।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় তমাল চক্রবর্ত্তী

এক মহাপুরুষ ও একটি শব্দ

বিজ্ঞান হোক বা আধ্যাত্ম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় সৃষ্টিতত্ত্বের উপর। সৃষ্টির ঊষা লগ্নে মানুষ পৃথিবীতে কখন এসেছিলো; কিভাবে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হলো তা কারো জানা নাই। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর খোঁজ করে চলেছেন এই মহান সত্যের ; বৈদিক কাল থেকে ভারতীয় ঋষি রাও এই চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন। সৃষ্টিতত্ত্বের দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয় থাকে তা হল শব্দ । ভারতীয় দর্শনের সর্বোচ্চ গ্রন্থ বেদ , যা আধ্যাত্মিক শব্দরাশিরই সংকলন। বৈদিক কালে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে বৈদিক মন্ত্র প্রকাশ করতেন। পবিত্র ওম কার ধ্বনিকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বলা হয় শব্দব্রহ্ম। ব্রহ্মকেও শব্দের মধ্য দিয়ে জানা যায়। আমরা যখন জগতের যেকোন বস্তু চিন্তা করি, তার অভিব্যক্তি হয় শব্দ দিয়ে। বস্তুটি স্থূল, কিন্তু তা ভাব যখন, তখন তা সূক্ষ্ম। তাই শব্দবিদ্যাশাস্ত্র মহাভাষ্য – এর রচয়িতা ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন ,
” একঃ শব্দঃ সম্যগ জ্ঞাতঃ – সুপ্রযুক্তঃ স্বর্গে লোকে কামধুগ্ ভবতি ” অর্থাৎ একটিমাত্র শব্দকে সুষ্ঠ ভাবে প্রয়োগ করতে পারলেই অভীষ্ট লক্ষ্য পুরন হয়। একটি শব্দ কিভাবে একটি মানুষকে মহাপুরুষের স্তরে উন্নীত হতে সাহায্য করে তাই আলোচনা করব।
সালটা ১৮৮০ কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশনে ক্লাস নিচ্ছেন অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি, পড়াচ্ছেন প্রকৃতি প্রেমিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দ্য এক্সকারশন কবিতাটি।
কবিতায় এলো একটি শব্দ ‘trance’; বাংলাতে যার অর্থ সমাধিস্থ অবস্থা । কৌতূহলী ছাত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত এর সঠিক ব্যাখ্যা চাইলো বারবার। জানতে চাইলো ঠিক তখন কি অবস্থা হয়, সাধকের বাহ্যজ্ঞান কি লোপ পায় ! সেই সময় বহির প্রকৃতির সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ থাকে ! এইসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলেন না অধ্যাপক।অধ্যাপক বুঝেছিলেন এ ছাত্র যে সে নয়! তিনি লিখেছেন, “নরেন্দ্র সত্যিকারের মেধাবী। আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি; এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন ছাত্রদের মধ্যেও না।”
তাই তাঁর বিদগ্ধ ছাত্র নরেন্দ্রনাথকে দিলেন পথের সন্ধান, বললেন দক্ষিণেশ্বরের পূজারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে, সেখানে গেলে এই শব্দের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখা যাবে । প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে কিভাবে থাকা যায়, যাতে সমান্য তৃণভূমির কষ্ট তাঁর বুকে অনুভূত হয়। অধ্যাপকের কাছ থেকে এই সুলুক সন্ধান পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের সাক্ষাৎ হলো। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পূর্ণতা প্রাপ্তি হল নরেন্দ্রনাথের সকল জিজ্ঞাসার। বাস্তবে নরেন্দ্রনাথ দেখলেন ঐ শব্দের প্রকৃত অর্থ। শব্দের স্থূল রূপ প্রকাশ ফেলো শ্রীরামকৃষ্ণের মাধ্যমে। শুধু তাই নয় সেই গুরু হাতে ধরে নরেন্দ্রনাথ অনুভূতি করলেন সমাধির জগত। নরেন্দ্রনাথ এর কাছে খুলে গেল অন্তর্জগৎ এর মাধ্যমে বহির্জগৎ কে জানার পথ। সমাধি রহস্যের বাস্তব সমাধান পেল নরেন্দ্রনাথ, যা তাকে নিয়ে গেল আধ্যাত্ম জগতে, তিনি হয়ে উঠলেন স্বামী বিবেকানন্দ। একটি শব্দ কিভাবে একটি মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে পারে, কিভাবে তাকে নতুন পথের দিশা দিতে পারে, তা উপরের ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি। এই ‘trance’ শব্দটি মিলিয়ে দিল প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বর সত্তা দেখতে পাওয়া ওয়ার্ডসওয়ার্থের ও অন্তর প্রভৃতির মাধ্যমে বহির প্রকৃতিকে জানার স্বামী বিবেকানন্দ কে। তাই ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রিলিউডের লেখাতে যে সর্বেশ্বরবাদ দেখা গেছে তা বিবেকানন্দের Practical Vedanta এর সঙ্গে অনেকখানি সাদৃশ্য রয়েছে। শাস্ত্রে আছে
” বাগ্ বৈ ব্রহ্ম ” অর্থাৎ শব্দের মধ্যেই ব্রহ্ম আছেন। সেদিন সামান্য একটা ক্লাসে অধ্যাপক হেস্টি তাঁর
ছাত্র শ্রুতিধর নরেন্দ্রনাথকে একটি শব্দের ব্যাখ্যার পথ ধরে ব্রহ্মানুভূতির পথ দেখিয়েছিলেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।