গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী (পর্ব – ৮)

নীল সবুজের লুকোচুরি

… তবে হসপিটালে জয়েন করার আগে অবশ্যই একদিন তোমার কাছে খেতে আসব।
__” আচ্ছা, তাই আসিস বাবা।

সুমিতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আয়ান গাড়িতে উঠল। সুমিতাও সাথে উঠল। আয়ানকে ওর বাড়িতে পৌঁছে সুমিতা গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে।
আয়ান এবার স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল গ্রামের মন্দিরের পথে। সুমিতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আয়ান হেসে বলল,” তোর সাথে কথা আছে। আর সেটা এখনি না বললে আমি শান্তি পাবো না।”

সুমিতার বুকের মধ্যে যেন হাপড় টানছে কেউ। হঠাৎ যেন বুকের ধুকপুকুনিটা বেড়ে গিয়েছে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরেছে ওকে। কতশত না বলা কথা যেন বাসন্তী রংয়ের সাজে সেজে উঠেছে। মনের রঙিন প্রজাপতিগুলো ডানা মেলে দিয়েছে। এবার হয়ত ওর ভালবাসা একটা পরিনতি পাবে। এতদিনের লুকিয়ে রাখা ইচ্ছেগুলো যেন বাঁধনহারা হতে চাইছে। তবুও নিজের মনকে নিজেই খুব শাসন করছে যেন কিছুতেই অবাধ্য না হয়ে যায়। মনে মনে ঠিক করে নিল যে আজ ও মিঠির কথা আয়ানকে বলবে। সুমিতার জীবনে আয়ানের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। ওদের ভালোবাসার ফুল মিঠি যাকে সুমিতা লুকিয়ে রেখেছে অতি সাবধানে সুদুর দার্জিলিংয়ে মাদার মারিয়ার কাছে।

আয়ান বড় পুকুরের পাড়ে মন্দিরের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নেমে গেল। সুমিতাও নেমে এসেছে গাড়ি থেকে। ঘাটের পাড়ে বাঁধানো সিঁড়িতে বসে সুমিতাকে পাশে বসতে ইশারা করল। মনে একরাশ প্রশ্ন আর চোখেমুখে স্বপ্নপূরণের উজ্জ্বলতা নিয়ে সুমিতাও বসে পরল।

আয়ান ওর হাতটা ধরে নিজের গালে ছোঁয়াল আর ঠোঁটের পরশ দিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “কত বছর পর তোকে দেখছি। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তোকে জানিস। একটা আলাদা সৌন্দর্য যেমন মায়েদের হয় ঠিক তেমন লাগছে তোকে। ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে আজ তোকে। কি জানি হয়তো অনেক দিন পর দেখলাম বলে এরকম মনে হচ্ছে। যাকগে, যে কথা বলতে এখানে নিয়ে এলাম তোকে সেটা বলি এবার। কথা দে, আমায় ভুল বুঝবি না। আসলে
তোর কাছ থেকে দুরে গিয়ে বুঝেছি ভালবাসার মানুষ সাথে থাকা কতটা প্রয়োজন। তাহলে সাময়িক দুঃখকষ্টগুলো নিজে থেকেই দূর হয়ে যায়। তোকে খুব মিস করেছি জানিসতো।”
সুমিতা চোখেমুখে একটা লাজুক হাসি সাজিয়ে রেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মনে মনে ভাবছে এই কথা বলতে এখানে আসার কি দরকার ছিল!

আয়ান সুমিতার হাত দুটো ধরে রেখেই বলে চলেছে, “সেদিনের ঘটনার পর আমার তোকে ছেড়ে কিছুতেই যাবার ইচ্ছে ছিলনা। তবুও তোর কথাতেই যেতে হল। এখানে তুই একলা আর সুদুর লন্ডনে আমি। মানসিকভাবে ভীষণ একা হয়ে পরেছিলাম। কোনো কাজেই মন বসত না। সে এক অস্থির সময় গেছে। সেইসময় সাহানা আখতারের সাথে পরিচয় হয়। সাহানা দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স থেকে পাশ করেছে, ওখানে আমরা একসাথে কাজ করছিলাম। এক দেশ, একই কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড বলে বন্ধুত্ব হতেও দেরি হলনা। ওই অচেনা অজানা দেশে ও’সাথে ছিল বলে লাইভলিহুডে অনেক সুবিধা হয়েছিল।
ও আমার খুব খেয়াল রাখত। কখনও আমার মন খারাপ লাগলে ও খুব সুন্দরভাবে কায়দা করে জেনে নিত। তোর কথা, যাবার আগে আমাদের দুজনের মিলনের কথা, সব ওকে বলেছি। শুনে বলেছে, “এই লায়ন হার্ট” লেডির সাথে নিশ্চয়ই কখনও দেখা হবে। আমার অনন্ত শুভেচ্ছা রইল ওর জন্য।”
তোর ওপর ওর এরকম একটা ফিলিংস দেখে খুব ভালো লাগত। সবসময় ঠিক তোর মতো করে আমায় আগলে রাখত। ধীরে ধীরে আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম। ও কাছে থাকলে আমার তোকে পাবার ইচ্ছে হতো। এরকমই কোনো এক দূর্বল মুহূর্তে আমরা এক হয়ে যাই।
তোর হয়তো খারাপ লাগছে। কিন্তু তোর কাছে সত্যিটাকে গোপন রাখতে চাইনা আমি। আর অন্যের কাছ থেকে শুনে তোর খারাপ লাগতে পারে। তাই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে তোর সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিনই আমি সবকথা খুলে বলবো তোকে। তোর আমার মধ্যে কোনো লুকোচুরি থাকাটা উচিত নয়। আর হ্যাঁ,যেটা সবথেকে বলাটা জরুরী সেটা হল আমাদের দুবছরের একটা ছেলে আছে।”

আসছি পরের পর্বে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।