সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৪৪)

দেবমাল্য

নয়

রিসেপশন থেকে চাবি নিতে গিয়ে দেবমাল্য শুনল, তার বউ এসেছে। অনেকক্ষণ আগেই চাবি নিয়ে ওপরে গেছে। শুনেই তার শরীরে যেন শক্তি বেড়ে গেল। একটা নয়, একসঙ্গে দুটো-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে টপকে দোতলায় উঠে গেল ও। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল তানিয়া। দেবমাল্যকে দেখামাত্র যেন তুবড়িতে আগুন পড়ল। ছিটকে বেরোতে লাগল এতক্ষণ ধরে জমা একরাশ অভিমান— কোথায় ছিলে? আমাকে স্টেশন থেকে  আনতে যাওয়ার কথা ছিল না তোমার? ফোনটাকেও অফ করে রেখে দিয়েছ। কোনও যোগাযোগ করতে পারছি না। সামশেরকে ফোন করলাম, সেও বলল, তোমাকে নাকি পাচ্ছে না। তুমি কি জানো না, এর আগে আমি কখনও এখানে আসিনি? এখানকার কাউকেই আমি চিনি না। তাও কোনওরকমে হোটেলে এলাম। এসে শুনি, তুমি ভোরবেলায় বেরিয়ে গেছ। কোথায় গিয়েছিলে?

দেবমাল্য কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তানিয়া এমনভাবে ঝাঁঝি মেরে উঠল, ও চুপ করে গেল। তানিয়ার এই রূপ এর আগে ও কখনও দেখেনি। আঙুল তুলে তানিয়া বলল, একটি কথাও বলবে না। একদম চুপ। তুমি যা করেছ, অত্যন্ত খারাপ করেছ। সেই সকাল থেকে টেনশনে টেনশনে… তুমি জানো, একা একটা মেয়েমানুষ আসছি। কত রকমের বিপদে পড়তে পারি। তুমি জানো কী হয়েছিল?

— কী হয়েছিল?

— এতক্ষণ যখন আমার কথা মনে পড়েনি, আর শুনতে হবে না।

— আমি তো স্টেশনেই গিয়েছিলাম।

গলা চড়াল তানিয়া। তুমি স্টেশনে ছিলে? এতক্ষণ?

— তোমাকে না পেয়ে থানা-পুলিশ-প্রেস, একটার পর একটা জায়গায় গেছি, জানো?

— তুমি স্টেশনের কোথায় ছিলে?

আমতা আমতা করে দেবমাল্য বলল, তোমার যে কোচে করে আসার কথা ছিল, আমি তো সেই এস ফোরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

— তা হলে ট্রেন থেকে নেমে তোমাকে দেখলাম না কেন?

— তুমি কখন নেমেছ?

একটু দমে গেল তানিয়া। বলল, আমি তো ঠিক সময়েই নামতাম। তা ভাবলাম, হোটেলটা কত দূরে, ট্রেন থেকে নেমে কতটা পথ যেতে হবে, কে জানে! একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। আর সেটাই হল কাল।

— কেন? কী হয়েছিল?

— টয়লেটে গিয়ে দেখি ছিটকিনি তো নেই-ই, লকের মতো যেটা থাকে, ঘুরিয়ে দরজা় আটকায়, সেটাও নেই। কিন্তু দরজা খোলা রেখে তো আর টয়লেটে যাওয়া যায় না। আর অন্য টয়লেটে যে যাব, তারও উপায় নেই। প্রত্যেকটা টয়লেটের সামনেই তিন-চারজন করে দাঁড়িয়ে। সেখানে গিয়ে লাইন দিলে আমার আর টয়লেটে যাওয়া হবে না। কী করি! দরজা ভেজিয়ে রেখে তো আর যাওয়া যায় না। হাজার রকমের লোক ঘোরাঘুরি করে। এদিকে তার একটু আগেই আমি দাঁত ব্রাশ করেছিলাম। হাতে ছিল দাঁত মাজার সেই ব্রাশটা। আমি ওটাই দরজার ফ্রেমের খাঁচে ধরে গায়ে যত জোর ছিল দরজাটা ঠেলে আটকে দিয়েছিলাম। দরজাটা তো আটকেছিল। কিন্তু খুলতে গিয়ে দেখি কোনও হাতল নেই। কী ধরে টেনে খুলব! দরজাটা তো একদম চেপে বসে আছে। তাই দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। যদি কেউ শুনতে পেয়ে বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয়! কেউ শুনতে পেয়েছিল কি না জানি না। শুনলেও, হয়তো নামার জন্য সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই এ দিকে কান দেয়নি। দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ হয়ে গেল।  অবশেষে নিজেই টানা-হ্যাঁচড়া করতে লাগলাম। কোনও লাভ হল না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার মানে বহরমপুরে এসে গেছে। আমাকে এক্ষুনি নামতে হবে। যত রকমভাবে পারা যায় আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। ব্রাশটাকে ধরে টানাটানি করলাম। কিন্তু কিছুতেই বের করতে পারলাম না। কী করা যায়! যখন ভাবছি, দেখি ট্রেনটা দুলে উঠেছে। আন্দাজ করলাম, ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে। আমি জানতাম, তুমি স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছ। আমাকে না দেখলে চিন্তা করবে। তাই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তোমাকে ফোন করলাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।