গল্পবাজে ঋতব্রত গুহ (প্রথম পর্ব)

ট্রান্সফার

“ উফ বাঁচলাম ! এতদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম । অবশেষে স্বস্তি ! মুকুলিকা ! অর্ডার এসে গিয়েছে। আমি ফিরছি শিলিগুড়িতে । কি যে আনন্দ হচ্ছে । ” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল অয়ন । আনন্দিত হওয়ারই কথা । ট্রান্সফার টা অনেকদিন ধরে আটকে ছিল । অফিস ছাড়তে চাইছিল না অয়নকে । মুকুলিকা যে এখানে এসে থাকবে তার ও উপায় নেই । ওর চাকরি শিলিগুড়িতে । অবশেষে অনেক চেষ্টা করে সফল হল অয়ন । পরের মাসেই মুক্তি । ঝাড়খণ্ডের এই রুক্ষ জায়গাটি ছেড়ে অয়ন চলে যাবে পাহাড়ের কোলে । নিজের পরিবারের কাছে । এই আনন্দের তুলনা নেই । ওদিকে মুকুলিকারও আনন্দের শেষ নেই । এতদিন বাদে অয়ন আর সে একসাথে থাকতে পারবে ।

“ আচ্ছা ! আমি রাখছি । আজ অফিসে একটু আগে যেতে হবে । কিছু কাজ বাকি আছে । এমাসের মধ্যে শেষ করতে হবে । “

“ ঠিক আছে । সাবধানে থেকো ! “

কোয়ার্টার থেকে অফিস দশ মিনিটের হাটা পথ । ইন্ডাস্ট্রি এরিয়া হওয়ায় এই দিকটায় লোকজন বিশেষ বসবাস করেন না । যারা কোয়ার্টারে থাকেন তারাই মূলত থাকেন এই এলাকায় । সকাল বেলা জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে । বাইরের লোকের আসা যাওয়া থাকে । রাত হলে জায়গাটা একদম ফাকা হয়ে যায় । কোয়ার্টারে যারা থাকেন তাদের মধ্যে একটা সোসাইটি গড়ে উঠেছে । আজকে অন্যদিনের মত অফিস যেতে খারাপ লাগছে না অয়নের । মনে হচ্ছে জায়গাটা তো তেমন মন্দ নয় । ভালোই তো । হয়ত ট্রান্সফার টা হয়ে গিয়েছে বলেই এমনটা মনে হচ্ছে । অফিস যাওয়ার পথে বেশ কয়েকজন অয়নকে ট্রান্সফারের জন্য কনগ্রাচুলেট করল । ছোট জায়গা । কিছু ঘটলে খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে যায় । অয়নের ট্রান্সফারের খবরটিও ছড়িয়ে পড়েছে ।

আজ বেশ সকাল সকাল অফিসে চলে এসেছে অয়ন । এখনও তেমন কেউ আসেনি অফিসে । নিজের রুমে গিয়ে ইজি চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে দিল অয়ন । সকাল থেকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে অয়নের । কাল পর্যন্ত যে জিনিসগুলোকে একদম ভালো লাগত না অয়নের আজ হঠাৎ সেই সব জিনিসের প্রতি বড্ড মায়া হচ্ছে ওর । এই যেমন এই ঘরটা । এই ঘরেই তো গত তিনবছর দিনের বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে । ঘরটাতে আসতে বিরক্ত লাগত অয়নের । জানালা দিয়ে শুধু ফাকা জমি দেখা যায় । চারদিকে শুধু মেশিনের শব্দ । এমন ঘরে কি কাজে মন বসে ! কিন্তু আজ তেমনটা আর লাগছে না । এই ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসকে বড্ড নিজের বলে মনে হচ্ছে । মনটা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে ।

“ কি ভাবছ মিত্র ! ট্রান্সফারটা হল অবশেষে । গ্রেট নিউজ ! কনগ্রাচুলেশনস। “

সুদর্শন ঘোষ । অয়ন যখন প্রথম এখানে এসেছিল তখন খুব সাহায্য করেছিলেন ভদ্রলোক । সিনিয়র লোক । দুবছর বাদে রিটায়ারমেণ্ট ।

“ ধন্যবাদ ! “

“ মন খারাপ লাগছে ! লাগাটাই স্বাভাবিক । তুমি এ জায়গাটিকে তো বিশেষ পছন্দ করতে না । কিন্তু দেখবে জায়গাটি ছেড়ে যাওয়ার আগে দু ফোঁটা চোখের জল ঠিক ফেলবে । আসলে তিনটে বছর বলে কথা । এখানেই তো থেকেছ । নিজের অজান্তেই একটা আত্মিক টান তৈরি হয়ে যায় । এই অফিস , এই ধু ধু প্রান্তর , কোয়ার্টার গুলোকে কেন্দ্র করে ওঠা এই সোসাইটি সব কিছু দেখবে তোমার শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে । “

“ আপনি কিন্তু আজকাল চোখে দেখেই মানুষের মন দিব্যি পড়ে নিচ্ছেন ! “

“ কি করব রে ভাই ! যে টুকু অবসর পাই একটু লেখালিখি করবার চেষ্টা করি । মানুষের মন নিয়েই তো আমার কারবার । ভুল কিছু বলেছি ? “

মাথা নাড়ল অয়ন । ভুল কিছু বলেননি সুদর্শন । সত্যি একটু আনইজি ফিল হচ্ছে অয়নের ।

“ শোন যাওয়ার আগে একবার বিলাসের সাথে দেখা করে যেও ! তোমাকে তো ও ভগবান জ্ঞানে পূজা করে । “

বিলাসের কথা শুনে বুকটা হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল অয়নের । বিলাসের সাথেও তো আর দেখা হবে না । বিলাসের বাবার এই অফিসের পাশেই একটা ছোট চা এর দোকান ছিল । বিলাসও মাঝে মাঝে আসত বাবাকে সাহায্য করতে । বিলাসের বয়স এখন দশ । অয়ন প্রথমবার যখন বিলাসকে দেখে তখন থেকেই ছেলেটার ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছিল ওর । বিলাসের মা অনেক আগেই গত হয়েছেন । অয়ন এখানে আসার মাস তিনেকের মধ্যে বিলাসের বাবাও মারা যান । স্বাভাবিকভাবেই বিলাস আর দোকান টা ধরে রাখতে পারে নি । বাহুবলিদের উপদ্রব এখানে বড্ড বেশি । ওরাই সবটা নিয়ন্ত্রণ করে । কোন প্রতিবাদ করা যায় না । বিলাসের বাবার দোকান টা ভেঙে সেখানে একটি এসি রেস্টুরেণ্ট হয়েছে । বিলাসের দুরবস্থা দেখে অয়ন বিলাসকে একবার কোয়ার্টারে ডেকে পাঠিয়েছিল । ছেলেটার মধ্যে যে একটা প্রবল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সেটা আঁচ করতে অসুবিধে হয় নি অয়নের । পড়াশোনায় খুব ভালো বিলাস । অয়নের মনে হয়েছিল বিলাসের জন্য কিছু করা উচিত । সেই থেকেই বিলাসের পড়াশোনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে অয়ন । বিলাসও অয়নকে নিরাশ করেনি । প্রতিবার সে ক্লাসে ফার্স্ট হয় । মন দিয়ে পড়াশোনা করে । কোথাও কোন ফাকি নেই । কিন্তু অয়ন চলে গেলে কি পরিস্থিতি একই রকম থাকবে ! ও যেখানে থাকে সেখানে পড়াশোনার পরিবেশ নেই । বিপথে যাওয়ার প্রলোভন বড্ড বেশি । কাল থেকে বিলাসের কথা সে একবারও ভাবেনি । নিজেকে অপরাধী মনে হল অয়নের । বিলাসকে কেন্দ্র করে একটা গাঢ় দুশ্চিন্তা গ্রাস করল অয়নকে ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।