গদ্যানুশীলনে সুদীপ ঘোষাল

বৃষ্টিভেজার দিন ও সনাতন কাকা

আমি আর আমার পাড়ার বন্ধু, ছোটবেলায় বর্ষাকালে বৃষ্টিভিজতে বেরিয়ে পড়তাম লুকিয়ে।

,মা বলতেন, ওরে ভিজিস না। ঠান্ডা লেগে যাবে বাবা।
– না, মা আমরা একটু পরেই চলে আসব।
তারপর ঝরঝর ধারায় বৃষ্টি ভিজিয়ে দিত কিশোরমন।
বন্ধু অপু বলত, আয় এবার সবুজমাঠের পুকুরে বৃষ্টির দাপট দেখি।
এক অনাবিল আনন্দে ছাদের নল থেকে যে জলধারা পড়ত,তারতলে পেতে দিতুম মাথা।
অপু বলে তোর মনে পড়ে,স্কুলে যাওয়ার সময়, শিলাবৃষ্টি হলে স্কুলপোশাকের ফাঁকগলে ঢুকে পড়ত শীতল আদর।ডাগর বৃষ্টিদুপুরে ভিজে যেত মানসপট।
আমি বলি,এখনও ছোটবেলার বৃষ্টিফোঁটা খুঁজে বেড়াই আমার ছোট ছোট ছাত্রদের ভিড়ে, বৃষ্টির দিনে তাদের খুশিমন দেখে।
অপু বলে,ছেলেবেলার বৃষ্টিভেজার দিনগুলোর স্মৃতি, ভুলিয়ে দেয় নানা দুশ্চিন্তার ভয়..

দাদু বলতেন,সেই কবে থেকে দ্যাশের যত মড়া, মরলে এই পুকুরের পাড়ে মুখে আগুন দিতে হত, জানিস তোরা,?
– কবে থেকে গো কাকা?
– তোর দাদুর দাদু তার দাদুর আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে।তখন রাস্তা ছিল না শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্যে।
– ও, তাই বুঝি এখনও এই নিয়ম চালু আছে।
– হ্যাঁ ঠিক তাই। এই পুকুরের পাড়ে কাজ সেরে নদীর গাবায় পুড়িয়ে দিত মরা কে।

গ্রামের খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষগুলো এখনও বিশ্বাস করে এই পুকুরের পাড়ে রাতে ভূত নামে। যারা মরে যায় তাদের মধ্যে অতৃপ্ত আত্মাগোলা এইখানে পাক খায়, ঠিক গোলার বাঁধুনির মতন।
আশেপাশে বাউরিপাড়ার বৌ ঝি রা সকাল থেকে এই পুকুরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা,স্নান সব করলেও রাতে এই পুকুরের জল তারা তুলে রাখে।ভুল করেও কেউ রাতে জলে নামে না।

সনাতন কাকা বলতেন,একবার এক ডাকাবুকো ছেলে সাহস করে এই পুকুরের জলে রাতে নেমে আর উঠতে পারে নাই গো। পুকুরের গভীরে তেনাদের শেকলে বাঁধা পড়ে মরে গেয়েচে জলে ডুবে।
এইরকম কতকাহিনী যে প্রচলিত আছে কেউ জানে না। গাঁয়ের বুড়ো,বুড়ি যারা আছেন তারা কিছু কিছু জানেন বৈকি।
গ্রামের সভ্যতায় মিশে থাকা এই ভূতের কথা,কৃষকের কথা আর পুরোনো ভালোবাসার কথা বসবাস আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। সংসারে অশান্তির চাপে, গ্রামের ছেলে দীনেশ নিজের গ্রাম থেকে আর একটি গ্রামে যায়, শহরের কাছাকাছি। কিন্তু সেখানে গ্রামের মায়ামমতা নেই।লোকগুলো কেমন প্রফেশনাল।টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। দীনেশ বাড়ি করেছে সস্তার জায়গা দেখে।মাঝমাঠ।চারিদিকে ধানচাষ হয়েছে। বর্ষাকাল। চন্দ্রবোড়া,কেউটে, কালাচ,গোখরো কতরকমের সাপ। ঘরে ঢুকে পড়েছে একদিন গোখরো সাপ। ঘরে আছে দীনেশ। বউকে ডেকে তুলে বাইরে আসে তারা। ভেতরে সাপের দখলাতি। ঘরে ঢুকবে তার উপায় নেই। ফণা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোখরো। দীনেশ ভাবে, প্রবাদ আছে, বাড়ি গাড়ি আর নারী, দেখেশুনে নিতে হয়। কিন্তু দেখতে গেলে টাকার এলেম চাই। গাড়ি কিনতে গিয়ে খুচরো গুণলে হবে না। নোট চাই নোট।দীনেশ পাশের গ্রাম থেকে সাপ ধরার লোক ডেকে আনল। কিন্তু সে খুব ভীতু। সাপ দেখে আর ধরতে পারছে না। শেষে দীনেশ তার হাত থেকে বড় সাঁড়াশি নিয়ে নিজেই ধরল সাপটা। তারপর জঙ্গলে ছেড়ে দিল।
আর একদিন রাতে চোর এসে কল খুলে নিয়ে চলে গেলো। দীনেশের ইনকাম কম। আবার কি করে জলের কল বসাবে চিন্তা করতে লাগল। কয়েকমাস দূর থেকে জল আনতে হত। সে কি কষ্ট। দূর থেকে জল এনে যে খেয়েছে সেই জানে।
বাঁশের বেড়া। চারদিক খোলা। কোন বাড়ি নেই।শুধু মাঠে চাষিরা এলে একটু আধটু কথা হয়। চাষিরা তাদের কথা বলে। খরচ করে, পরিশ্রম করে চাষ করেও ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। গরীব আরও গরীব হয়। ধনীর প্রাসাদ ভরে ওঠে প্রাচুর্যে,গরীবের রক্তের বিনিময়ে। এ কেমন নীতি চাষিরা বোঝে না। তারা মুখ বুজে আজীবন পরিশ্রম করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে যায়। অবস্থার পরিবর্তন হয় না। সমস্ত রক্ত জমা হয় মাথায়। দেশের সুস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

সতেরো বছর কেটে যায়। একই অবস্থা সেই চাষ। কোন বাড়িঘর হয়না। দু-একটা বাড়িঘর হয়তো দূরে দূরে দেখা যায়। কিন্তু রাস্তা নেই ঘাট নেই। ঘরে সাপ ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় দিনের পর দিন ভগবানের সুবিচারের আশায় পড়ে থাকে দীনেশ।
দীনেশের ছেলে দিনেন গ্রাজুয়েট হয়। করোনার অতিমারিতে পৃথিবী অসুস্থ হয়ে পড়ে।দীনেশের বউ ঝুমা বলে, এবার এ বাড়ি বিক্রি করে গ্রামে ফিরে যাই চলো। দীনেশ বাড়ি কেনাবেচার দালালদের বলে বাড়ি বিক্রির কথা। শেষে কুড়ি লাখ টাকায় বিক্রি হয় দীনেশের বাড়ি।
দীনেশ ভাবে, গ্রামে বসে থাকলে সে কুড়ি লাখ টাকার মালিক কোনোদিন হতে পারত না। ঈশ্বরের ইচ্ছে হয় তো তাই। তাই এত কষ্টের মধ্যে থেকে দীনেশের বাস মাঝমাঠে। সাধুবাবার আশ্রমের কথা মনে পড়ে দীনেশের। সেখানে সে মা ‘কে মনের কথা বলেছিল বারে বারে।
আবার দীনেশ ফিরে আসে নিজের গ্রামে, স্ত্রী কে সঙ্গে করে।ছেলেটা একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি পেয়ে গেছে কলকাতায়।

দীনেশ ফিরে যায় আবার চাঁপাপুকুরের পাড়ে।

দীনেশ ভাবে,এখনকার ছেলেরা কেউ আমাকে চেনে না।
পরের দিন দীনেশকে, বিকেলবেলা বিজয়দা তার বাড়িতে ডাকলেন। থালায় চারটে পিঠে। দীনেশ খেল তৃপ্তি করে। শেষে তিনি কাগজের ঠোঙায় অনেকগুলো পিঠে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা তুমি বাসায় গিয়ে খেও। আমার আনন্দ হবে। ইতস্তত হাতে দীনেশ পিঠেপুলি ধরে চোখের জল ফেলল। বিজয়দা বললেন, ভালবাসায় চোখের জল পড়ে। গাঁয়ে মায়ে সমান গো।
দীনেশ ভাবে, আমার এখন টাকার অভাব নেই। তোমাকে দেখে আমি যে কতটা আনন্দ পেলাম তা আর কেউ বুঝবে না।
বিজয়দা এই কথা শুনে আর কথা বলতে পারলেন না। ধরা গলায় বললেন, আবার এস দীনেশ।

দীনেশ জানে,মানুষের বয়স বাড়ে না,কমে যায় স্মৃতির আড়ালে। সময় পেলেই সে চলে যায় চাঁপাপুকুরের পাড়ে। বসে থাকে আকন্দবনের ধারে। জঙ্গলের এক বুনো গন্ধে পুরোনো গ্রামের কথা তার মনে পড়ে।এই পুকুরে খেলার সঙ্গিদের মনে পড়ে। বুকটা চিন চিন করে ওঠে। মন উদাস হয়। অতিতের এই পুকুর পাড়ে তার বয়স আর স্মৃতি থমকে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিরন্তন খেলায়। সে চাঁপাপুকুড়ের পাড়ে বসে ছোটবেলার খেলা খেলে আপনমনে,শৈশবকে মনে রেখে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।