• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১৪)

আমার মেয়েবেলা

জন্মানোর পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই যে ছোট্ট সময়, সে শুধু একান্তই আমাদের। আর এই সময় টাই হল জীবন। একে কিভাবে যে কাটাব, কিভাবে যে এগিয়ে নিয়ে যাব, আমরা ভেবেই কুল পাই না।
জীবনে গড়গড়িয়ে যেমন সুখ আসে, তেমনভাবেই অকস্মাত্ আসে দুঃখ। আনন্দ নিরানন্দ, শান্তি অশান্তি ঝড়ঝঞ্ঝা নিয়ে তৈরি হয় কমপ্যাক্ট একটা জীবন। এগুলো যেন এক একটা পর্ব। একটা পর্ব শেষ হলে আর একটা এসে পরে। যেন এক একটা নাটকের দৃশ্য। পরপর সব ঠিক করা আছে। তুমি শুধু রঙ্গমঞ্চে টিঁকে থাক।
তাই যে যত সুন্দর এবং নৈপুণ্যে এই পর্বগুলোকে সামলাতে পারবে। তার জীবনও তেমন তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে।
ছোট বেলা থেকেই প্রচুর ঝড় সামলেছি। এখনও সামলাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা কত বড়ো! তবে ছোট বেলার ঝড়গুলো এখনকার ঝড়ের মতো ছিল না। এখনকার ঝড় সামলাতে গিয়ে বড্ড দুর্বল হয়ে পড়ি। সেই প্রাণশক্তিটাই যেন আর পাই না।
######
ছোট বেলায় ঝড় উঠলেই আম কুড়োনোর ধুম পড়ে যেত। পাকা দু চারটে ফল টুপটাপ বাগানে পড়লেই ছুট ছুট। খুব ভালোবাসতাম ঝড় দেখতে। তবে মা খুব ভয় পেত। ঝড় উঠলেই দরজা জানলা বন্ধ করে আমাদের দুই ভাই বোন কে চেপে ধরে বসে থাকত। যত বড়ো হয়েছি ততই ঝড়ের বিভিন্ন রূপ দেখেছি। প্রতি বারই প্রকৃতি যেন তার রাগ বিদ্বেষ উগড়ে দিয়েছেন। তছনছ করে দিয়েছেন আমাদের সমাজ জীবন। কিন্তু মনের ঝড়ও তো আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে, সেই ক্ষত,,, যা কোনও দিন সারে না। যে ক্ষত থেকে প্রতি নিয়ত চুঁইয়ে পড়া পুঁজ রক্ত আমাদের মনে পচন ধরায়। তারসঙ্গে জীবনেরও।
##
এখন মহালয়া আসার আগেই মনের ভেতর ঝড় শুরু হয়। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা মন কে যেন তাড়া করে। মহালয়ার দিন বড্ড কষ্ট হয় আমার। কোনও ভাবে দিনটাকে আমি কাটিয়ে দি অথচ একসময় মহালয়ার দিন থেকেই আমার পুজোর মেজাজটা শুরু হয়ে যেত। মনের ভেতর যেন ঘুঙুর বেজে উঠত।
চারিদিকে একটা পুজো পুজো গন্ধ। যেমন নতুন জামা, জুতো, নতুন বিছানার চাদর, নতুন পর্দার গন্ধ, বাবার নতুন লুঙ্গির গন্ধটাও দারুণ ছিল, তেমনি নারকেল নাড়ু, নিমকি, গজা আর ঝুরিভাজার গন্ধে চারিদিক ম ম করত। সব বাড়ি থেকেই গন্ধ পেতাম। আমাদের সময় বিজয়ার প্রণাম ছিল, বড়োদের থেকে আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়া ছিল, কোলাকুলি ছিল। ভালোবাসার গন্ধ ছিল। কেমন যেন আপনত্বের টান ছিল। বিজয়া করতে গেলে বাড়ির তৈরি খাবারই দেওয়া হত। আমরা ঠিক অতিথি ছিলাম না। অতিথির থেকেও বড়ো কিছু ছিলাম। অতিথি কথাটার মধ্যে তো কোন আপনত্বের গন্ধ থাকে না।
তাই কোনও কেনা খাবার চলতই না। ঠাকুমা কাকিমা জ্যেঠিমাদের হাতের তৈরি খাবারই অমৃত মনে হত।
আসলে সে খাবারে মা কাকিমাদের হাতের ছোঁয়া থাকত যে! একটা ভালোবাসার গন্ধ থাকত, মুখের হাসি মেশানো ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের কষ্ট থাকত , মনের তৃপ্ততা থাকত, কত আপনত্ব ভালোবাসা টের পেতাম এক একটা নাড়ুতে। পাড়ার কাকিমার দিকে চেয়ে দেখতাম নাড়ু খাওয়ানোর আনন্দে সব কষ্ট যেন ঘাম হয়ে ঝড়ে পড়ত। আঁচলে মুখটা মুছে বড়ো বড়ো চোখ করে বলত ভাল হয়েছে রে? আর একটা নিবি? আমি ক্লান্ত ঘর্মাক্ত ঘেঁটে যাওয়া সিঁদুরের টিপের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ইচ্ছে হত কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে, গেঁটে যাওয়া টিপটা ঠিক করে মুছে, আদর করে বলি তুমি ভাল থেক কাকিমা, অনেকদিন সুস্থ হয়ে বেঁচে থাক। খুব সুন্দর খেতে হয়েছে নাড়ু। আর আমাকে এমন ভাবেই খুব ভালবেসো, সারাজীবন।
বিয়ের পর আর কোনো দিন আমার আর বিজয়া করতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু বিজয়ার দিন সন্ধ্যায় কে যেন কানের কাছে গুনগুন করে,,,
“মামনি— আর দুটো তিলের নাড়ু নে না রে, তুই তো তিলের নাড়ু খেতে খুব ভালোবাসিস।”
সে এক বিজয়া ছিল বটে। পেট ভরে থাকত কদিন। রাতের খাবার খেতামই না। প্রণাম করতে যাওয়া মানে দারুণ আনন্দ। নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, ছিঁড়ের নাড়ু কিছুই বাদ থাকত না। কত খেলা হত গল্প হত। মা বাবারা গল্প করত আর আমরা লুকোচুরি খেলতাম। আর আমার আবার প্রধান আকর্ষণ ছিল বন্ধুর খাটের তলায় পুতুলের সংসার দেখে নেওয়া। বিয়েও ঠিক করে আসতাম। পুজোর পর মানে কালীপুজো ভাইফোঁটা পার করেই আমাদের অ্যানোয়াল পরীক্ষা শুরু হত। পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে দেব কথা দিয়ে আসতাম।
যা বলছিলাম, সেই মহালয়ার দিন সবার মনেই থাকত ফুরফুরে আনন্দ। খুশি খুশি একটা ব্যাপার।। আমাদের সময়ে পরীক্ষা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি ছিল না। তাই পুজো টা আমরা খুব ভালো করেই এনজয় করতাম।প্রতিবছর মহালয়ার দিন বাবা দিনটার তাতপর্য বোঝাতে বসত —
‘ বুঝলি মামনি, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় দেবী পক্ষ। আর দেবীপক্ষের সূচনায় প্রথম যে অমাবস্যা সেই দিনই হয় মহালয়া। এদিন হিন্দুরা তর্পণ করেন তাঁদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।’ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
এই রকমই একটা দিনে তর্পণ করতে গিয়ে বাবার এক বন্ধু মহাদেব রায় গঙ্গায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপর থেকে মহালয়ার দিন মহাদেব কাকুর জন্য মনটা একটু খচখচ করত। এখনও করে।
এখন বাবা মা কেউ নেই। আমারও খুব ইচ্ছে হয় তর্পণ করি। একটু তিল গঙ্গাজল দিয়ে ওদের আত্মাকে শান্তি দি। ভাই চলে যাওয়ার পর দিনরাত ওদের ভেতরটা যেভাবে আগুন জ্বলেছিল, তার আঁচও তো আমি টের পেতাম প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। একটা যেন কিসের ছটফটানি। দেখতাম বাবা ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ উঠে বুকে হাত বুলিয়ে বলছে একটু জল দে তো, বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। দুজনেই ভাই এর কষ্টে এক অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে শেষ হয়ে গিয়েছিল। না হলে এত তাড়াতাড়ি কেউ চলে যায়! কোনও অসুখ তো ছিল না বাবার! ইচ্ছে করে,,, খুব ইচ্ছে করে আমি গঙ্গায় গিয়ে, মনে হয় একটু নমস্কার করে জল দিয়ে যদি ওদের বুকের জ্বালাটা কমাতে পারি! আমি জানি না মরণের পর কি হয়, কোথায় যায় কেমন থাকে?
কিন্তু হিন্দু ধর্মের কিছু নিয়মনীতি আছে। মেয়েরা তর্পণ করতে পারবেনা। গয়ায় পিণ্ডদান করতে পারবে না। বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েরা। জামাই করতে পারবে, অদ্ভুত ব্যাপার মেয়ে করতে পারবে না। এতসব নিয়ম কানুন জানা ছিল না তাই আমাকে এবং আমার এক বান্ধবীকে গয়ার টিকিট কেটে হোটেল বুক করেও ক্যানসেল করে দিতে হয়েছিল। গয়ার এক পণ্ডিতের কথায়–বাবা মার কাজ করলে স্বামীর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কি অদ্ভুত সব নিয়ম! কী রাজনীতি! কুসংস্কারের জালে মেয়েদের শুধু কুঁয়োর জলের মতো আবদ্ধ রাখা।
আমার শ্বশুর বাড়ির ঠাকুর মশাইকে বলেছিলাম আমার ইচ্ছের কথা। কিন্তু উনিও বললেন মেয়েদের তর্পণ করতে নেই।
আমি তর্পণ করলে যদি শ্বশুর বাড়ির কোন ক্ষতি হয়,, তাই ইচ্ছে থাকলেও পিছিয়ে এসেছি। সংসারে সবাই ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক, আর কী চাই?
তবে এখন একটু উদার হয়েছে আমাদের ধর্ম। তাই বাবা মার মৃত্যুর পর শ্মশানে মুখাগ্নির কাজটা করতে পেরেছিলাম। মেয়ে দের শ্মশানে যেতে নেই। দু দুবার শ্মশানে গিয়ে আমারও মনে হয়েছে সত্যিই মেয়েদের শ্মশানে যাওয়া উচিত নয়। সহ্য করা খুব কষ্ট যে। প্রসব যন্ত্রণার থেকেও ভীষণ, ভীষণ কষ্টকর। তাইতো আমি প্রসব যন্ত্রণা ভুলে গেলেও বাবা মার মুখাগ্নি করার যন্ত্রণা আজও ভুলতে পারলাম না।
তবে প্রতি বছর মহালয়ার দিন হাত জোর করে ওদের ছবির সামনে বলি —
পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমংতপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্ব্ব দেবতাঃ নমঃ পিতৃ চরণেভ্য নমঃ।
ভূমেগরীয়সী মাতা স্বর্গাৎ উচ্চতর পিতা জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী। গর্ভ ধারণ্যং পোষ্যভাং পিতুমাতা বিশ্বস্তে।

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।