হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ৮)

চললুম ইউরোপ

একটা একটা করে দিন কমছে, কাউন্টডাউন শুরু ! আর তিনদিন..দুদিন…এক! তারপর….তারপর….
আমাদের সুহানা সফর…
সুইতজারল‍্যান্ড ! যা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি তা সত‍্যি হতে চলেছে। ক্রীসমাসের লম্বা ছুটিতে বাবা-মা কে নিয়ে লম্বা সফর আমার ছেলের প্রায় ন’দিন ধরে। ওর পাঁচবার ঘোরা হয়ে গেছে সুইতজারল‍্যান্ড , আমাদের তো আর হয়নি। চাপা উত্তেজনা অস্বীকার করতে পারছি না, মনে হচ্ছে
…….. হিমাঙ্কের নিচে ঐ অপরূপ দেশ আমাদের সইবে তো ! ‘ মা অত কি গোছাচ্ছ রোজ রোজ… কিছু ভুলে গেলে কিনে নেওয়া যাবে! তার চেয়ে বরং ইন্টারনেট সার্ফিং করে দেখে নাও কোন দেশে যাচ্ছ। ‘ তা তো ঠিক এবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে নেওয়াই ভাল। নিজের চোখে তো দেখবই , ক‍্যামেরার জোরদার চোখে একবার দেখে নেওয়া যাক! আগে তো শুধু জানতাম এটা ধনকুবেরদের দেশ আর কালো টাকার নিশ্চিন্ত ঠিকানা। ঐ চাঁদের কলঙ্কের মত আর কি ! জ‍্যোৎস্না যত মোহময় আর জগৎপ্লাবী হোক না কেন কলঙ্ক চাঁদের পিছু ছাড়ে না। চাঁদ আর কলঙ্ক তাই অঙ্গাঙ্গি হয়েই রইল। আসলে নির্ভেজাল শুদ্ধতা মানুষের বোধহয় ঠিক সয় না, একটু ভেজাল থাকলে বেশ আরাম হয় মনে। বন্ধুরা রেগে যাবেন না প্লীজ, একটু রসিকতা করলাম।

প্রকৃতি তাঁর রাজকীয় ট্রেজার দিয়ে সাজিয়েছেন এই দেশটা। দুগ্ধশুভ্র তুষার, সুনীল আকাশ, আশ্চর্য সবুজ ভ‍্যালি,অসাধারণ হৃদ কি নেই এখানে! আল্পসের সুউচ্চ শৃঙ্গ আর বিস্তার দিয়ে গড়া দেশের প্রায় ৬২ ভাগ অঞ্চল। আবহাওয়াও অতলান্তিক মহাসাগরের পরোক্ষ প্রভাবে আশ্চর্য অনুকূল। তার সঙ্গে ট‍্যুরিজমটাকে এরা অসাধারণ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমাদের দেশে তুষারমৌলী হিমালয় আছেন তাঁর দেবকান্তি ঐশ্বর্য নিয়ে কিন্তু সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অল্প কিছু মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের জীবন বাজি রেখে সেই ধ‍্যানগম্ভীর পর্বতের কাছে আসতে পারেন। এদেশে দেখলাম কি অনায়াসে ট্রেনে চড়ে দশ পনের হাজার ফুট ওপরে উঠে যাওয়া যাচ্ছে। বাইরে যখন মাইনাস ফাইভ তখন পনের ডিগ্রীর উষ্ণতায় বসে উপভোগ করা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বরফের রাজ‍্য। তবে দুঃখ দিয়ে যা জয় করা যায় তা নিঃসন্দেহে অমূল‍্য! সারা পৃথিবী থেকে অজস্র লোক আসে এখানে স্কি করতে। চমৎকার সুরক্ষা আর সাহায্য নিয়ে প্রস্তত থাকে এই দেশ।
চলুন, দেখা যাক চলতে চলতে আরও কি কি পাই আমরা!
২০ডিসেম্বর ২০১৯
আমরা রাত আটটায় Schipol এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। গন্তব‍্য জেনিভা। আপাতত এটা আমাদের গেটওয়ে টু সুইতজারল‍্যান্ড।
সময়মত এয়ারপোর্টে নামলাম এবং সংক্ষিপ্ত কেবিনলাগেজ নিয়ে চটপট ট্রেন ধরে শহরের মাঝখানে এলাম…. এয়ার টিকিটের সঙ্গে এই জার্নি ফ্রি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে তবে রাত হয়েছে তাই আর দাঁড়ানোর সময় নেই। হাল্কা চড়াই রাস্তায় হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম হোম স্টে । সারা জার্নিতে এই হোম স্টে গুলো সত‍্যি মুগ্ধ হওয়ার মত । মালিক অপেক্ষা করছিলেন চাবি নিয়ে। এবার আমাদের টেরিটরি! বেডরুম কিচেন আর টয়লেট মিলিয়ে একটা সেট। তবে রাত প্রায় এগারোটা, তাই…..।
পরদিন সকালে নিজেদের কিচেনে ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওয়ানা দিলাম। ট্রামে চড়ে প্রথমে ব্রোকেন চেয়ার দেখলাম। এটা একটা আশ্চর্য মনুমেন্ট! সাড়ে পাঁচ টন কাঠ দিয়ে তৈরি প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা চেয়ার যেন আকাশের গায়ে লটকানো আছে। একটা পা ভাঙা। একিরে বাবা এটার মানে কি? দেখলাম ঐ প্লাটফর্মে অনেক কিছু লেখা আছে।
আমি বসে পড়ে ওগুলো পড়তে লাগলাম দেখে বাবাই মুচকি হাসল। যুদ্ধে ল‍্যান্ডমাইন আর ক্লাস্টারবম্বের ভয়াবহ পরিণতি মনে করিয়ে দেওয়া আর তার বিরোধিতার ভাবনা নিয়েই এটার পরিকল্পনা। ল‍্যান্ডমাইন মাটির তলায় এক দশক পরেও কার্যকর থাকতে পারে আর সামান‍্য অসতর্কতা ডেকে আনতে পারে চরম ক্ষয়ক্ষতি। এটা যেন বলতে চায় অসামরিক সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচার বর্বরতা বন্ধ হোক।বিশ্বরাজনীতি আর হিংসার জঘন‍্য প্রদর্শনকে এ যেন অঙ্গুলিনির্দেশ করছে।
ইউনাইটেড নেশনসের হেডকোয়ার্টার এখানে। হেডকোয়ার্টার অফ রেড ক্রশ ও এখানে।

এসব দেখে আবার বাসে চড়ে স্টেশনচত্বরে এলাম। আমরা গাড়ি কনট্র‍্যাক্ট করে চললাম ‘ জেট ডি ইউ ‘দেখতে। বেশ খটমট নাম , কি আছে কে জানে। বিশাল এক জলাশয়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম। একটু হেঁটে গেটের দিকে যাচ্ছি বাবাই বলল দেখো এটা একটা সুইস ব‍্যাঙ্কের শাখা। একবার আড়চোখে দেখে নিলাম সেই বিখ‍্যাত বা কুখ‍্যাত ব‍্যাঙ্ককে। আমরা চললাম ফোয়ারা দেখতে…. আজ দিনটা খুব ঝলমলে। নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ তার মধ‍্যে দেখতে পেলাম একটা উড়ন্ত জলের পতাকা। জলের স্তম্ভ, জলের পতাকা আর তার গায়ে আঁকা এক আশ্চর্য রামধনু। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। রামধনু যে এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে আগে জানতাম না। একটা পাথরে বাঁধানো জেটি ধরে অনেকটা কাছে চলে যাওয়া যায় এই ওয়াটার জেট-এর।যত এগোচ্ছি চূর্ণ জলের ধোঁয়ায় ভিজে যাচ্ছি তবু মন্ত্রমুগ্ধের মত এগোচ্ছি। ছেলে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরল ‘ মা সাবধান পাথরগুলো শ্লিপারি হতে পারে। জানো তোমার মত আমিও খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন প্রথমবার দেখি তাই এর তথ‍্য জানতে গিয়ে দেখলাম এটা ট‍্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন‍্যে তৈরি হয়নি। এটা একটা হাইড্রোলিক প্ল‍্যান্ট। ইঞ্জিনিয়াররা দেখলেন এই প্রকান্ড ব‍্যবস্থায় যদি রিলিজ ভালভ না থাকে তাহলে জলের অসম্ভব চাপে পুরো ব‍্যবস্থাটা ভেঙ্গে পড়বে।’ এটা কবে তৈরি হয়েছিল রে?
‘1886 সালে প্রথমবার পরে রিলোকেট করা হয়। এটা কত উঁচু জানো… 140 মিটার। প্রতি সেকেন্ডে 500লিটার জল ছুঁড়ে দিচ্ছে এটা। বাতাসে সবসময় 7000 লিটার জল আছে এই ফোয়ারায়। প্রায় 10 কিলোমিটার ওপর থেকে এমনকি উড়ন্ত প্লেন থেকেও দেখা যায় এই ফোয়ারা। এটা সুইজারল‍্যান্ডের প্রাণশক্তি আর আশার প্রতীক।’ এই ফোয়ারাটা তার অসীম সৌন্দর্য নিয়ে মনে গাঁথা হয়ে রইল! কি গাঢ় নীল জল জেনেভা লেকের…. এত স্বচ্ছ যে নিচের ছোট বড় সব পাথর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল সাইজের রাজহাঁস। কি স্বর্গীয় পরিবেশ! ইচ্ছে করছে সারিদিন এখানে চুপ করে বসে কাটিয়ে দিই ! তবু যেতে তো হবেই,আবার ঘুরে সেই রামধনু আঁকা ফোয়ারা মনে এঁকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।