হৈচৈ গল্পে শুভ্র চক্রবর্তী

ভালো-মন্দ বিভ্রাট

ঢং ঢং ঢং ! শিবনাথপুর বয়েজ হাইস্কুলের থার্ড পিরিয়ড শেষ হলো। সারা স্কুল ছাত্রদের কলতানে মুখরিত। কোনো কোনো ঘরে ছাত্রদের মধ্যেই রেসলিং এর আখরা বসেছে আবার কেউ কেউ পরের পিরিয়ডের টিচার আসার আগের ক্ষণিকের সময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে মগ্ন।
ক্লাস টেনেরও একই অবস্থা। বাংলার শিক্ষক ওঙ্কারনাথ ব্রহ্ম বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে খুব জটিল বিশ্লেষণ ছাত্রদের বুঝিয়ে হাতের ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে টিচার্সরুমের দিকে চলে গেলেন।
চতুর্থ পিরিয়ডে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের অঙ্ক পরীক্ষা। পরীক্ষা মানে এমনি ক্লাস টেস্ট তবে অঙ্কের স্যার জটিলেশ্বর ভট্টাচার্য্য সামান্যতম বিচারও মারাত্মক বিচারের মতোই করেন।
এমনিতে অঙ্ক জিনিসটাকে এই ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলেই যে অপছন্দ করে তা নয়। শুধু মাত্র অঙ্ক বিষয়ের জন্য সারা স্কুলে দশম শ্রেণীর বেশ মান আছে। তবে ময়রা যদি ভালো মিষ্টি না বানাতে পারে তবে কলকাতার রসগোল্লাকেও লোকে ছি ছি বলবে। এখানেও একই অবস্থা। জটিলেশ্বরবাবু শেখানোর থেকে ছাত্রদের ধোলাই দেন বেশি। বিশেষ করে যদি কোনো ছাত্র কোনো কিছু জিজ্ঞেস করে।
” স্যার বুঝতে পারলাম না এটা ! ” একদিন বলেছিল অলোক। তার পর……
” কি হবে বুঝে তোর ? পুরো নম্বরতো পাবি না কোনোদিন। আর হাজারবার বোঝালেও তোর মাথায় ঢুকবে না। মাথায় তো গোবর ভরা………. ” ইত্যাদি বলে স্যার জিজ্ঞাসু ছাত্রদের দমিয়ে দেন।
আর সারা স্কুলে অঙ্কস্যারের মতো ষন্ডামার্কা চেহারা কারোর নেই। তাই জটিলেশ্বরবাবুকে দেখলেই ছেলেদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড় হয়।
ক্লাসের প্রায় সবাই স্যারের শরীর বা মাথা খারাপ হবার প্রার্থনা করে চলেছে ভগবানের কাছে । কারণ জটিলেশ্বরবাবুর দেওয়া প্রশ্ন আর ডিনামাইট বোমা একই ধাঁচের। দুটোই কার্যক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটায়।
জটিলেশ্বর ভট্টাচার্য্য ঠিক দুপুর একটা পনেরোয় এসে সবাইকে আগে উত্তর লেখার পাতা দিয়ে বোর্ডে শ্রেণীপরীক্ষার প্রশ্নগুলো লিখতে শুরু করলেন।
” নাও এবার সবাই লিখতে শুরু করো। ঠিক দুটোয় খাতা নেবো। ” বাজখাঁই গলায় বললেন স্যার।
ক্লাসের সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে দেখে স্যার জোর একটা হুঙ্কার ছাড়লেন।
” যে যে অন্যের খাতা দেখবি তারা আজকে বাড়ি না গিয়ে হসপিটালে যাবি, মাথায় রাখিস এটা !”
সবাই যে যার মতো করে যতটা পারে লিখে ঠিক সময়ে টেবিলে খাতা জমা দিয়ে দিলো। এবার টিফিন তাই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো।
” একে তো ক্ষিদেয় পেট চুঁচুঁ করছে আর তার ওপর আবার স্যারের ঐ রকম প্রশ্ন বাপরে বাপ ! ” খেতে খেতে বলল রণিত।
পরের দিন ক্লাসে এসে জটিলেশ্বর স্যার খাতা গুলি দিয়ে দিলেন সবাইয়ের হাতে। সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে বিমল। পঞ্চাশে এগারো। সবাই জানে এবার ওর কি অবস্থা হবে।
” এই! কে যেন এগারো পেয়েছিলি? এখানে আয় তো একবার! ” বললেন স্যার। বিমলও পায়ে পায়ে চলে গেলো টেবিলের দিকে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই স্যারের ওই গদার মতো হাতটা বিমলের গালে আছড়ে পড়ল।
” ব্যাটা, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার লোয়েস্ট নম্বর পেলি! লজ্জা লাগে না??” বলে আবার একনাগাড়ে চড় থাপ্পড় ঘুষি চলতে লাগলো।
ফার্স্ট বেঞ্চের ছেলেরা কিন্তু অসম্ভব ভাবে চেষ্টা করছে নিজেদের মধ্যে ” আমার কিন্তু বিমলকে এভাবে মার খেতে দেখে খুব দুঃখ হচ্ছে ” ভাব দেখাতে। কিন্তু মাঝে মাঝে ফেলিওর হচ্ছে।
স্যার বিমলকে প্রায় পঁচিশ মিনিট একটানা প্রহার করে বাইরের করিডোরে টেনে এনে ছুঁড়ে দিলেন।
” থাক্ বসে এখানে! ক্লাসে কোনোদিন ঢোকার চেষ্টা করলে আর আস্ত রাখবো না” বলে গটগট করে ক্লাসে চলে গেলেন। বিমলও গাধার মতো মার খেয়ে চুপ করে বসে আছে।
সে যে খুবই খারাপ ছেলে, পড়াশোনা একদম করে না তা কিন্তু নয়। ওকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস আর সংস্কৃততে কেউ টেক্কা দিতে পারেনি। এমনকি ফার্স্ট বয় অভিরূপও না। তবে অঙ্কতে ও বেশ কাঁচা।
” বাবা আজ ভালো লাগছে একটু ?? ” স্কুল থেকে ফিরে এসেই তার বাবার ঘরে গিয়ে প্রশ্ন করলো বিমল।
” হ্যাঁ রে বাবা! ঠিক আছি! অতো চিন্তা করতে হবে না। পা টা যেতে তুইই তো সব করছিস। এবার একটু ঘুমোতে যা তো দিকি! ” মিষ্টি হেসে বিমলের বাবা বলল।
একমাস আগে ওর বাবার একটা আ্যক্সিডেন্টে দুটো পাইই খোঁড়া হয়ে যায়। বিমলের বাবা রাস্তায় ফেরি করে ফল আনাজ বিক্রি করতেন । একদিন রাস্তায় ফল ফেরি করবার সময় একটা উন্মত্ত ট্রাক তার ফলের ভ্যান পাশ কাটাতে গিয়ে বিমলের বাবাকে ধাক্কা দিয়ে চম্পট দেয়। বিমলের বাবা বেঁচে গিয়েছিলেন ঠিকই তবে তাঁর দুটো পা ই অত্যন্ত জখম হয়েছিলো। তাই এখন এই দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের সম্বল শুধু বিমল ও তার মা। বিমলের মাকে ঘরের কাজে থাকতে হয়, বাইরের কাজ সেই এখন করে।
বিমল আজ স্কুলে এসেই আবার জটিলেশ্বর বাবুর সাথে সাক্ষাৎ।
” স্যার আপনার পকেট থেকে এইমাত্র এই মানি ব্যাগটা পড়ে গেছিলো, এই নিন।” হাসি মুখে বলল বিমল।
” ‘পড়ে গেছিলো না গায়েব করছিলি ? ব্যাটা একটা কিচ্ছু পারে না। আবার এসবে আছে। স্কুলে কি করতে আসিস?….” ইত্যাদি অনেক কিছু বলে খানিকটা প্রহার করে স্যারের শান্তি হতে বিমল ক্লাসে চলে গেলো।
কিছুদিন থেকে শিবনাথপুরের রাস্তা সংস্কারের জন্য বেশ অনেকগুলো ম্যানহোলের গর্তের ঢাকনা খোলা হয়েছিলো। সেখান থেকেই পচা নর্দমার গন্ধ বেরোচ্ছে। রাস্তার একধারে কত গুলো ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
আজ স্কুলের শেষে একসাথে বিমল, রণিত আর আলোক যাচ্ছে অভিরূপের বাড়ি তার সাথে, তার নতুন কেনা গোল্ডফিস দেখতে। প্রথমে বিমল রাজি হচ্ছিল না, কৌতূহলবশতঃ যেতে রাজি হল।
চারজনে গল্প করতে করতে এগোচ্ছিলো কিন্তু তাদের গল্প স্থায়ী হল না কারণ জটিলেশ্বরবাবু হন হন করে ওষুধের দোকানের দিকে যাচ্ছেন দেখে চার জনেই বেশ হতভম্ব হয়ে গেলো।
কিন্তু আসল ঘটনাটা ঘটলো ঠিক এরপরই .. জটিলেশ্বরবাবু হন হন করে হাঁটছেন আর ঠিক তখনই একটা ঘুড়ি এসে গোঁফতা খেয়ে স্যারের মুখে আটকে গেলো। আর স্যার তাল সামলাতে না পেরে থতমত খেয়ে পড়লেন সোজা সামনের ম্যানহোলের গর্তের ভিতর।
এখানে তো এই কাণ্ড দেখে অভিরূপ আর রণিত তো হেসেই সারা।
” যেমন স্যার পরীক্ষায় সবাইকে পাঁকে ফেলেন, এবার নিজে পড়েছেন। বেশ হয়েছে।” বলে হাসতে লাগলো অভিরূপ।
এদিকে বিমল ছুটেছে স্যারের কাছে। অন্যরা কেউ ঘেন্নায় আসেনি। স্যার পচা কালো পাঁকে সারা শরীর ভর্তি করে হাঁফাচ্ছেন আর হাঁফাচ্ছেন।
গর্তটা বেশ বড়ই ছিল। তাই বিমলের হাত পেলো না। তাই সে সোজা পাশের হার্ডওয়ার এর দোকান থেকে দড়ি চেয়ে এনে গর্তে ফেলে স্যারকে বললেন, ” স্যার, এই যে দড়ি দিলাম, ওপরে ওঠার চেষ্টা করুন।” কিন্তু স্যার তো মারাত্মক হাঁপাচ্ছেন । বিমলের ডাকাডাকিতে অন্য লোকেরা এলো।
বিমল আর অন্য সব স্থানীয় লোকেরা মিলে স্যারকে গর্ত থেকে তুলে আনলো। স্যারের নাকে মুখে কালো পাঁক ঢুকে গেছে। জটিলেশ্বরবাবু আস্তে আস্তে অসার হয়ে আসছেন।
” আমার মনে হয় স্যারের ইনহেলার দরকার! স্যারের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক বলেছো।” বাকি সবাই এই বলে ওষুধের দোকানে ছুটলো ইনহেলার আনতে।
প্রায় তৎক্ষণাৎই ইনহেলার এসে গেলো এবং জটিলেশ্বর ভট্টাচার্য্য একটু স্বস্তি পেলেন।
” স্যার এবার ভালো লাগছে। আমি আ্যম্বুলেন্স ডাকবো? আপনি এতো হাপাচ্ছেন কেনো? ” অধৈর্য ভাবে বিমল বললো।
” আঃ! থাক্ বাবা! থাক্! অতো কিছু করতে হবে না। আমি একটু ময়লাগুলো পরিস্কার করতে চাই। “
” স্যার আমাদের বাড়িতে চলুন। এই একটুখানি।” এই বলে বিমল স্যারের পাঁকমাখা হাতটা নিজের কাঁধের ওপর রেখে বাড়িমুখো হল।
” ওই রণিত তুই স্যারকে এদিক থেকে ধর তো একটু।” বলল বিমল।
” না বাবা আমি ওই নোঙরায় হাত দেবো না। আমার এখন কাজ আছে। আমি চললাম ।কাল দেখা হবে….. ”
বলে ওরা তিনজনে পালালো।
বিমল স্যারকে বাড়ি এনে বাথরুমটা দেখিয়ে দিলো। ওর মা বাড়ি ছিলো না। তাই সে স্যারের জন্য নিজের ভাগের দুধটা গরম করে ফেললো।
” স্যার এই নিন একটু দুধ খান। “একগাল হেসে বিমল ওঙ্কারনাথ বাবুর দিকে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।
” বিমল রে। আজ আমায় খুব বাঁচান বাঁচালি।” বললেন স্যার।
” স্যার, আপনি ওই ম্যানহোলের মধ্যে পড়লেন কি ভাবে? আপনি তো প্রায় গলা পর্যন্ত ডুবে গেছিলেন।” বলল বিমল।
” আরে বাবা জানিস তো আমার হাপানির সমস্যা আছে। আজ আবার বেশি কষ্ট হচ্ছিল।আজই আবার ইনহেলার আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্কুলের কাজের চাপে ভেবেছিলাম বাড়ি গিয়ে ইনহেলার নেবো কিন্তু হল না। শ্বাসকষ্ট হওয়ায় ভাবলাম সামনের দোকান থেকেই আমার ব্র্যান্ডের ইনহেলারটা কিনে নিয়ে নেবো। তাই তাড়াতাড়ি করে দোকানে যাচ্ছিলাম। ভুলে গেছিলাম যে এখন আবার রাস্তা খুলছে। ওটাই ভুল। পড়ে গেলাম একদম ম্যানহোলে। ” বললেন স্যার।
” ও। বুঝেছি। ”
” তোকে আমি সেদিন খুব মেরেছিলাম না রে? যাকে মারলাম সে আমাকে বিপদ থেকে বাঁচালো আর যাদের ভালোবাসতাম তারাই পালিয়ে গেল। কি অবস্থা। ”
” আজ এই ঘটনার থেকে অন্তত একটা শিক্ষা পেলাম। ” বললেন স্যার।
” কি শিক্ষা স্যার? ” জিজ্ঞেস করল বিমল।
” শুধু ভালো পড়াশোনা করলেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না। তোর অবস্থাটা বোঝা উচিত ছিলো। ” বললেন স্যার।
প্রিয় ছাত্রেদের কাছে এরূপ আচরণে স্যার বেশ মর্মাহত হয়েছেন। যে ছাত্রকে তিনি মেরেছেন নম্বর না পাওয়ার জন্য। যে ছাত্রকে শুধু শুধু দোষ দিয়েছিলেন। সেই ছাত্রই তাঁকে আজ এই দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করলো। উনি কিছুক্ষণ একভাবে বসে থেকে বিমলকে বললেন,
” চলি রে ! অনেক শাসন করেছিলামরে বাবা। এখন খুব দুঃখ হচ্ছে। স্কুলে দেখা হবে।”
স্যার এই বলে চলে গেলেন। বিমলের অদ্ভুত আনন্দানুভূতি কেন হচ্ছে তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।