্রিয় মণিমামার আশ্চর্য সুরেলা গলা– পথের ক্লান্তি ভুলে, স্নেহভরা কোলে তব, মা গো বলো কবে শীতল হবো…
সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই বাড়ির সবাই বিশ্বচরাচরের আলোয় আলোময় হয়ে গেয়ে উঠলো–
কতদূর আর কতদূর বলো মা….

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।